নেতৃত্বের গুণাবলি জন্মগত অর্জন না তৈরি করা হয় বা তৈরি করা যায়, সে বিভেদ অনেক পুরনো। তবে বাণিজ্যিকীকরণের যুগ থেকে আমরা দেখতে পেয়ের্িছ, প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব তৈরি করা সম্ভব এবং সেটি তৈরি করার জন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নানা কৌশল প্রয়োগ করে থাকেন। প্রণোদনার প্রবক্তা, বিভিন্ন নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রেনিং সেন্টার এর মূল মাধ্যম। এবং এসব মাধ্যম প্রচুর অর্থও হাতিয়ে নিচ্ছে আমাদের উপযুক্ত নেতৃত্ব দানের সক্ষমতা তৈরি করার অভিপ্রায় সৃষ্টির মাধ্যমে। ‘হাতিয়ে নেয়া’ শব্দ ব্যবহার করার পেছনে আমি একটি উদাহরণ টানতে চাই। ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিলিকন ভ্যালির একটি প্রতিষ্ঠানের পিএইচডি ধারী এক নির্বাহী কর্মকর্তা এসেছিলেন লিডারশিপ নিয়ে দুই দিনের সেমিনারে আলোচনায় অংশ নিতে আমাদের দেশে এবং তিনি ছিলেন একক বক্তা। এর আয়োজক সংগঠক ছিল একটি ব্যাংক আর শিক্ষার্থী ছিলেন উচ্চ স্তরের ব্যাংকার। বক্তার থাকা-খাওয়া, বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ ও পারিশ্রমিক মিলিয়ে খরচ হয়েছিল প্রায় ১৮-২০ লাখ টাকা। অথচ আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশেও অনেক ভালো মানের, ভালো জ্ঞানের অধিকারী অনেক আলোচক আছেন, তারা এর চেয়ে অনেক কম অর্থ নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রতিস্থাপন করতে পারেন সুযোগ্য নেতৃত্বের গুণাবলি। কিন্তু আমাদের মনস্তাত্ত্বিক একটি দুর্বলতা সর্বক্ষেত্রে বিদেশীদের প্রতি। উন্নত দেশে একদিনের আলোচনার জন্য লক্ষাধিক ডলার দিতে হয়, এমন আলোচকও আছেন এবং তারা সে উপার্জনের সক্ষমতা অর্জন করেছেন জীবনে অনেক বৈরিতার মাঝে হেঁটে, প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে, ঈপ্সিত অভিলক্ষে পৌঁছে। বিশ্বে তাদের নামফলক এক একটি ব্র্যান্ড। সে কারণে তাদের কথা শুনতে, তাদের সম্পর্কে জানতে অনেক ব্যয় করে অনেকেই ছুটে যান সেসব সেমিনারে অংশ নিতে, শিখতে এবং নিজেকে তাদের মতো করে গড়ে তোলার স্বপ্ন মানস নিয়ে। এভাবে শত নেতা তৈরিও হচ্ছেন। ফলে আমাদের দেশের অনেকেই নেতৃত্বের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠাতে বা নিজেকে সময়োপযোগী নেতা তৈরি করার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের অনেক অর্থ ব্যয় করে ছুটছেন তা অর্জন করতে। আমি মানি, ভিন্ন সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা জানতে এবং তা পরিচালনার কৌশল করায়ত্ত করতে এটি সংগত অনুষঙ্গ। কিন্তু উন্নত দেশের ভাবধারার সঙ্গে আমাদের কৃষ্টি ও সার্বিক পরিবেশের অনেক ফারাক থাকার কারণে এর ১০ ভাগও প্রয়োগ করা হয়ে ওঠে না। উন্নত বিশ্বে গিয়ে রপ্ত করা শিক্ষা বক্তব্য প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে এসব বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্রে ৯০ ভাগ। এছাড়া দামি দামি লক্ষাধিক বই পুস্তক এবং নামিদামি শত শত ম্যাগাজিনও বাজারে আছে, যেগুলো পড়ে নেতৃত্ব রপ্ত করা যায় বা করার প্রচেষ্টাও চলছে। ভিন্ন কালচারের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ জানতে বা স্মার্ট লিডার, ট্রান্সফরমেশনাল লিডার ইত্যাদিতে নিজেকে রূপান্তর করতে উল্লিখিত বিষয়গুলোতে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু যারা উল্লিখিত কোনো সুযোগ পাচ্ছেন না বা সুযোগ করে নিতে পারছেন না, তাদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব তৈরি হবে কীভাবে? যদিও প্রযুক্তির যুগে কোনো কিছুই হাতের নাগালের বাইরে নয়, যে কেউ চাইলেই রপ্ত করতে পারেন যেকোনো জ্ঞান বা ধারণা। বিশেষ করে ইউটিউবের মাধ্যমে সৃষ্টিশীল অনেক প্রবক্তা করপোরেটে কীভাবে সফলতা অর্জন করা যায়, তা নিয়ে অনেক কিছু শেখাচ্ছেন। যা-ই হোক, এরই মাঝে আমি অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে সহজভাবে নিজেকে যোগ্যতর লিডার হিসেবে তৈরির কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করছি। হতে পারে তা ভিন্নতর ও আজকের বাণিজ্যিকীকরণের জগতে না মানার। প্রতিষ্ঠানে আপনি অনেক স্তর পাড়ি দিয়ে একসময় বিশাল এক কর্মী বাহিনীর নেতৃত্ব বা লিডারশিপ পেলেন। আপনার নেতৃত্বে একটি ফলোয়ার গ্রুপ আপনার উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য তৈরি করতে হবে, যারা আপনার নেতৃত্বের সফলতার অংশীদারিত্ব নেবেন। এক্ষেত্রে তাদের প্রণোদিত রাখার মূল তরিকাটি যদি আপনি এভাবে পরিচালনা করেন যে, আপনি স্তরে স্তরে বেড়ে উঠতে গিয়ে যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন, যে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বা অনিচ্ছাকৃত বিপদে পড়েছেন, নিজের টিমের সদস্যদের কেউ যেন সে ধরনের পরিস্থিতিতে আপনার কারণে না পড়েন বা অন্যভাবে সে ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে তার পাশে দাঁড়ানো এবং তাকে যথাসাধ্য সহযোগিতা ও সুরক্ষা করা। কোনোভাবেই সেখানে আপস না করা। এতে করে আপনার কর্মী বাহিনী আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে উঠবে এবং আপনার প্রতি তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে, আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আপনার পাশে প্রত্যয়ী সঙ্গী হিসেবে থাকবে। প্রতিষ্ঠানকে ভালোবাসবেন, তাই বলে প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিজস্ব সম্পত্তি ভাববেন না বরং কর্মী বাহিনীকে প্রতিষ্ঠানের এবং আপনার স্বপ্ন পূরণের সম্পদ ভাববেন। নিজের অবস্থান থেকে অন্যের অবস্থান নির্ণয় না করে, অন্যের নাজুক অবস্থানে হূদয় দিয়ে নিজের অবস্থান ভাবুন, দেখবেন আপনার সিদ্ধান্ত সুষ্ঠুভাবে কার্যকর হচ্ছে। মনে রাখবেন, একসময় আপনার নেতৃত্বের প্রয়োজনও ফুরিয়ে যেতে পারে নতুন কোনো কৌশল বা নেতৃত্ব জেগে ওঠার কারণে বা আপনার কর্মকাল শেষ হলে। আপনার অনুপস্থিতিতে যত বেশি পুরনো প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের কর্মী আপনাকে মনে রাখবে, সুযোগ্যতার নিরিখে আপনি তত সফল লিডার। প্রতিষ্ঠানে থাকা অবস্থায় কেউ কেউ আপনার বিরোধিতা করলেও আপনার অনুপস্থিতিতে তারা আপনাকে ভক্তিভরে স্মরণ করবে। অন্য আরেকটি জরুরি গুণাবলি হচ্ছে, আপনার করপোরেট জীবনের চলমান পথে অনেক বসের অনৈতিক কার্যকলাপ দেখেছেন, ঘৃণ্য রাজনীতি দেখেছেন, তাদের অসাধু পন্থায় চলা দেখেছেন, অথচ তারা ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে, যা আপনি সে সময় মানতে পারেননি, আপনি পছন্দ করতেন না, কিন্তু সে সময় এ নিয়ে প্রতিবাদ করার পরিস্থিতিও আপনার ছিল না, সে কাজগুলো নেতৃত্বকালে আপনাকে দিয়ে কোনোভাবে যেন সংঘটিত না হয়। আমি নিশ্চিত, এ কয়টি গুণ আপনাকে তৈরি করবে মানবিক নেতৃত্বের অধিকারী হিসেবে। মানবিক নেতৃত্বের আজ আমাদের বড় অভাব।
মো.
শরিফুল ইসলাম
খান:
সাবেক ব্যাংকার