কালো মেয়ের মহাকাশ জয়

বণিক বার্তা অনলাইন

২০১৬ সালে অস্কার মনোনয়ন পায় ‘হিডেন ফিগারস’ চলচ্চিত্র। সম্ভবত এর আগে ক্যাথেরিন জনসন নামের এক কালো মেয়ের কৃতিত্ব সম্পর্কে আমেরিকার বাইরের খুব কম মানুষই জানতো। গণিতের এ জিনিয়াস যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায় কাটিয়েছেন তেত্রিশটি বছর। বুধগ্রহ, চন্দ্রাভিজান এমনকি হালের মঙ্গল অভিযানেও তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ক্যাথেরিন জনসনের গাণিতিক দক্ষতা ও ব্যাকআপ পরিকল্পনা ছাড়া অ্যাপোলো-১৩ এর আরোহীদের হয়তো আর পৃথিবী ফেরাই হতো না! প্রথম যখন নাসায় ডিজিটাল কম্পিউটার আনা হয়, তখনও যেকোনো গাণিতিক হিসাব-নিকাশে তার অনুমোদন ছাড়া মহাকাশচারীরা ভরসাই পেতেন না।

এই মহিয়সী নারী গতকাল সোমবার ১০১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। নাসার বর্তমান প্রশাসনিক প্রধান জিম ব্রাইডেনস্টাইন তার এ মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন। তাকে ‘আমেরিকান হিরো’ আখ্যায়িত করে বলেছেন, তিনি অনেককিছুর পথিকৃৎ। এ অবদান কখনো ভোলার নয়।

নাসায় জনসনের ৩৩ বছরের ক্যারিয়ার এবং একজন কালো মেয়ে হিসেবে তার সংগ্রামের বিস্তারিত উঠে এসেছে মারগোট লি শেটারলির লেখা ‘হিডেন ফিগার্স’ বইয়ে। বইটি প্রকাশের এক বছর পরই (২০১৬) একই নামে হলিউড থেকে চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। অস্কার মনোনয়নও পায় সেটি। ২০১৫ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম দেন। 

নাসার স্পেস শাটল কর্মসূচির একেবারে শুরুর দিকের গুরুত্বপূর্ণ গবেষক ও কর্মী ছিলেন ক্যাথেরিন জনসন। ১৯৬২ সালে প্রথম পৃথিবীর চারদিক পরিভ্রমণ করতে মহাকাশে মানুষ পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। সেই মহাকাশযানের আরোহী ছিলেন জন গ্লেন। প্রথম কোনো আমেরিকান হিসেবে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেছিলেন তিনি। সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পরও গ্লেন বারবার পরামর্শ করেছিলেন ক্যাথেরিনের সঙ্গে। ততোদিন নাসায় এসেছে ডিজিটাল কম্পিউটার। সব হিসাব নিকাশ করা হয়েছে কম্পিউটারে। কিন্তু তারপরও ভরসা পাননি গ্লেন। তিনি চূড়ান্ত যাচাইয়ের জন্য ক্যাথেরিনকে চেয়েছিলেন। গণিতবিদ হিসাবে এতোটাই নির্ভরযোগ্য ছিলেন ক্যাথেরিন। এ প্রসঙ্গে ২০১৭ সালে ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ও জানতো তার জন্য এই হিসাব-নিকাশের কাজটি আমি আগে করেছি। ওরা আমার কাজে খুব আস্থা রাখতো।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যখন মহাকাশ বিজয়ে প্রতিযোগিতায় মরিয়া, তখন জনসন আর তার সহকর্মীরা মানুষবিহীন রকেট উৎক্ষেপণের হিসাব-নিকাশ কষতেন। পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ, মহাকাশযানের নিরাপত্তা, গতিবিধি ইত্যাদি বিষয়ের গাণিতিক হিসাব তখন মেয়েরাই করতেন। আর প্রকৌশলের কাজ করতো ছেলেরা। আর এসব জটিল হিসাব কষতে হতো খাতা পেনসিল আর যান্ত্রিক গণনাযন্ত্রে। ক্যাথেরিন এ কাজে ছিলেন অসম্ভব দক্ষ। 

কিন্তু তখন আমেরিকার রন্ধে রন্ধে বর্ণবাদের স্রোত। নাসার মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানেও কালো সহকর্মীদের জন্য ছিল আলাদা কাজের জায়গা। খাওয়া ও বিশ্রামের স্থানও ছিল সাদাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের অফিসের সামনে লেখা ছিল ‘কালার্ড কম্পিউটার্স’। এ নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হলে, ক্যাথেরিন বলেন, তিনি এসব ভালোভাবেই জানতেন কিন্তু কখনো আমলে নেননি। তিনি শুধু তার কাজটুকু করে যেতে চাইতেন। কারণ সবাই এখানে একই উদ্দেশ্যে কাজ করছে। আর সেটি আবার গবেষণার কাজ।

২৬টি বৈজ্ঞানিক গবেষনাপত্রের সহলেখক ক্যাথেরিন জনসন। এটি নিয়েও মজার ঘটনা আছে। ১৯৫৮ থেকে ১৯৮৬ সালে অবসর নেয়ার আগে পর্যন্ত জনসন কাজ করেছেন মূলত মহাকাশ প্রযুক্তিবিদ হিসেবে। এর আগে ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত তার কাজ ছিল মূলত গাণিতিক হিসাব-নিকাশের। পদের নাম ছিল ‘কম্পিউটার’।  ১৯৬১ সালের ৫ মে অ্যালান শেফার্ডের মহাকাশ ভ্রমণের গতিপথ হিসাব করেছেন তিনিই। শেফার্ডই ছিলেন মহাকাশভ্রমণকারী প্রথম আমেরিকান। একই বছর বুধ অভিযানের লঞ্চ উইন্ডোর গাণিতিক হিসাবও তার হাতেই। তিনিই ব্যাকআপ নেভিগেশন মানচিত্র করেন, যাতে কোনো কারণে বৈদ্যুতিক যন্ত্রে ত্রুটি দেখা দিলে নভোচারীরা ম্যানুয়ালি নিরাপদে ফিরতে পারেন। ১৯৭০ সালে অ্যাপোলো-১৩ চান্দ্র অভিযানে এমন একটি দুর্ঘটনা প্রায় ঘটতে চলেছিল। কিন্তু জনসনের এ কাজের কারণেই নভোচারীরা নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরতে পেরেছিলেন। পরে জনসন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমরা সত্যিই তাদের ফিরে আসা নিয়ে সংশয়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম।

মহকাশচারী জন গ্লেনের পৃথিবীর চারদিকে পরিভ্রমণ পথ হিসাব করার জন্য নাসা প্রথমবারের মতো ডিজিটাল কম্পিউটার ব্যবহার করে। কিন্তু জনসন এ হিসাব যাচাই করে না দিলে রকেটে চড়তে অস্বীকৃতি জানান গ্লেন। বায়োগ্রাফি ডটকমে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, এটি ছিল খুব জটিল গাণিতিক হিসাব-নিকাশ। মহাজাগতিক বস্তুর অভিকর্ষীয় টান বিবেচনায় নিয়ে একটি মহাকাশযানের গতিপথ হিসাব করে বের করা খুবই কঠিন। এই কঠিন কাজে একমাত্র এই কালো মেয়ের ওপর ভরসা করেছিলেন শ্বেতাঙ্গ গ্লেন।

এক স্মৃতিচারণায় জনসন বলেন, আমাদের সময়ে নারীদের জেদি ও আগ্রাসী হতে হতো। তোমার কাজের ওপর যেন বাকিরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এটা নিশ্চিত করতে হতো। আমাকেও তা-ই করতে হয়েছিল। নাসার শুরুর দিকে কোনো রিপোর্টে মেয়েদের নাম রাখা হতো না। আমি টেড স্কোপিনস্কির সঙ্গে কাজ করতাম। তিনি এ কাজ ছেড়ে হিউস্টনে যেতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আমাদের সুপারভাইজার হেনরি পিয়ারসন মেয়েদের তেমন পছন্দ করতেন না। তিনি চাইলেন টেড যেন কাজটা শেষ করে যায়। কিন্তু টেড বললেন, এটা ক্যাথেরিনেরই করা উচিত, ও এরই মধ্যে বেশিরভাগ কাজ করে ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত কাজটি আমিই করি। আর প্রথমবারের মতো কোনো কাগজে আমাদের বিভাগের কোনো মেয়ের নাম লেখা হলো। 

জনসন পরে ডিজিটাল কম্পিউটারে কাজ করেছেন। তার গাণিতিক দক্ষতা নতুন প্রযুক্তির ওপর নাসার বিজ্ঞানীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে উৎসাহ দিয়েছে। ১৯৬১ সালে অ্যালান শেফার্ডের ফ্রিডম ৭ বুধ ক্যাপসুলটি ল্যান্ড করার পর অবস্থান শনাক্ত করতে জনসনের গতিপথ নির্ণয়ের নিখুঁত গাণিতিক হিসাব বেশ সাহায্য করেছিল। 

ক্যাথেরিন জনসনের পারিবারিক নাম নি ক্যাথেরিন কোলম্যান। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার হোয়াইট সালফার স্প্রিংসের জয়লিট ও জশুয়া কোলম্যান দম্পতির ঘরে ১৯১৮ সালের ২৬ আগস্ট তার জন্ম। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তার মা ছিলেন শিক্ষিকা আর বাবা কৃষক। কাজ করতেন একটি হোটেলে। শৈশব থেকেই তিনি গণিতে ছিলেন দুর্দান্ত। ওই সময় গ্রিনব্রিয়ার কাউন্টিতে কালো শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো স্কুল ছিল না। এ কারণে তাকে ভর্তি করা হয় ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইনস্টিটিউটের একটি হাইস্কুলে। এটি ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া স্টেট কলেজেরই (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) একটি বর্ধিত ক্যাম্পাস। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি এখানে ভর্তি হন। ফলে তার পরিবারকে দুই জায়গাতেই ভাগ করে থাকতে হতো। ১৪ বছরে গ্রেজুয়েশন শেষ করে তিনি ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া স্টেটে ভর্তি হন। এটি একটি ঐতিহাসিক কৃষাঙ্গ কলেজ। তিনি এখানে গণিতের সবগুলো কোর্স নেন। তার শিক্ষক ছিলেন গণিতে পিএইচডি করা তৃতীয় আফ্রিকান আমেরিকান শিফেলিন ক্লেটর। শুধু ক্যাথেরিনের জন্য এ কলেজে নতুন ধরনের গণিত পাঠ্যক্রমভুক্ত করেন ক্লেটর। ১৮ বছর বয়সে ক্যাথেরিন গণিত ও ফরাসি ভাষায় গ্রেজুয়েট হন। ভার্জিনিয়ার একটি কৃষাঙ্গ স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন তিনি। 

১৯৩৯ সালে বিয়ের পর শিক্ষকতা ছেড়ে দেন এবং গণিতে গ্রেজুয়েশন প্রোগ্রামে ভর্তি হন। গর্ভবতী হওয়ায় এক বছরের মাথায় সেটিও ছেড়ে দেন। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির গ্রেজুয়েট স্কুলে তিনিই ছিলেন প্রথম কৃষাঙ্গ নারী শিক্ষার্থী। এর আগে এটি শুধুই সাদাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল।

বিবিসি, আল জাজিরা ও উইকিপিডিয়া অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন