১৮৫৭
সাল। সিপাহি বিদ্রোহে ভারতবর্ষে কেঁপে ওঠে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। আধুনিক
ইতিহাসবিদদের অনেকে এ বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত
করেছেন। এই বিদ্রোহের কিছু বিবরণী পাওয়া যায় কবি মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিবের
কলমে। গালিব প্রাচীন ফারসিতে কুহেলিকা আচ্ছাদিত রীতিতে লিখেছিলেন দস্তঁবু। গালিবের
সেই লেখা সমকালীন পণ্ডিতদের পক্ষেও বোঝা দুরূহ ছিল। যাহোক, গালিবের দস্তঁবু বাদে বাহাদুর শাহ জাফরের স্নেহধন্য, মোগল দরবারের তরুণ এক কবি সিপাহি বিদ্রোহের নামচা লিখেছিলেন, যা পরবর্তীকালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এ তরুণ কবির নাম সৈয়দ
জহিরউদ্দিন হুসাইন জহির দেহলভি। তিনি ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের ঘটনাপঞ্জি সম্রাটের
দরবারে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সে সময় তার বয়স মাত্র ২২। সে হিসেবে জহিরের
জন্মসাল ১৮৩৫। জহিরের পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে মোগল দরবারের বিভিন্ন উচ্চ পদে
নিযুক্ত ছিল। তার পিতামহ মীর ইমাম আলী শাহ ছিলেন সেকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ
ক্যালিগ্রাফার। খোদ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন তার ছাত্র। আট বছর বয়স থেকেই
লাল কেল্লায় জহিরের যাতায়াত শুরু হয়। দরবারের রীতিনীতির সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই তিনি
পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি স্বয়ং শেষ মোগল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের কাছে
ক্যালিগ্রাফির পাঠ নিয়েছিলেন। জহির কবিতা লেখা শিখতে গিয়েছেন মির্জা গালিবের কাছে।
তবে তার ওস্তাদ ছিলেন শেখ ইব্রাহিম জাক। জহিরের কবিতায় মোমিন খান মোমিনের
কাব্যরীতির প্রভাব দেখা যায়। বাহাদুর শাহের দরবারে জহিরকে দারোগা-ই-মাহি-মারতিব
হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তার উপাধি ছিল রাকিম-উদ-দৌলা সৈয়দ জহিরউদ্দিন হুসাইন খান দারোগা-ই-কুজবেগি। কাজের অংশ হিসেবে দরবারের
বাইরে সম্রাটের যেকোনো উপস্থিতিতে জহির তার সঙ্গে থাকতেন। আর অন্যান্য দিনে তিনি
উপস্থিত থাকতেন সম্রাটের ঝারোখা দর্শন ও দরবারের নিয়মিত সভায়। জহিরের লেখা কাব্য
রচনাগুলো ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহের সময় ধ্বংস হয়ে যায়। ব্রিটিশরা বাহাদুর শাহ জাফরকে
গ্রেফতার এবং দিল্লি শহরে বিদ্রোহ দমন শুরু করলে আরো
অনেকের মতো জহিরও সেখান থেকে পালিয়ে যান। বিদ্রোহ-পরবর্তী
সময়ে লেখা তার কবিতাগুলো কিছু কিছু প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রকাশিত প্রথম দিওয়ানটির
নাম গুলিস্তাঁ-ই-সুখান।
শেষ জীবনে জহির হায়দরাবাদে স্থায়ী হয়েছিলেন এবং ১৯১১ সালের মার্চে সেখানেই তিনি
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সিপাহি
বিদ্রোহের বিবরণী নিয়ে জহিরের লেখা দাস্তান-ই-গদর
গ্রন্থটি বিদ্রোহের ইতিহাস এবং শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের জীবন সম্পর্কে
জানার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জহির ইতিহাসবিদ ছিলেন না, কিন্তু কবি হিসেবে তার লেখা এ গ্রন্থ মূল্যবান; কারণ এটি মোগল দরবারে অবস্থানরত এবং সম্রাটের স্নেহধন্য একজন
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণী। এ স্মৃতিকথায় যেমন সিপাহি বিদ্রোহের নানা ঘটনার বিবরণ
পাওয়া যায়, তেমনি জানা যায় সেসব ঘটনার পরিণতি আর
মানুষের জীবনে সেসবের অভিঘাত। জহিরের লেখায় বিদ্রোহের বিবরণ ছাড়াও পাওয়া যায়
সেকালের দিল্লির মোগল দরবার, সংস্কৃতি, উৎসব, সাহিত্যচর্চার বিশদ বিবরণ।
শেষ
মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বিচারের সময় ব্রিটিশরা তার বিরুদ্ধে দিল্লিতে
নিরীহ ইংরেজ নারী ও শিশুদের হত্যার অভিযোগ এনেছিল। কিন্তু জহিরের লেখা দাস্তান-ই-গদর গ্রন্থে পাওয়া যায় তিনি বরং
বিদ্রোহীদের হাত থেকে ইংরেজ নারী-শিশুদের বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলেন। সেই
বিশেষ দিনটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায় জহিরের কলম থেকে। আরো জানা যায়, দিল্লি শহরে সিপাহিদের কর্মকাণ্ডে বাহাদুর শাহ জাফর অসন্তুষ্ট
হয়েছিলেন।
ভারতবর্ষের
ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণ ছিল ১৮৫৭ সাল। আর জহির দেহলভির দাস্তান-ই-গদর গ্রন্থে আমরা জানতে পারি সেই
সন্ধিক্ষণের অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষ বিবরণ। জহির দেহলভি সিপাহি বিদ্রোহের এ
স্মৃতিকথা লিখেছিলেন তার মৃত্যুশয্যায়,
উর্দু ভাষায়। এক
বন্ধুর অনুরোধে তিনি এ লেখা শুরু করেন। বিদ্রোহের বিবরণী গ্রন্থের পাশাপাশি জহিরের
এই রচনা উর্দু ভাষার প্রথম আত্মজীবনীগুলোর একটি। জহিরের বইটি ১৯১৪ সালে লাহোরে
প্রথম প্রকাশিত হয়। জহিরের পাণ্ডুলিপি তার দৌহিত্র মীর ইসতিয়াক শওক দিয়েছিলেন আগা
মোহাম্মদ তাহিরকে। এই তাহিরের উদ্যোগে জহির দেহলভির আত্মজীবনী ১৯১৪ সালে লাহোর
থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ লাহোর থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল
১৯৫৫ সালে। শুরুতে এটি পরিচিত ছিল তারাজ-ই-জহিরি নামে। পরবর্তী সময়ে স্মৃতিকথাটি
দাস্তান-ই-গদর
নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। জহির দাস্তান-ই-গদরের
ভূমিকায় লিখেছেন—
‘আমার জীবনের অভিজ্ঞতা লেখার জন্য অনুরোধগুলো যখন সনির্বন্ধ হয়ে উঠল, তখন এই ফকিরের পক্ষে তা এড়িয়ে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ ছিল না। এরপর যখন কিছু দলিল ও চিঠিপত্র হাতে পাই, তখন আমি আমার স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করি—আমার জন্ম থেকে আজকের দিন পর্যন্ত। এটি আমার জীবত্কালে ঘটা কিছু ঘটনার নিরেট সত্য বিবরণী; এতে কোনো চাতুরী, অতিরঞ্জন কিংবা অসৎ হস্তক্ষেপ করা হয়নি।
‘কাউকে অপমান কিংবা সমালোচনা করার কোনো
উদ্দেশ্য আমার নেই। কারো স্তুতিমূলক কিছু লেখাও আমার উদ্দেশ্য নয়।
‘আমি কোনো প্রশংসা, পুরস্কার কিংবা প্রতিদান চাই না।
‘আমি কোনো চোস্ত রচনারীতি বা উপস্থাপন
কৌশলের ওপর নির্ভর করিনি; এসবের পরিবর্তে বরং যা দেখেছি, সে সম্পর্কে সরলভাবে সত্য প্রতিবেদন লেখার ওপর জোর দিয়েছি। বাগাড়ম্বর
ও ছন্দোবদ্ধ বক্তব্য শুনে শুনে আমি ক্লান্ত।
‘আমার লেখার রীতি যদি আজকের দিনের
প্রতিষ্ঠিত রীতির চেয়ে ভিন্নও হয়,
তাহলেও আমি
পরোয়া করি না। আমি শুধু আমার লেখার উদ্দেশ্যের প্রতি সৎ থাকতে চেয়েছি। সত্যকে
পরিমার্জন করে আমি কী করব?
‘আমি আমার এই স্মৃতিকথা লিখছি সরল, নিত্যদিনের ব্যবহার্য ভাষায়। আমি সাংবাদিক নই, গল্পকারও নই। আমি আমার মাতৃভাষাকেই ব্যবহার করব, যে ভাষা শিশুকাল থেকে আত্মস্থ করেছি। আর লিখনরীতি সেটাই ব্যবহার করেছি, যেটা আমার শিক্ষকদের কাছ থেকে শিখেছি। ঘটনাগুলো ঘটার সময় আমি মানুষের
কাছে যা শুনেছি, সেসবই এখানে লিপিবদ্ধ করেছি; আমি সেগুলোকে বদলাইনি। এ সময়কালে যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং আমি নিজে যা
দেখেছি, সেগুলোকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে টুকে
রেখেছি।
‘যা কিছু ভুল, তা বিবরণদাতাদের।
‘বিদ্রোহের সময় যা যা ঘটেছে, তার সবকিছুরই আমি বিবরণ দিয়েছি। বাজারের গুজবের ওপর নির্ভর করিনি।’
ভারতবর্ষের
ইতিহাসে ঔপনিবেশিক শাসনামলটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ আমলে একদিকে যেমন এ
অঞ্চলের বিপুল সম্পদ ব্রিটেনে পাচার হয়েছে,
তেমনি তৈরি
হয়েছিল আধুনিক সমাজ-অর্থনীতির বিভিন্ন শর্ত। বণিক বার্তা উপমহাদেশের
ঔপনিবেশিক কালপর্বটি নিয়ে অনুসন্ধিত্সু। ইতিহাসের এ পর্বটির বিবরণ, নতুন নতুন বিশ্লেষণ পাঠকের সামনে হাজির করতে বণিক বার্তা বিশেষভাবে
আগ্রহী। এর আগে বণিক বার্তা বাংলা ভাষায় গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছে ঔপনিবেশিক আমলের
পথপ্রদর্শক বাঙালি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবন ও উদ্যোগ নিয়ে
ব্লেয়ার বি. ক্লিং রচিত গ্রন্থ পার্টনার ইন
এম্পায়ার। এছাড়া বণিক বার্তা ঔপনিবেশিক শাসনামলের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র লর্ড
ক্লাইভকে নিয়েও ধারাবাহিক আয়োজন প্রকাশ করেছে।
১৮৫৭
সালের সিপাহি বিদ্রোহে ভারতবর্ষে কোম্পানি শাসনের সমাপ্তি ঘটেছিল, কায়েম হয়েছিল ব্রিটেনের রানীর শাসন। ঔপনিবেশিক আমল নিয়ে ঐতিহাসিক
বোঝাপড়া ও গবেষণাকে এগিয়ে নিতে বণিক বার্তা এবার প্রকাশ করতে যাচ্ছে উপমহাদেশের
ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের অমূল্য
দলিল দাস্তান-ই-গদরের
বাংলা অনুবাদ। পেঙ্গুইন র্যানডম হাউজ ইন্ডিয়া প্রকাশিত ‘দাস্তান-ই-গদর: দ্য টেল অব দ্য মিউটিনি’ গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় প্রকাশের স্বত্ব
পেয়েছে বণিক বার্তা। আগামীকাল থেকে
‘দাস্তান-ই-গদর: দ্য
টেল অব দ্য মিউটিনি’ থেকে প্রকাশিত হবে ধারাবাহিক আয়োজন।
সিপাহি বিদ্রোহ ও ওই সময় দিল্লির দরবারে ঘটে যাওয়া নানা নাটকীয় ও অজানা ঘটনার
প্রত্যক্ষ বিবরণী পাঠক পড়তে পারবেন বণিক বার্তার পাতায়। বাংলা ভাষায় দাস্তান-ই-গদর পাঠে বণিক বার্তার পাঠকদের স্বাগত।
ছবি: সংগৃহীত