চিন্তা-বিচিন্তা

উন্নয়নের শিরদাঁড়ায় কর্মহীনতার হিম স্রোত

রুহিনা ফেরদৌস

ঢাকার রাস্তায় পথচারীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে বিক্রেতার সংখ্যা। যোগ হয়েছে নতুন নতুন ক্ষুদ্র ব্যবসার ধরন। খেয়াল করলে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের চা-কফিসহ দেশী-বিদেশী খাবারের পাশাপাশি টি-শার্ট, শার্ট, ডেনিম বিক্রি করছে তারা। বিক্রেতার সাজ-পোশাক ফুটপাতের অন্য ব্যবসায়ীদের মতো নয়। চেহারা, পরিচ্ছন্নতা, কথা বলার ধরন, পথচারী ক্রেতার কাছে পণ্যের উপস্থাপন ভঙ্গিও খানিকটা ভিন্ন। কথা বলে জানা গেল, তাদের কেউ কেউ এখনো শিক্ষার্থী কিংবা কেউ উচ্চতর ডিগ্রিধারী। পড়াশোনার পাঠ শেষে কাজ খুঁজেছেন, পাননি। সরকারি চাকরির বয়স পেরিয়ে গেছে। দরজা বন্ধ। বেসরকারি পর্যায়েও কাজের সুযোগ হয়নি। হলেও সুবিধা করে উঠতে পারেননি। তাই অনেকে বাধ্য হয়ে, অনেকে স্বাধীন কাজ হিসেবে ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিজেকে যুক্ত করছেন। অনেকে আবার আগে থেকেই শ্রমবাজারের অবস্থা উপলব্ধি করে অযথা সময় নষ্ট না করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে খাতা খুলেছেন।

দেশে প্রায় ৩৭ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার। আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বেকার ৩৪ শতাংশের বেশি। নিজেদের পড়াশোনা শেষ করার পর ছয় মাসের মধ্যে অর্ধেক তরুণ চাকরি পেয়ে যান। ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় ৩০ শতাংশকে। আর দুই বছরের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় ১৮ শতাংশ তরুণকে। বিআইডিএসের পরিসংখ্যানটি বলে দেয় উচ্চশিক্ষা এখন আর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না সবাইকে। উপরন্তু, যত বেশি পড়ালেখা করছেন, তাদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি বাড়ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাবে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার তালিকায় শীর্ষ পাকিস্তানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।

শিরদাঁড়ায় হিম স্রোত বইছে। যে স্রোত কর্মহীনতার, বেকার জীবনের, কাজের সন্ধানে ব্যর্থ হতে থাকা দিনের। বেকারত্বের শীতল স্রোত রুখতে যদি তত্পর উদ্যোগ নেয়া না হয়, তাহলে উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়বে বৈকি। ২০১০ সালের তুলনায় বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে ১২ দশমিক শতাংশ হয়েছে। তাছাড়া তরুণদের বড় অংশ নিষ্ক্রিয়। তারা কোনো ধরনের শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত নন। বেকারত্ব আর কর্মসংস্থান ঘিরে বাংলাদেশে বর্তমানে যে সংকটজনক পরিস্থিতি, অতীতে অনেক দেশই এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। কিন্তু কর্মসংস্থানহীনতার গুরুত্ব অনুধাবনপূর্বক চৌকস পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে তারা ওই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সফল হয়েছে।

১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি, চীনে কলেজে ভর্তির হার ছিল মাত্র শতাংশ, অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় যা নেহাত কম। নব্বইয়ের দশকে যা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় শতাংশে। অবস্থায় ১৯৯৯ সালের দিকে দেশটির শিক্ষা বিভাগ কলেজে ভর্তির সংখ্যা বৃদ্ধিতে নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন অনুদান কর্মসূচি চালু করে। এভাবে ২০০৫ সাল নাগাদ শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা বিচারে চীন বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে চলে আসে। দেশটিতে দ্রুত বাড়তে থাকে উচ্চতর ডিগ্রিধারীর সংখ্যা। কিন্তু বিপত্তি বাধে বাড়তি কর্মসংস্থানের চাহিদা মেটাতে গিয়ে। জনগোষ্ঠী তো শিক্ষিত হয়েছে, কিন্তু তারা কি গুণগত মানসম্পন্ন? চীনের নামিদামি কোম্পানিগুলো উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সরকারের কাছে। অনেক কোম্পানিই শিক্ষিত তরুণদের ওপর আস্থা খুঁজে না পেয়ে তাদের নিয়োগ থেকে বিরত থাকে। শিক্ষিত তরুণদের যোগ্যতা দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। চীনে তখন দেখা যেত কোম্পানিগুলো সাধারণ স্নাতক উত্তীর্ণ তরুণদের বদলে ভোকেশনাল ট্রেনিং প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বের হওয়া তরুণদের নিয়োগে উৎসাহিত হচ্ছে। চীনের ওই পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বেকারত্ব পরিস্থিতির মিল রয়েছে।

তবে ওই পরিস্থিতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে, শিক্ষিত তরুণদের কর্মহীনতা ঘোচাতে চীনা প্রশাসন এমন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ পরিকল্পনা তৈরি করে, যার মাধ্যমে তাদের বাস্তব জ্ঞানসম্পন্নের পাশাপাশি প্রশিক্ষিত করে তোলা সম্ভব হয়। চীনের স্থানীয় সরকারগুলো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং সেখানে তরুণ শিক্ষার্থীদের প্রায় ছয় মাসের জন্য ইন্টার্নশিপের সুযোগ দিতে রাজি করায়। ইন্টার্নশিপের সময়টায় শিক্ষার্থীর থাকা-খাওয়ার খরচ বাবদ সরকারের পক্ষ থেকে কিছু অর্থও বরাদ্দ দেয়া হয়। এভাবে দেশটির তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তোলে তারা।

দেখা যেত ইন্টার্নশিপের সময়কাল শেষ হতে না-হতেই বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই অনন্য কর্মকৃতির জন্য ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। ২০০৬ সালে চীনের ফুজিয়ান প্রদেশে ৫৮টি প্রতিষ্ঠানে প্রায় হাজার গ্র্যাজুয়েট ইন্টার্নশিপ করে, অর্ধেকেরও বেশির সেখানে চাকরি হয়ে যায়। দেখা যায়, ইন্টার্নশিপ করা ৫০ শতাংশের চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে এভাবেই। বেকারত্বের সংখ্যা কমানো আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের জন্য চীন সরকারের পাশাপাশি কাজ করেছে কমিউনিটি সংস্থাগুলোও।

বেকারত্বের সংখ্যা হ্রাস আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থান শ্রীলংকার। বাংলাদেশে যেখানে অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান ৯০ শতাংশ, সেখানে শ্রীলংকার ৭০ শতাংশ। পাকিস্তানে হার ৮০ ভারতে ৮৫ শতাংশ।

১৯৯২ সালে শ্রীলংকায় যেখানে বেকারত্বের হার ছিল ১৫ শতাংশ, ২০১২ সালে তা শতাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। নব্বইয়ের দশকে শ্রীলংকায় তরুণ বেকারদের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই ছিল বেশি, যাদের একটা বড় অংশ জড়িত হয়েছিল গৃহযুদ্ধের সঙ্গেও। তবে ২০০৪ সালের সুনামি, ২০০৭ সালের আর্থিক সংকটের অভিঘাত সামলে শ্রীলংকা বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বেকারত্বের হার হ্রাস কাজের সুযোগ তৈরিতে সফল হয়। শুরুটা হয় বেকরত্বের হার জনসংখ্যার অনুপাতে কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে। কৃষিভিত্তিক কর্মসংস্থান থেকে বেরিয়ে শিল্পের ওপর জোর দিয়ে গোটা অর্থনীতির কাঠামো রূপান্তরের উদ্যোগ নেন দেশটির নীতিনির্ধারকরা। মানসম্মত কাজের বিপরীতে মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি জোর দেয়া হয় নারীর কাজের সুযোগ সৃষ্টির ওপর। তাদের কর্মসূচির সুফল পিরামিডের মতো একটি কেন্দ্রে গিয়ে শেষ হয়নি; বরং তা ছিল স্থানিক অঞ্চলভিত্তিক; শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ অঞ্চলেও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জোর দেয়া হয়। 

বাজার উদারীকরণের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পরিকল্পিত সরকারি বিনিয়োগ, শিক্ষা খাতে পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ এবং সিভিল সার্ভিস রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকারি কর্মসংস্থান সৃষ্টির ধারাবাহিকতা ধরে রাখার ওপর জোর দেয় দেশটি। শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়। জোর দেয়া হয় ভোকেশনাল শিক্ষার ওপর। বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় সরকারি খরচে। নির্দিষ্ট কিছু প্রকল্পের ক্ষেত্রে দাতাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ বাজেট জোগাড় করা হয়। এভাবে দেশটি তাদের বেকারত্ব পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

বাংলাদেশের চলমান বেকারত্ব পরিস্থিতির হাল ধরতে চীন কিংবা শ্রীলংকার মতো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের দিকে অগ্রসর হওয়া নিতান্তই জরুরি। চাকরি না পেয়ে অনেকে ছোট ছোট ব্যবসায় নামছেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি নিয়মের আওতায় আনতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি কীভাবে সরকারের ভাণ্ডারে তার সুফল পৌঁছে, ভাবতে হবে সে বিষয়গুলোও। কেননা দীর্ঘ কর্মহীনতার পথ ধরে বিচ্ছৃঙ্খলা, অপরাধ, সহিংসতা বেড়ে যায়। আমাদের উন্নয়নের শিরদাঁড়ায় কর্মহীনতার হিম স্রোত বইছে। প্রতি বছর দেশের শ্রমবাজারে ২২ লাখ তরুণ যোগ হচ্ছে। তরুণদের কথা ভাবতে হবে। অর্জনের আত্মপ্রসাদে ভুগে এসব নিয়ে ভাবতে ভুলে গেলে চলবে না। 

 

লেখক: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন