ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা

এক্সপ্রেসওয়েতে বাস-বে, প্রশ্ন উঠেছে নকশা নিয়ে

শামীম রাহমান

দ্রুতগতির গাড়ি চলাচলের জন্য বিশ্বজুড়ে নির্মাণ হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ে। এগুলোর নকশা করা হয় দ্রুতগতির গাড়ি চলাচল উপযোগী করে। গাড়ি চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে দুই পাশে উঁচু ব্যারিয়ার দিয়ে আলাদা করা হয় এক্সপ্রেসওয়ে, যেন মাঝখান দিয়ে কোনো গাড়ি এক্সপ্রেসওয়ের ভেতর ঢুকতে না পারে। এক্সপ্রেসওয়ের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশও। চালুর অপেক্ষায় রয়েছে ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে। কিন্তু উদ্বোধনের প্রাক্কালে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়েটির নকশা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আর এ প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিয়েছে এক্সপ্রেসওয়ের ভেতরে গড়ে ওঠা একাধিক বাস-বে। পাশাপাশি গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ বাসস্ট্যান্ডও। এসব বাসস্ট্যান্ড থেকে তৈরি হতে পারে যানজট। দেখা দিতে পারে বিশৃঙ্খলা।

এক্সপ্রেসওয়ের ধারণার সঙ্গে এসব বাসস্ট্যান্ড সাংঘর্ষিক বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও তা-ই মনে করেন। যদিও প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়েতে বাস-বে করা হয়েছে স্থানীয় মানুষের সুবিধার্থে। এগুলোকে বাস-বের বদলে ইমার্জেন্সি স্টপেজ হিসেবে অভিহিত করতে চাইছেন তারা।

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েটি শুরু হয়েছে ঢাকার যাত্রাবাড়ী ইন্টারসেকশনে। ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক (এন-৮) দিয়ে গিয়ে মিশেছে মাওয়ায়, পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কে। পদ্মা সেতু পার হয়ে এটি চলে গেছে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত। চার লেনের এক্সপ্রেসওয়ের পাশাপাশি ধীরগতির গাড়ি চলার জন্য দুই পাশে রাখা হয়েছে দুটি করে আরো চারটি লেন। এ প্রকল্পে সব মিলিয়ে খরচ পড়ছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। যে কারণে এরই মধ্যে এটি পরিচিতি পেয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়ক হিসেবে। আগামী ৫ মার্চ বা মার্চের প্রথম সপ্তাহে এক্সপ্রেসওয়েটির উদ্বোধন হতে পারে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা।

গতকাল সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে রোড মার্কিংসহ বিভিন্ন সাইন-সিগন্যালের কাজ চলতে দেখা গেছে। একইভাবে চলছে বিভিন্ন বাস-বের নির্মাণকাজও। এক্সপ্রেসওয়েঘেঁষা এসব বাস-বের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন যাত্রী ছাউনিও। তিন-চারটি বাস থামানোর উপযোগী করে একেকটি বাস-বে নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোর কাজও শেষের দিকে। কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এক্সপ্রেসওয়ের ভেতর গড়ে তোলা হচ্ছে এমনই একটি বাস-বে। সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মার্চের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে এক্সপ্রেসওয়েটি উদ্বোধন করা হবে। তার আগেই সম্পন্ন হবে এসব কাজ। এক্সপ্রেসওয়েজুড়ে এ রকম আরো কয়েকটি বাস-বে গড়ে তোলা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা। এক্সপ্রেসওয়েটিতেবৈধ বাসস্ট্যান্ডের চেয়ে অবৈধ বাসস্ট্যান্ডের সংখ্যা আরো বেশি। মোড়ে-বাজারে নিজেদের সুবিধামতো স্থানে অঘোষিত বাসস্ট্যান্ড বানিয়ে ফেলেছে বাসগুলো।

গাড়ি চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক্সপ্রেসওয়েকে দুই পাশে উঁচু ব্যারিয়ার দিয়ে আলাদা করা হয়, যেন মাঝখান দিয়ে কোনো গাড়ি এক্সপ্রেসওয়ের ভেতর ঢুকতে না পারে। ইন্টারসেকশন, মোড়, জনবহুল হাটবাজার, লেভেল ক্রসিংসহ চলাচলের নানা প্রতিবন্ধকতা এড়াতে নির্মাণ করা হয় ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, ওভারপাস। এক্সপ্রেসওয়েগুলোর নকশা করা হয় দ্রুতগতির গাড়ি চলাচল উপযোগী করে।

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের নকশাও করা হয়েছে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। এক্সপ্রেসওয়েটিতে গাড়ি প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য রাখা হয়েছে আটটি পথ। ঢাকার বাবুবাজার, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ, আব্দুল্লাপুর, আব্দুল্লাপুরসংলগ্ন টোলপ্লাজা, শ্রীনগর ফ্লাইওভার ও মুন্সীগঞ্জের মাওয়া মোড়ে রয়েছে এসব প্রবেশ-নির্গমনপথ। আর এক্সপ্রেসওয়ের ভেতরে কিছু দূর পরপর নির্মাণ করা হয়েছে যাত্রী ছাউনিসংবলিত বাস-বে।

এক্সপ্রেসওয়েটির একটা বড় অংশ পড়েছে কেরানীগঞ্জ উপজেলায়। এর নকশা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘ঢাকা থেকে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে। এক্সপ্রেসওয়েতে কখনো বাস-বে বা বাস স্টেশন থাকে না। বাসের স্টেশন থাকলে বাসগুলো আর সেটি দিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলতে পারবে না। রাস্তায় বাস দাঁড়িয়ে থাকলে যান চলাচল ব্যাহত হবে। এটা ভুল নকশায় তৈরি হয়েছে। এ সময় এক্সপ্রেসওয়ের নকশা থেকে বাসস্ট্যান্ডগুলো বাদ দেয়ার অনুরোধ জানান তিনি।

এক্সপ্রেসওয়েতে বাস-বে বা বাসস্ট্যান্ড থাকে নানসরুল হামিদের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হকও। পাশাপাশি তিনি এক্সপ্রেসওয়ের শৃঙ্খলা রক্ষাও জরুরি বলে মত দিয়েছেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চলাচলে শৃঙ্খলা ধরে রাখাটা সবচেয়ে জরুরি। যে যার ইচ্ছামতো যেখানে সেখানে গাড়ি থামাবে, সেটি হতে দেয়া যাবে না। কিন্তু আমাদের দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে এ কাজটিই বেশি হচ্ছে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে যান চলাচলে শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব না হলে সেটি আর পাঁচটা সাধারণ রাস্তার মতোই হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

সরেজমিন ঘুরে এক্সপ্রেসওয়েজুড়ে এ ধরনের নানা বিশৃঙ্খলা চোখে পড়েছে গতকাল। এক্সপ্রেসওয়েটিকে পুরো মহাসড়ক থেকে আলাদা করতে ব্যবহার করা হয়েছে ব্যারিয়ার, যা খুব বেশি উঁচু নয়। ব্যারিয়ার টপকে সহজে এক্সপ্রেসওয়ের ভেতর চলে আসছে মানুষ। সুযোগটি কাজে লাগিয়ে যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করছে রুটটিতে চলাচল করা বেশির ভাগ বাস। কেরানীগঞ্জ জেলখানার সামনে, আব্দুল্লাপুর বাসস্ট্যান্ড, বাঘাইর, কালাকান্দি এলাকায় এক্সপ্রেসওয়েতে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করছে বাসগুলো। স্থানীয়রা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়ের যেসব বাজার, মোড় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পড়েছে, সেখানেই বাস থামিয়ে অবাধে চলছে যাত্রী ওঠা-নামা। পুরো এক্সপ্রেসওয়েতে এ রকম ২৫-৩০টি অবৈধ বাসস্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। এসব এলাকায় ঝুঁকি নিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে পারাপার হচ্ছে পথচারীরাও। এক্সপ্রেসওয়েতে দ্রুতগতির গাড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবাধে ধীরগতির গাড়িও চলতে দেখা গেছে।

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বণিক বার্তাকে তিনি প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরকে সহায়তা করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। মূলত তারাই মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করছে প্রকল্পটি। বাস-বের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তাওহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, প্রথমে এক্সপ্রেসওয়ের নকশায় বাস-বে ছিল না। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সুপারিশে এসব যোগ করা হয়েছে। বিদেশে কিন্তু এক্সপ্রেসওয়েতে বাস-বে হয় না। ইমার্জেন্সি স্টপেজও রাখা হয় না। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর স্থানীয় মানুষের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এক্সপ্রেসওয়েতে বাস-বে যুক্ত করার সুপারিশ করেছিল। আমরা সেটা বাস্তবায়ন করেছি।

অবৈধ বাসস্ট্যান্ড ও ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপারসহ বিভিন্ন বিশৃঙ্খলার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, কোনো পথচারী যেন এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে না পারে, সেজন্য আমরা ব্যারিয়ারের ওপর নেট দেয়ার পরিকল্পনা করছি। পাশাপাশি পথচারী পারাপারের জন্য ১৪টি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। মানুষকে আগে অভ্যস্ত হতে হবে। এখনো এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে থ্রি হুইলারসহ বিভিন্ন ধীরগতির গাড়ি চলছে। এগুলো বন্ধ করতে আমাদের আরো কিছুদিন সময় লাগবে।



এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন