শিশুরা কি সঙ্গীত ভালোবাসে?

বণিক বার্তা অনলাইন

ওই দেখা যায় চাঁদ মামা হোক আর বিসমিল্লাহ খানের শানাই হোক সব শিশুই সঙ্গীত খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। কখনো কি ভেবে দেখেছেন এসব সঙ্গীতে কী এমন আছে যা শিশুকে আকৃষ্ট করে? শিশুরা কি সঙ্গীতের প্রতি এই আকর্ষণ নিয়েই জন্মায়? আর সঙ্গীত কি তাদের শ্রবণতন্ত্র বা মস্কিষ্কের উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন ব্রিটিশ লেখক ও সঙ্গীত বিষয়ক সাংবাদিক টম সার্ভিস।

শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর গানের প্রভাব নিয়ে কাজ করেন কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. লরেল ট্রেনার। তিনি জানান কীভাবে শিশুরা জন্মের আগেই পরিচিত হয় সঙ্গীতের সঙ্গে। মাতৃগর্ভে যখন ভ্রুণের বয়স ছয় মাস তখন শিশুর শ্রবণতন্ত্র তথা শ্রবণ সম্পর্কিত স্নায়ুতন্ত্র কাজ করতে শুরু করে। গর্ভে থাকতেই শিশু সঙ্গীতের প্রতি সাড়া দিতে শুরু করে। এখানে সঙ্গীত বলতে আসলে বাঁধাধরা কোনো তাল লয় নয়। বরং ছন্দোবদ্ধ নিরবচ্ছিন্ন শব্দের প্রতিই শিশু আকর্ষণ বোধ করে। এ কারণে ছন্দময় ছড়ার প্রতি তারা ভালো সাড়া দেয়।

বাচ্চাদের সঙ্গীতের সঙ্গে সক্রিয় অভিজ্ঞতা নিতে দেখা যায়। যেমন- গানের তালে তালে হেলে দুলে নাচা, তালি দেয়া, ঠোঁট নাড়ানো ইত্যাদি। ড. লরেলের মতে, পুরো শরীর নাড়ানো মতো যথেষ্ট পেশীশক্তি অর্জন করার পরই শিশুরা এমন আচরণ করতে থাকে। এ সময় বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের সঙ্গে যোগ দেয়া। গান শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু গানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়, অর্থাৎ কোনো গানের অনুষ্ঠানে কণ্ঠ মেলায় হাত-পা নাড়ে তারা দ্রুত কথা বলতে শেখে। এরা বেশি হাসিখুশি হয়। সে তুলনায় চুপচাপ গান শোনে এমন শিশুরা ভাষা দক্ষতায় তুলনামূলক পিছিয়ে থাকে।

আগেই বলা হয়েছে, শিশুদের কাছে সঙ্গীতের কোনো জাত নেই। এরকম একটি ধারণা প্রচলিত ছিল যে, মোজার্টের কম্পোজিশন মস্তিষ্ককে শান দিতে অনন্য। কিন্তু এর সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ মেলেনি। বরং কোন সঙ্গীত ব্যক্তির ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে সেটি নির্ভর করবে ওই মুহূর্তে তার মানসিক অবস্থার ওপর। দেখা গেছে, যে গান মানুষ পছন্দ করে ও খুশি হয় সেই গান বাজালে ওই সময় তার চিন্তাশক্তি উদ্দীপিত হয়। । বড়দের মতো শিশুদের মধ্যে সঙ্গীতে পার্থক্য করার ক্ষমতা নেই। এজন্য তারা সব ধরনের সঙ্গীতেই মজে যেতে পারে। 

তবে, বাচ্চারা দ্রুত লয়ের সঙ্গীত বেশি পছন্দ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের হৃদস্পন্দনের সঙ্গে মিলে যায় এমন লয় সম্পন্ন সঙ্গীত শিশুরা পছন্দ করে । শিশুদের হৃদকম্পন প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় অনেক বেশি- মিনিটে ১০০- ১৮০ বার। এছাড়া ছন্দোবদ্ধ সঙ্গীত এবং পুনরাবৃত্তিমূলক সঙ্গীতের প্রতিও তারা বেশ সাড়া দেয়। সুতরাং মোজার্ট, বিসমিল্লাহ এমন সঙ্গীতের কোনো বিশেষত্ব শিশুদের কাছে নেই। অবশ্য এসব সঙ্গীতের মধ্যে কোথাও পছন্দের একটা খুঁজে পেতেও পারে।

২০১৬ সালে লন্ডনে গোল্ডস্মিথস কলেজের মনোবিজ্ঞানীরা গায়ক ও গীতিকার ইমোজেন হ্যাপের সঙ্গে মিলে বাচ্চাদের মেজাজ ভালো একটি সঙ্গীত তৈরির বিষয়ে কাজ করেন।  তারা ২ হাজার ৩০০ জন বাবা-মার ওপর একটি জরিপও করেন । এতে দেখা যায়, শিশুদের হাসিখুশি রাখতে সবচেয়ে বেশি কাজ করে হাঁচি (৫১%), পশুর ডাক (২৩%) এবং শিশুর খিলখিল হাসি (২৮%)।

ঘুম পাড়ানি গানের ক্ষেত্রে কিন্তু উল্টো ঘটনা ঘটে। এখানে শিশুর মেজাজ চাঙ্গা করার বদলে দমিয়ে দেয়া হয়। এর পেছনের রহস্য লুকানো আছে এসব গান ও ছড়ার গায়কিতে। মজার ব্যাপার হলো বিভিন্ন যুগে ও দেশে এই ঘুম পাড়ানি গান প্রায় একই রকম। পাঁচ হাজার বছর আগের মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় ঘুম পাড়ানি গান যেমন ছিল আধুনিক ইউরোপেও ঠিক তেমনিই। এটি একটি সর্বজনীন সংস্কৃতি।

এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, এসব সঙ্গীতের ধীর লয় এবং সেই সঙ্গে হালকা দুলুনি মস্তিষ্কের ব্যথা শনাক্তকারী অংশটিকে থামিয়ে দেয়, এটি ঘুমের পূর্বপ্রস্তুতি বলা যায়। ড. লরেল বলেন, ঘুম পাড়ানি গান শুধু একটি শ্রবণ অভিজ্ঞতা নয়, এখানে অনেকগুলো সংবেদ কাজ করে। কারণ যখন ঘুম পাড়ানি গান গাওয়া হয় তখন শিশুকে আলতো করে ধরে হালকা দুলুনিও দেয়া হয়। ফলে একাধিক উৎস থেকে পুনরাবৃত্তিমূলক ছন্দ অনুভব করে শিশু। এতে মোড দমে যায়। আর এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়- শিশুরা কিন্তু নিজের মোড পরিবর্তন করতে পারে না। এক্ষেত্রে তাদের পুরোটাই মা বা তাকে লালন পালনকারীর ওপর নির্ভর করতে হয়। তারা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে বা ঘুমানোর প্রয়োজন হয় তখন আরেকজনের সহযোগিতা খুবই জরুরি হয়ে পড়ে।

বিবিসি অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন