ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের শুরুতে গ্রেফতার হওয়া
যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার পাসপোর্টে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম
ভিসার সিল রয়েছে। সে দেশের ব্যাংকে রয়েছে তার ৩ লাখ রিঙ্গিতের মেয়াদি স্থায়ী আমানত (এফডিআর)। এছাড়া সিঙ্গাপুরে খালেদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এর বাইরে
বিদেশী ব্যাংকেও রয়েছে তার বিপুল পরিমাণ অর্থ, যা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করার প্রমাণ পেয়েছে
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডির জমা দেয়া অভিযোগপত্রে খালেদ মাহমুদ
ভূঁইয়ার ভ্রমণবৃত্তান্ত ও পাসপোর্ট পর্যালোচনার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্থাটির
অনুসন্ধান বলছে, খালেদ মাহমুদের পাসপোর্টে কোনো বিদেশী মুদ্রা এনডোর্সমেন্ট ছাড়াই বহুবার বিদেশ
যাতায়াত করেছেন। তিনি বিদেশে যাওয়ার সময় নগদ বিদেশী মুদ্রা পাচারের উদ্দেশ্যে নিয়ে
যেতেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার
পাসপোর্টের ৩১ পৃষ্ঠায় মালয়েশিয়ার ভিসা রয়েছে, যা ইস্যু করা হয়েছিল ২০১৮ সালের ৪ মে। মেয়াদ শেষ
হবে ২০২১ সালের ৩ মে। ভিসায় ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ‘এমওয়াইএস এমওয়াই টু হোম’, যা মূলত দেশটির সেকেন্ড হোম
ভিসা। এ ভিসা পাওয়ার জন্য মালয়েশিয়ার আরএইচবি ব্যাংকের জহুরবারু শাখায় ৩ লাখ
রিঙ্গিত এফডিআর করেছেন খালেদ। পাশাপাশি একই ব্যাংকের একটি ডেবিট কার্ডও রয়েছে তার।
এফডিআরের এ অর্থ দেশ থেকে অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে তিনি মালয়েশিয়ায় পাচার করেছেন।
শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে বেড়ে ওঠা খালেদ
মাহমুদ ভূঁইয়া ফকিরাপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাবের সভাপতি। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি একসময় ফুটবল
খেলার জন্য বিখ্যাত ছিল। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নানা ধরনের
অপকর্ম শুরু হয় ক্লাবে। বসে জুয়ার আসর। অবৈধ ক্যাসিনোবিরোধী বিশেষ অভিযানের
শুরুতেই গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর খালেদকে গ্রেফতার করে র্যাব। ক্লাবের পাশাপাশি
অভিযান চালানো হয় খালেদের গুলশানের বাসায়ও।
খালেদের গুলশানের বাসা থেকে অস্ত্র, মাদকদ্রব্যের পাশাপাশি নগদ
টাকা ও ছয় দেশের মুদ্রা উদ্ধারের পর অস্ত্র,
মাদক ও মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইনে পৃথক তিনটি মামলা করে
র্যাব। পরবর্তী সময়ে মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইনে করা মামলাটি তদন্ত শুরু করে সিআইডি।
প্রায় পাঁচ মাস অনুসন্ধানের পর অবৈধভাবে ছয় দেশের মুদ্রা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করায়
খালেদের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন আইনে মামলা করে সিআইডি।
মালয়েশিয়ার পাশাপাশি সিঙ্গাপুরেও বিপুল অর্থ
পাচার করেছেন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, সিঙ্গাপুর শহরের জুরাং ইস্ট
এলাকায় মেসার্স অর্পণ ট্রেডার্স পিটিই লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি খুলেছেন তিনি। এ
কোম্পানির মূলধনও বেআইনিভাবে হুন্ডির মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে পাচার করা হয়েছে। খালেদ ও
তার কোম্পানির নামে ব্যাংক হিসাব থাকার প্রমাণ হিসেবে ইউওবি ব্যাংকের ডেবিট কার্ডও
জব্দ করা হয়েছে।
মালয়েশিয়ার আরএইচবি ব্যাংক ও সিঙ্গাপুরের ইউওবি
ব্যাংকের পাশাপাশি থ্যাইল্যান্ডের একটি ব্যাংকেও খালেদের হিসাব থাকার তথ্য উঠে
এসেছে তদন্ত। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে,
থাইল্যান্ডের ব্যংকক ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্টে ২০ লাখ টাকার
সমপরিমাণ থাই বাথ জমা রয়েছে খালেদের। পাশাপাশি ব্যাংকক ব্যাংকে আরো দুটি ডেবিট
কার্ড রয়েছে তার।
যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদের হয়ে বিদেশে অর্থ পাচারের কাজটি করতেন মোহাম্মদ উল্ল্যাহ। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মোহাম্মদ উল্ল্যাহ জানিয়েছেন, ২০১২ সাল থেকে তিনি খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার মালিকানাধীন ভূঁইয়া অ্যান্ড ভূঁইয়া ডেভেলপার লিমিটেড, মেসার্স অর্পণ প্রোপার্টিজ ও অর্ক বিল্ডার্স নামে তিনটি ফার্মের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি আসামি খালেদের নির্দেশে তার অপরাধলব্ধ আয় গ্রহণ করে খালেদের ভাই মাসুদ মাহমুদ ভূঁইয়ার সঙ্গে গিয়ে বেসরকারি এনসিসি ব্যাংকের মতিঝিল শাখা ও ব্র্যাক ব্যাংকের মালিবাগ শাখায় জমা করেছেন। পরবর্তী সময়ে এ টাকা দিয়ে অবৈধভাবে বিদেশী মুদ্রা কিনে তা বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন।
অভিযোগপত্রে সিআইডি উল্লেখ করেছে, তদন্তে আসামি খালেদের
বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে অবৈধ মাদক-অস্ত্র, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবজিসহ সংঘবদ্ধ অপরাধলব্ধ আয় জ্ঞাতসারে স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরের
মাধ্যমে দেশী-বিদেশী মুদ্রায় অবৈধভাবে বিদেশে পাচার ও পাচারের চেষ্টায় জমা রাখার অপরাধ
প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। অভিযোগপত্রে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ছাড়াও অভিযুক্ত করা
হয়েছে তার ভাই মাসুদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও হাসান মাহমুদ ভূঁইয়াকে। এর বাইরে খালেদের
প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হারুন রশিদ,
শাহাদৎ হোসেন উজ্জ্বল ও মোহাম্মদ উল্ল্যাহ খানকে অভিযুক্ত
করা হয়েছে।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার
মোস্তফা কামাল বণিক বার্তাকে বলেন,
দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে প্রাপ্ত তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে
মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইনের মামলায় খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে
অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। নিজ হেফাজতে অবৈধভাবে বিদেশী মুদ্রা রাখার দায়েও তার
বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছে। সেটিরও তদন্তকাজ চলমান রয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকায় কমপক্ষে
১৭টি ক্লাবের নিয়ন্ত্রণ ছিল খালেদের হাতে। এর মধ্যে ১৬টি ক্লাব নিজের লোকজন দিয়ে
আর ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবটি সরাসরি তিনিই পরিচালনা করতেন। প্রতিটি ক্লাব থেকে
প্রতিদিন কমপক্ষে ১ লাখ টাকা করে নিতেন খালেদ। ভারতে পলাতক পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ
সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিকের সঙ্গে সম্পর্কে ভাঙন ধরার পর খালেদের সম্পর্ক গড়ে
ওঠে দুবাইয়ে পলাতক আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে। তার সহযোগিতায় খালেদ
টেন্ডারবাজিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। টেন্ডারবাজির অর্থের ভাগ নিয়মিত
জিসানকে পাঠাতেন খালেদ। কিন্তু ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দুজনের সম্পর্ক খারাপ হলে জিসানের
কাছ থেকে সরে আসেন তিনি।