বিশেষ নোটিসের অস্থায়ী আমানতেও উচ্চ সুদ

হাছান আদনান

ব্যাংকে টাকা রাখলে সবচেয়ে বেশি সুদ পাওয়া যায় মেয়াদি আমানতে। নয়-ছয় বাস্তবায়নে মেয়াদি আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। যদিও বেসরকারি অনেক ব্যাংকের বিশেষ নোটিস আমানতের (এসএনডি) সুদহারই ৬ শতাংশের বেশি এখনো।

এসএনডিতে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ শতাংশ সুদ দিচ্ছে যমুনা ব্যাংক লিমিটেড। ৭ শতাংশ সুদ দিচ্ছে উত্তরা ব্যাংকের মতো প্রবীণ ব্যাংকও। ৬ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে ১১টি ব্যাংক। আবার একই ধরনের আমানতে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ সুদ দিচ্ছে এমন ব্যাংকও রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান  থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

এসএনডি হলো ব্যাংকের সে আমানত, যা গ্রাহকরা চাইলেই তুলে নিতে পারেন। এ ধরনের ব্যাংক হিসাবে থাকা আমানতের সুদহার সব সময় আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার বা কলমানির চেয়ে কম হয়। বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিংয়ে এ নীতিই আদর্শ হিসেবে প্রচলিত রয়েছে।

বর্তমানে কলমানিতে সর্বোচ্চ সুদহার সাড়ে ৫ শতাংশ। এসএনডি হিসাবের সুদহার কোনোভাবেই কলমানির চেয়ে বেশি হওয়া প্রত্যাশিত নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কোনো ব্যাংক যদি এসএনডিতে বেশি সুদ দেয়, তাহলে বুঝতে হবে সে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় সমস্যা আছে। আমানতের সংকট থাকলে তবেই ব্যাংকগুলো স্থায়ী আমানতের পাশাপাশি এসএনডি হিসাবের সুদহার বাড়ায়। আবার অনেক সময় ব্যক্তিবিশেষ বা প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি সুবিধা দিতেও ব্যাংকগুলো এসএনডি হিসেবে বেশি সুদ দেয়।

ব্যাংক এশিয়ার শীর্ষ নির্বাহী মো. আরফান আলী বলেন, সরকারি-বেসরকারি বড় করপোরেটগুলোর আমানত ধরে রাখতেই বিশেষ নোটিসের আমানতে বেশি সুদ দিতে হচ্ছে। একসময় ব্যাংক এশিয়ার এসএনডি হিসাবের সুদহার ৮ শতাংশও ছিল। এ ধরনের আমানতের সুদহার ধারাবাহিকভাবে কমানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৪ হাজার ১৮০ কোটি টাকা ছিল বিশেষ নোটিস আমানত (এসএনডি) হিসাবে, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ৯ শতাংশ। এসব আমানতের মধ্যে ৪০ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয়। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ছিল ৫৮ হাজার ৪১২ কোটি টাকার বিশেষ নোটিস আমানত।

এসএনডি হিসাবের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ সুদ পরিশোধ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। তবে দেশের অর্ধেকের বেশি বেসরকারি ব্যাংকের এসএনডি হিসাবের সুদহার ৫ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে ১০০ কোটি টাকা বা তার বেশি আমানতের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদ দিচ্ছে যমুনা ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির এসএনডি হিসাবের সর্বোচ্চ সুদ ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। এসএনডি হিসাবের বিপরীতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ সুদ পরিশোধ করছে উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড। সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ দিচ্ছে আইএফআইসি ব্যাংক। এ তিনটি ব্যাংকের অবস্থানই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সামনের সারিতে।

বিশেষ নোটিস হিসাবের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদ দিচ্ছে আটটি বেসরকারি ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলো হলো ব্যাংক এশিয়া, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড।

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যেসব আমানত সময় নির্দিষ্ট করে রাখা যায় না, সেগুলো আমরা এসএনডি হিসাবে রাখি। বড় করপোরেটদের অনেকেই এসএনডি হিসাবে টাকা রাখতে পছন্দ করে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে বেসরকারি খাতের বড় করপোরেটগুলোও এ তালিকায় রয়েছে। আমানতের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি হলে তবেই আমরা ৬ শতাংশের বেশি সুদ দিই। তবে এত পরিমাণ সুদ দিয়ে ব্যাংকের খুব বেশি মুনাফা হয় না। এজন্য ধীরে ধীরে এসএনডি হিসাবের সুদহার কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছি।

দেশের অর্ধেকের বেশি বেসরকারি ব্যাংক এসএনডি হিসাবের বিপরীতে ৫ শতাংশের বেশি সুদ দিলেও কয়েকটি ব্যাংকের সুদহার ৩ শতাংশের নিচে। ১০০ কোটি টাকা বা তার বেশি বিশেষ নোটিসের আমানতের বিপরীতে মাত্র ২ শতাংশ সুদ দিচ্ছে ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড। একইভাবে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ মুনাফা দিচ্ছে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকও। ১০টিরও বেশি ব্যাংকের এসএনডি হিসাবের সর্বোচ্চ সুদ ৩ শতাংশের ঘরে।

এসএনডি হিসাবের সুদহার কলমানির চেয়ে বেশি হওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনউদ্দীন। তিনি বলেন, স্বল্প সময়ের নোটিসে এসএনডি হিসাবের টাকা তুলে নেয়া হয়। ফলে এ শ্রেণীর হিসাবের আমানত দিয়ে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ। করপোরেটগুলোর বড় অংকের আমানত যেকোনো ব্যাংকের জন্য যেমন আশীর্বাদ, তেমনই অভিশাপ। একসঙ্গে ২-৩শ কোটি টাকার আমানত কোনো ব্যাংক থেকে চলে গেলে এডি রেশিও ঝুঁকিতে পড়ে। বিশেষ নোটিসের আমানতের সুদহার সবসময় কলমানি সুদহারের নিচে থাকা উচিত।

সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ১ এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৯ শতাংশ। সুদহার এক অংকের ঘরে নামিয়ে আনতে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ শতাংশের বেশি সুদে কোনো আমানত না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। দেশের সরকারি-বেসরকারি  প্রায় সব ব্যাংকের এমডিরা অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভায় বসে এ সিদ্ধান্ত নিলেও সেটি এখনো কার্যকর হয়নি। অনেক ব্যাংকই এখনো ৬ শতাংশের বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। এমনকি ৮-১০ শতাংশ সুদে এক ব্যাংকের আমানত অন্য ব্যাংক ভাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িকভাবে প্রভাবশালী উদ্যোক্তাদের নেতৃত্বাধীন ব্যাংকগুলো বেশি সুদে আমানত নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

সামগ্রিক বিষয়ে এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকগুলো চেষ্টা করছে আমানতের সুদহার কমিয়ে আনার। অনেক ক্ষেত্রে সেটি হয়তো পুরোপুরি কার্যকর করা যাচ্ছে না। তবে এক্ষেত্রে সদিচ্ছা থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, ১ এপ্রিল থেকে সুদহার এক অংকের ঘরে নামিয়ে আনতে হলে সব ধরনের আমানতের সুদহার কমাতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বড়  করপোরেটগুলো এখনো সুদহার নিয়ে দর-কষাকষি করছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে এসএনডি হিসাবের আমানতের সুদও ৬ শতাংশের বেশি দিতে হচ্ছে। ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। তবে সেটি নৈতিকতায় ছাড় দিয়ে যেন না হয়।

বিশেষ নোটিসের আমানতের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ সুদ দিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো। দেশে কার্যরত বিদেশী ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ সুদহার আরো কম। এসএনডিতে সর্বনিম্ন শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ দিচ্ছে সিটি ব্যাংক এনএ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন