সরবরাহ বন্ধ

বাজারে জরায়ুমুখে ক্যান্সারের মানহীন প্রতিষেধক

তবিবুর রহমান

বাজারে জরায়ুমুখে ক্যান্সারের প্রচলিত দুটি প্রতিষেধক স্যাভারিক্স (০.৫ এমএল) ও গর্ডাসিল সরবরাহ বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষেধক দুটির দুষ্প্রাপ্যতার সুযোগ নিয়ে ভারত ও চীন থেকে চোরাই পথে ভ্যাকসিন দুটি নিয়ে আসছে কিছু ফার্মেসি। আনার সময় যথাযথ তাপমাত্রায় সংরক্ষিত না হওয়ায় মান হারাচ্ছে এসব ভ্যাকসিন। আবার সরবরাহ সংকটের সুযোগে মানহীন এসব ভ্যাকসিন থেকে অতিরিক্ত দাম আদায় করছে ফার্মেসিগুলো। এতে ভ্যাকসিন কিনতে এসে গ্রাহকরা যেমন একদিকে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে নারী স্বাস্থ্য।

দেশে প্রতি বছর নতুন করে ১২ হাজার ৭৬৮ নারী আক্রান্ত হচ্ছেন জরায়ুমুখে ক্যান্সারে। প্রাণ হারাচ্ছেন আট হাজার নারী। এ ক্যান্সার প্রতিরোধে বাজারে দুটি ভ্যাকসিন চালু রয়েছে। এর মধ্যে স্যাভারিক্স (০.৫ এমএল) তৈরি ও বাজারজাত করছে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ায় বাজারে স্যাভারিক্স সরবরাহ বন্ধ রয়েছে এক বছর ধরে। অন্যদিকে আমদানির মাধ্যমে গডার্সিল (০.৫ এমএল) বাজারজাত করছে হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। এ ওষুধটিরও সরবরাহ বন্ধ রয়েছে প্রায় দুই বছর। অভিযোগ রয়েছে, এ সুযোগে ফার্মেসিগুলো নিজ উদ্যোগে অবৈধ পথে চীন, ভারত, পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ভ্যাকসিনগুলো নিয়ে আসছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও মান ঠিক করার জন্য বিশেষ ফ্রিজে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয় এবং ফ্রিজ থেকে দ্রুত সেবাপ্রত্যাশীদের শরীরে প্রবেশ করাতে না পারলে ভালো ফল পাওয়া যায় না। তবে অবৈধভাবে চোরাই পথে যেসব ভ্যাকসিন আনা হচ্ছে, সেগুলো লাগেজ বা অন্য প্যাকেজে করে আনতে সময় লাগছে কমপক্ষে তিন-চারদিন। যথাযথ তাপমাত্রায় সংরক্ষিত না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত মানও হারিয়ে ফেলছে এসব ভ্যাকসিন।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ভ্যাকসিন সেন্টার, ধানমন্ডি ইবনে সিনা হাসপাতাল, ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং এসব সেন্টারে টিকা নিতে আসা একাধিক নারী জানিয়েছেন, অনেক ঘুরেও ভ্যাকসিনগুলো পাচ্ছেন না তারা। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টিকা না নিয়েই চলে যেতে হচ্ছে তাদের।

ধানমন্ডির বাসিন্দা আসিয়া বেগম বিএসএমএমইউতে এসেছিলেন জরায়ুমুখে ক্যান্সারের ভ্যাকসিন কিনতে। কিন্তু তিনিসহ আরো অনেকেই ভ্যাকসিন না পেয়ে ফিরে গেছেন। আসিয়া বেগম জানালেন, তিন ডোজের ভ্যাকসিনের শেষ ডোজ দেয়ার কথা ছিল গতকাল। কিন্তু সরবরাহ না থাকায় ভ্যাকসিন না নিয়েই ফিরতে হয়েছে তাকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকা সেন্টারে কর্মরত সম্পা দাস বণিক বার্তাকে বলেন, প্রতিদিন ১০-১৫ জন করে গ্রাহক এ দুই ভ্যাকসিন নিতে এসে ফিরে যাচ্ছেন। দুই বছরের বেশি সময় বাজারে ভ্যাকসিন দুটির সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। তবে বিভিন্ন ফার্মেসিতে চোরাই পথে আনা ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে। মেডিকেল প্রতিনিধি ও ফার্মেসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেও এ তথ্যের সত্যতা মিলেছে।

তারা জানান, বাজারে দুই বছর আগেও গর্ডাসিল ভ্যাকসিনের দাম ছিল ২ হাজার টাকা। কোনো কোনো স্থানে এখন তা ৬ হাজার টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, যেসব ফার্মেসিতে এসব ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে, অস্বাভাবিক দামে বিক্রিকে যৌক্তিক করতে গিয়ে গ্রাহকদের হয়রানি করছে তারাও। অনেক সময় ওষুধ থাকলেও বলা হচ্ছে ঘুরে আসতে।

রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবস্থিত বড় একটি ফার্মেসির এক কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে জানান, দীর্ঘদিন ধরে এ দুই ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ। তবে এর চাহিদা রয়েছে অনেক। এ কারণে আমরা বাড়তি লাভের আশায় ভারত ও চীন থেকে এ ভ্যাকসিনগুলো নিয়ে আসি। এর দামও বেশি পড়ে। অনেকেই এসব ভ্যাকসিনের মান নিয়ে প্রশ্ন করেন।

সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশে জরায়ুমুখে ক্যান্সারের ভয়াবহতা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিএসএমএমইউর ভাইরোলজি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, মানহীন ভ্যাকসিন গ্রহণ করে ভালো ফল আশা করা যায় না। সঠিক সময়ে টিকা প্রয়োগ করা না হলে এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। এ টিকা সঠিকভাবে সংরক্ষিত না হলে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকিও দেখা দিতে পারে।

অন্যদিকে বাজারে সংকটের কারণ জানতে চাইলে হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ আলী আল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, এমএসডি নামের একটি মার্কিন কোম্পানি থেকে আমরা এ ভ্যাকসিন আমদানি করি। সারা দেশেই এর চাহিদা প্রচুর। এ চাহিদা সরবরাহ করতে পারছি না। বছরে প্রায় দুই লাখ ডোজ ওষুধের চাহিদা রয়েছে। চাহিদা বেশি থাকায় বিভিন্ন সময় সরকারিভাবে সরবরাহ নিশ্চিতে নানা পরিকল্পনা নেয়া হলেও বাস্তবায়ন করা হয়নি।

চোরাই পথে ভ্যাকসিন আসার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে প্রশাসনের বিশেষ নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে মানহীন ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে অনেক সময় বড় বিপদও আসতে পারে।

সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক রুহুল আমিন বলেন, ভ্যাকসিন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হেলথ কেয়ার লিমিটেড ছাড়াও আন্তর্জাতিক ওষুধ প্রতিষ্ঠান সানোফিকে ভ্যাকসিন আমদানি করতে বলা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে এ ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন