ইউরোপে জিএসপি সুবিধা

আলোচনার মাধ্যমে জিএসপি সুবিধা ধরে রাখতে সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকতে হবে

ইউরোপে শুল্ক কোটামুক্ত রফতানি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ অস্ত্র বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা পায়। এতে বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্যের রফতানি প্রবৃদ্ধি প্রতিযোগী অন্য দেশগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি। দেশের মোট রফতানির প্রায় ৬২ শতাংশই যায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। তবে জিএসপি সুবিধার বিপরীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নানা সময়ে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ শর্ত বেঁধে দিয়েছে আমাদের। বেশির ভাগ শর্ত পূরণসাপেক্ষেই তাদের বাজারে পণ্য রফতানি করছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি শ্রম আইন অধিকার সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট সুপারিশের মাধ্যমে আবারো বাংলাদেশের ওপর নতুন করে কিছু বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে আগ্রহী ইউরোপীয় কমিশন। ওই সুপারিশ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে জিএসপি প্রত্যাহার করে নেয়ার এক ধরনের হুমকিও রয়েছে তাদের পক্ষ থেকে।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে এবং তার প্রভাব তাত্ক্ষণিক না পড়লেও আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পকে সে ধাক্কা সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি টালমাতাল। আমাদের তৈরি পোশাকের কাঁচামাল আমদানি চূড়ান্ত পণ্য রফতানিতে তার প্রভাব পড়ছে। তেমনি এক অবস্থায় ইউরোপ যদি আমাদের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে, তবে সংশ্লিষ্ট খাত বিপদে পড়বে। কারখানা বন্ধ শ্রমিকের বেকার হওয়ার হার বাড়বে।

অবস্থায় বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতি অনুধাবনপূর্বক আমাদের নীতিনির্ধারক সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কেননা পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের সঙ্গে ইইউর মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর অদৃশ্য চাপেরই নামান্তর। তাছাড়া সম্প্রতি কম্বোডিয়ার ওপর থেকে জিএসপি সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য এক ধরনের অশনিসংকেত। তাই পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে ইইউর উল্লিখিত সুপারিশ, বিশেষ করে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন পদ্ধতি সহজ করা, শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতি গ্রেফতার না করা, পরিদর্শন সক্ষমতা বৃদ্ধি, শিশুশ্রম নিরসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাগুলোর দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে।

যদিও অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা-জিএসপি কিন্তু বাংলাদেশ এককভাবে ভোগ করছে না। ইউরোপের আমদানিকারকরাও এর বড় ধরনের সুবিধাভোগী। জিএসপির আওতায় তারা বরং কম খরচে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে সক্ষম হচ্ছে। তাই এককভাবে বিভিন্ন সুপারিশের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন করে চাপ বৃদ্ধির বিষয়টি কতটা যুক্তিযুক্ত, তা বিশ্লেষণও জরুরি। এটা ঠিক যে আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু আমাদের শিল্পের চাহিদা, শ্রমিকের অবস্থা, বাজার পরিস্থিতি, সামাজিক পরিবেশসব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাছাড়া বাংলাদেশে শ্রম অধিকার চর্চার মান নিশ্চিতে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নও করেছে বাংলাদেশ সরকার।

তাজরীন ফ্যাশনস রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিদেশী ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনার ক্ষেত্রে গার্মেন্ট শিল্পের কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, শ্রমিকদের নিরাপত্তা জোরদার, নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ, শিল্প-কারখানা পরিদর্শন মনিটরিং জোরদারসহ যে শর্ত জুড়ে দিয়েছিল, তা পূরণের পরও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের জন্য জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করা হয়নি। অথচ ভারত তুরস্কের মতো উন্নয়নশীল দেশও পুনর্বিবেচনার আওতায় জিএসপি সুবিধা ফিরে পেয়েছে। অবস্থায় সরকারের শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্বশীলদের যথাযথ যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সার্বিক পরিস্থিতির যৌক্তিকতা দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরতে হবে। বিভিন্ন শর্ত পূরণের পরও যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি সুবিধা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অতিরিক্ত চাপ বৃদ্ধির নেপথ্যে অন্য প্রতিযোগীদের কৌশলগত প্রচারণা কারসাজি আছে কিনা, তা বিবেচনায় নিতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচনা ব্যবসায়িক কৌশল নির্ধারণে আমাদের কৌশলী হতে হবে। জোর দিতে হবে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে। একই সঙ্গে দুর্বলতা বা প্রয়োজনীয় যোগাযোগের ঘাটতির বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা জরুরি।  

২০২১ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বছর তিনেক পর রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপের দেশগুলোয় বিদ্যমান জিএসপি সুবিধা কার্যকর থাকবে না; বরং ইউরোপে রফতানি নীতিমালার শর্ত পরিপালনসাপেক্ষে জিএসপি প্লাসের আওতায় শুল্কমুক্ত কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে স্বল্প শুল্ক পরিশোধে বাংলাদেশী পণ্য রফতানির সুযোগ থাকবে। সেখানেও শ্রম অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা সুশাসন নিশ্চিত করার মতো শর্ত রয়েছে। সেক্ষেত্রে পণ্য রফতানিতে অন্যান্য দেশের মতো স্বাভাবিক হারে শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। ফলে অঞ্চলের বাজারে বাড়তি প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করতে হবে। পণ্যে বৈচিত্র্যকরণ, নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধানের পাশাপাশি পোশাক খাতের উল্লিখিত বিষয়গুলো নিয়ে দ্রুত আলোচনা শুরু করা দরকার। দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে হলেও বাংলাদেশের সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। আর তা নিশ্চিত করতে যেসব শর্ত পরিপালন করতে হবে, তা নিয়েও এখন থেকে কার্যক্রম শুরু করা দরকার। ইউরোপে বাংলাদেশের রফতানির মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশই গার্মেন্ট পণ্য। পরিস্থিতি মোকাবেলায় দায়িত্বশীলদের প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শিথিলতা প্রদর্শন না করে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। শ্রম আইন, পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ কর্মপরিবেশের উন্নতি, শ্রমিকদের জীবন স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নির্ধারণসহ বিভিন্ন বিষয় নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে হবে। সর্বোপরি রফতানির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে তৈরি পোশাক মালিক, বিজিএমইএ, দেশী-বিদেশী উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন