সড়কপথে চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য পরিবহনে প্রাধান্য

মহাসড়কে যানজট বন্দরে পণ্যজট

জেসমিন মলি ও শামীম রাহমান

চট্টগ্রাম বন্দরে গত বছর ৩১ লাখের মতো একক কনটেইনার ওঠানামা হয়েছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরের ৯৪ শতাংশ পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে সড়কপথে, মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। পণ্য পরিবহনে সড়কপথের এই প্রাধান্যে একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হিসেবে খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দেখা দিচ্ছে তীব্র যানজট, তেমনি বন্দরে পণ্যজটেরও অন্যতম কারণ এটি। এমন পরিপ্রেক্ষিতে সড়কপথের ওপর চাপ কমাতে রেলপথে পণ্য পরিবহন ২০ শতাংশে উন্নীত করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে নৌ-পরিবহন সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি দুই থেকে চার লেনে উন্নীতের কাজ শেষ হয় ২০১৭ সালে। মহাসড়কটির যে নকশা করা হয়, তাতে যানবাহন চলাচলের প্রাক্কলন করা হয় দৈনিক ১৬ হাজারের মতো। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের তথ্য বলছে, বর্তমানে সড়কটিতে দিনে গাড়ি চলছে ৩২ হাজারের বেশি। যার ৬৫ শতাংশই আবার ভারী যানবাহন।

অতিরিক্ত গাড়ির চাপে মহাসড়কটি চার লেন হলেও তার কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) তথ্য বলছে, দুই লেন থাকাকালে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে পণ্য পরিবহনে যেখানে ৬-৭ ঘণ্টা সময় লাগত, চার লেন হওয়ার পর সময় লাগছে ১০-১২ ঘণ্টা। কখনো কখনো আরো বেশি।

সড়ক, রেল ও নৌএ তিন পথে পরিবহন করা হয় চট্টগ্রাম বন্দরে আনা-নেয়া পণ্য। রেলের অপ্রতুল অবকাঠামো আর নৌপথে ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহের কারণে সিংহভাগ পণ্যই পরিবহন হয় সড়কপথে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, দেশে যত পণ্য পরিবহন হয়, তার ৮০ শতাংশই হয় সড়কপথে। আর নৌপথে ১৬ ও রেলপথে পরিবহন হচ্ছে ৪ শতাংশ পণ্য। অন্যদিকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরের ৯৪ শতাংশ পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে সড়কপথে। রেলপথে পরিবহন হচ্ছে মাত্র ৬ শতাংশ। মন্ত্রণালয় নৌপথে বন্দরের পণ্য পরিবহনের কোনো তথ্য না দিলেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রায় ১০ শতাংশ পণ্য পরিবহন হচ্ছে নৌপথে।

বন্দরের পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাটি পুরোপুরি সড়কনির্ভর। এতে সড়কের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। যানজটের পাশাপাশি সড়কের আয়ুও কমে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় সড়কের বদলে পণ্য পরিবহনে রেল ও নৌপথকে প্রাধান্য দেয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, উন্নত দেশে পণ্য পরিবহনে রেল ও নৌপথকে গুরুত্ব দেয়। আমরা হাঁটছি উল্টোপথে। সড়কপথের ওপর চাপ কমিয়ে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার সিংহভাগই রেল ও নৌপথনির্ভর হিসেবে গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, সড়কপথের ওপর চাপ কমাতে ট্রেনে মালামাল পরিবহন ২০ শতাংশে উন্নীত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে এখনই বন্দরের ২০ শতাংশ পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা নেই বাংলাদেশ রেলওয়ের।

১৯৮৭ সাল থেকে কনটেইনার পরিবহন শুরু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার কমলাপুর আইসিডির (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) মধ্যে কনটেইনার পরিবহন করছে সংস্থাটি। ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৭ লাখ ৪২ হাজার টন কনটেইনার পরিবহন করেছিল রেলওয়ে। পরের অর্থবছর (২০১৭-১৮) কনটেইনার পরিবহন কমে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৮১ হাজার টনে। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলে ৭ লাখ ৬ হাজার টন কনটেইনার পরিবহন হয়েছে।

রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশের অভ্যন্তরে যত কনটেইনার পরিবহন হয়, তার মাত্র ৪-৫ শতাংশ রেলপথে পরিবহন হচ্ছে। কনটেইনার পরিবহনে রেলপথ মন্ত্রণালয় কনটেইনার কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল) নামে স্বতন্ত্র একটি কোম্পানি গঠন করলেও এখনো আঁতুড়ঘরেই রয়েছে এর কার্যক্রম।

অন্যদিকে নৌপথে বন্দরের পণ্য পরিবহনের জন্য ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিডি) চালু হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহের কারণে এই আইসিডির সক্ষমতার ৩০ শতাংশের বেশি ব্যবহার হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, পরিবহনসায়শ্রী হওয়া সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা নৌপথ ব্যবহারে তেমন আগ্রহী নন। এর প্রধান কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সড়কপথের তুলনায় নৌপথে পরিবহন সময় দুই-তিন গুণ বেশি লাগে।

এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, বন্দরের সিংহভাগ পণ্য সড়কপথ দিয়ে পরিবহন হচ্ছে। এতে সড়কের ওপর চাপ পড়ে যানজট তৈরি হচ্ছে এটা ঠিক। কখনো কখনো বন্দরে যাতায়াত করা ট্রাক কাভার্ড ভ্যানও যানজটে আটকা থাকে। তখন কিছুটা হলেও বন্দরে পণ্যজট তৈরি হয়।

তাত্ক্ষণিকভাবে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নৌপথের ব্যবহার বাড়ানো জরুরি উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, পানগাঁও আইসিডির যা সক্ষমতা, তার ৩০ শতাংশও ব্যবহার হচ্ছে না। এটির শতভাগ ব্যবহার করা গেলে সড়কপথে কিছুটা হলেও চাপ কমবে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে রেলপথে পণ্য পরিবহন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন