উহানে বিপ্লব ও বাণিজ্যের যে ইতিহাস ভুলে গেছে বিশ্ব

বণিক বার্তা অনলাইন

গত ডিসেম্বরে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে সারা বিশ্ব হইচই শুরু হওয়ার আগে মধ্য চীনের শহর উহান সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছুই জানতো না! বিশেষ করে পশ্চিমের বর্তমান প্রজন্ম জানতোই না উহান আসলে কীসের নাম, এটি যদি শহর হয়ে থাকে তাহলে কোথায় অবস্থিত! কিন্তু ইতিহাস বলছে, এ শহরকে পশ্চিমাদেরই সবচেয়ে বেশি চেনার কথা। মাত্র দুই প্রজন্ম আগে ১ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার এ শহর পশ্চিমাদের কাছে একটি ব্যবসা ও বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিল। 

চীনের মধ্যাঞ্চল থেকে ৬০০ মাইল উজানে ইয়াংসি ও হান নদীর সংযোগ স্থলে অবস্থিত উহান। এক সময় এ শহরে ইউরোপের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর কনস্যুলেট ছিল। পশ্চিম ও জাপানের বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক টেক্সটাইল ও প্রকৌশল কোম্পানির কারখানা এবং বিপণন কার্যালয় ছিল এ শহরে। বিভিন্ন দেশের শুল্ক কর্মকর্তা, জাহাজের ক্যাপ্টেন, বাণিজ্য প্রতিনিধি ও কনসালের নিয়মিত পোস্টিং হতো এখানে। শুধু তাই নয়, ১৯১১ সালে চীনের জাতীয়বাদী বিপ্লবের সুতিকাগার বলা যায় এ উহান। এর বছর পঁচিশ পরে চীনা জাতীয়তাবাদিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের রণক্ষেত্রও ছিল উহান। 

উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত উহান বারবার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। কারণ এ শহর ছিল চা, সিল্কসহ আরো বেশ কয়েকটি পণ্য বাণিজ্যের কেন্দ্র। এ বাণিজ্যকেন্দ্র সরাসরি পশ্চিমাদের জীবনে প্রভাব ফেলার অবস্থায় চলে গিয়েছিল। কারণ এ চা তারা পান করতো, তাদের জন্মদিনের কেকে ব্যবহার করতো উহান থেকে আমদানি করা ডিমের পাউডার, আর সিল্ক ব্যবহার করা হতো দামি পোশাকে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পর সংঘটিত কমিউনিস্ট বিপ্লব তথাকথিত ‘বেনু পর্দা’ নামিয়ে দেয়। বন্ধ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্য, বিদেশী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় চীন ছেড়ে চলে যায়, সেই সঙ্গে পশ্চিমাবিশ্ব ভুলে যায় উহানকেও।

আমেরিকার বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘কলিয়ার’ ১৯০০ সালে উহান নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উহানকে ‘ইয়াংসির বুম টাউন’ বলে অভিহিত করে ‘চীনের শিকাগো’ বলে আখ্যা দেয়। পশ্চিমের কোনো গণমাধ্যমে চীনের কোনো শহরকে প্রথম এভাবে বিশেষায়িত করা হয়। ১৯২৭ সালে হুবেই প্রদেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশেষণটি ব্যবহার করেন ইউনাইটেড প্রেসের সাংহাই  প্রতিনিধি র‌্যান্ডাল গৌল্ড। এরপর বিভিন্নি দেশের পত্রপত্রিকায় বিশেষণটি শতশতবার ব্যবহার করা হয়েছে। ওই সময় দলের মধ্যে কমিউনিস্ট মতাদর্শিকদের শায়েস্তা করতে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছিল জাতীয়তাবাদী চিয়াং কাই শেক সরকার। শেষ পর্যন্ত প্রশাসন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

উহানের ইস্পাত কারখানার শ্রমিক

বামপন্থার প্রতি সহমর্মীরা মিলে প্রতিষ্ঠিত করেন উহান ন্যাশনালিস্ট সরকার। আর সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নানজিংয়ে সরকার গঠন করেন চিয়াং কাই শেক। যদিও উহানের এ বিকল্প সরকার টিকে ছিল মাত্র ছয় মাস। কিন্তু তারা চায়নিজ ন্যাশনালিস্ট পার্টির ভেতরের গভীর বিভেদটি স্পষ্ট করে তোলেন। বিদেশী সাংবাদিকরা তখনই চীন প্রজাতন্ত্রের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী বলে মত দিতে শুরু করেন। লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস এবং টোকিও থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রে এ ধারণার প্রতিধ্বনি ওঠে। তখন সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসে উহান।

১৯২৭ সালে চীন সম্পর্কে বিদেশী সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় নীতি প্রভাবিত হয় বেশ কয়েকটি বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কারণে, যাদের অবস্থান ছিল উহানে। এর মধ্যে হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংক (এইচএসবিসি), জন সোয়্যার অ্যান্ড সানস, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো, স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব নিউইয়র্ক, টেক্সাকো এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক অন্যতম। উহান তখন চীনের অন্যতম প্রধান শিল্পকেন্দ্র।  এখানে উৎপাদন হতো লোহা ও ইস্পাত, সিল্প, সুতা। চা ও বিভিন্ন খাবারের প্যাকেজিং ও কৌটাজাত করাও হতো এখানে। আক্ষরিক অর্থেই এটি চীনের শিকাগোতে পরিণত হয়েছিল।

উহান প্রথম পশ্চিমাদের নজরে আসে ১৮৫৮ সালে। দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধের সময় কিং রাজবংশের সঙ্গে ব্রিটিনের অসম চুক্তি যেটি ‘তিয়ানজিন চুক্তি’ নামে সমধিক পরিচিত, স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির ফলেই বিদেশী জাহাজ ইয়াংসি নদীতে প্রবেশের অনুমতি পায় এবং ব্রিটেন হুবেই প্রদেশের প্রায় পুরোটা জলপথ আয়ত্তে নেয়। নদীতীরবর্তি উচাং, হানকু এবং হানিয়াং শহরতিনটিকে তখন একসঙ্গে বলা হতো ‘উহানের নগরত্রয়’। ব্রিটেনের নজর পড়ে এ তিন শহরে। তারা এ শহরগুলো বিদেশী বাণিজ্যের জন্য খুলে দেয়ার আবদার করে।

প্রথম আফিমের যুদ্ধের পর  হংকংয়ে উপনিবেশ স্থাপন করে এবং ইয়াংসি নদীর মুখে সাংহাই বন্দর ব্যবহার করার অধিকার পায় ব্রিটেন। এর ১৬ বছর পর তারা চীনের মূল ভূখণ্ডের গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং নজর পড়ে উহান ও তিয়ানজিনে। উহান হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ বন্দননগরী। এ নগরীই তাদের চা, মাংস, তামাকের মতো খাদ্যপণ্য এবং ইস্পাত ও সিল্কের মতো ব্যবহারিক পণ্যের জোগানদাতা হয়ে ওঠে। উহান তখন চীনের বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বন্দর।

অবশ্য ১৮৫০ সালেই উহান গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ শহরে রূপ নিয়েছে। তখনই উহানের তিন শহরে ১০ লাখ মানুষের বাস। যা তখনকার যুগে বিশ্বের বৃহত্তম শহর লন্ডনের জনসংখ্যার অর্ধেক। ১৮৬০ এর দশকে এখানে বিদেশীদের ঢল নামে, তবে সব সময় এখানে চীনাদেরই সংখ্যাধিক্য ছিল। 

এখানে ব্রিটিশদের পাশাপাশি ছিল জার্মান, ফরাসি, জাপানি, বেলজিয়ান এবং রুশ কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীদের বসবাস। তাদের পাশাপাশি আমেরিকারও কনস্যুলেট ছিল এখানে।

উহান একটি আন্তর্জাতিক শহর হয়ে উঠলেও এটি সব সময় শুধু বাণিজ্য কেন্দ্রই ছিল। কখনোই এ শহর সাংহাইয়ের মতো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি, আর্ট গ্যালারি, প্রকাশনা সংস্থার শহর হয়ে ওঠেনি। বা বেইজিংয়ের মতো বুদ্ধিজীবীদের আনাগোনা হয়নি। বিদেশীদের আনাগোনা ছিল, তাদের কনস্যুলেট পাহারায় থাকতো সশস্ত্র গার্ড। তারপরও এ শহর চীনা রঙ হারায়নি।

১৯৩১ সালে উহানে বন্যার দৃশ্য

১৯১১ সালে যে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের মাধ্যমে চীনের রাজবংশের পতন ঘটে, সেই বিপ্লবের সূত্রপাত বলতে গেলে উহান থেকেই। ভুলক্রমে এক বিদ্রোহীর জ্বলন্ত  সিগারেট বিস্ফোরকের মধ্যে পড়ে গেলে সশব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। পুলিশ এসে ব্যাপক তল্লাশি চালায়। প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা ছাড়া আর বিপ্লবীদের উপায় থাকে না। অবশেষে কিং রাজবংশের ২৬৭ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। নতুন প্রজাতন্ত্রে বিদেশী ব্যবসায়ীদের স্বাগত জানানো হয়। শুরু হয় আধুনিক শিল্প বিস্তার। উহানে গড়ে ওঠে চীনের বেশিরভাগ ভারীশিল্প। এমনকি অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরির কারখানাও ছিল এখানেই। এখানেই তৈরি হতো বিশ্বের অধিকাংশ ঘোড়ার নাল। উনিশ শতকে আধুনিককালের টায়ারের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এটি। মাংস রফতানি হতো উহান থেকে। তাছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকা তখন টুথব্রাশের উদীয়মান বাজার। ব্রাশ তৈরিতে প্রয়োজনীয় শুকরের পশম যেতো উহান থেকেই। তাছাড়া এ শহর ছিল ডিম উৎপাদনের কেন্দ্র। কাঁচা, সংরক্ষিত, গুঁড়ো এবং তরল ডিম যেত সারা বিশ্বের রেস্টুরেন্ট ও বেকারিতে।

বলতে গেলে উহানে উৎপাদিত পণ্যের প্রধান ভোক্তা ছিল ইউরোপ ও আমেরিকা। কিন্তু পশ্চিমে তখন অধিকাংশ ভোক্তা ও ক্রেতার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, চীন কখনোই পশ্চিমা মানের খাদ্য, ইস্পাত ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করতে পারবে না। এই রক্ষণশীল বিশ্বাসের কারণে পণ্য রফতানিতে উহানের ব্যবসায়ীদের নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে হতো। পণ্য কিনতে বেশি দাম দিতে চান না এমন ক্রেতা আকর্ষণে তুলনামূলক কম দামে পণ্য বেচতে হতো। কেউ কেউ সৃজনশীল কৌশল নিতেন। 

১৯১১ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত উহানের ব্যবসায়ীদের এ সমস্যার মধ্যে থেকে ব্যবসা করতে হয়েছে। এ কারণে অনেকে উহানে উৎপাদিত স্টিলে ‘মেড ইন হামবুর্গ’, কাপড় সেলাইয়ের সুচে ‘মেড ইন ইউএসএ’ সিল মারতেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা ইউরোপ আমেরিকার বাইরের ডিম কম মানের বলে মনে করতো। এ কারণে উহানের ডিমের বাক্সে ‘ইংল্যান্ড’ ছাপ মারা থাকতো। এসব সিলছাপ্পর দেখে তারা নিশ্চিন্তে এসব পণ্য কিনতো। এ নিয়ে কখনোই প্রশ্ন ‍ওঠেনি।

মূলত ১৯৩০ এর দশকে জাপান উহানের সুতার মিল, তুলবীজ তেলের কারখানা, শুঁটি প্রক্রিয়াকরণ প্লান্ট ইত্যাদি শিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ শুরু করে। ১৯৩৭ সালের গ্রীষ্মে পূর্ব চীনে আগ্রাসন চালায় জাপান। সাংহাই ও জাতীয়তাবাদী সরকারের রাজধানী নানজিং বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেয়। চিয়াং কাই শেক সরকার বাধ্য হয়ে ইয়াংসি থেকে উহানে চলে আসে, সেখানেই অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করে। তখন উহান আবার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামে উঠে আসে। 

১৯৩৮ সালের অক্টোবরে উহান জাপানিরা দখল করে। শহরের বেশিরভাগ শিল্পকারখানা ধ্বংস হয়ে যায়। রাজধানী সরিয়ে নেয়া হয় চংকিংয়ে। যুদ্ধ শেষে রফতানি ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। কিন্তু সে পরিস্থিতিতেও উহান ইয়াংসির পাশাপাশি চীনের বৃহত্তম শিল্প এলাকা হিসেবে দ্রুতই মাথা তোলে। ১৯৫০ এর দশকে ইয়াংসি নদীর ব্রিজ তিনটি প্রধান জাতীয় রেলসড়কের সঙ্গে উহানকে যুক্ত করে। 

তবে এরপর থেকে বিদেশী ব্যবসায়ীরা সম্পূর্ণরূপে উহার ছাড়েন। কনস্যুলেট ও অন্যান্য ভবন নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। সেই সঙ্গে উহানও চলে যায় পাদপ্রদীপের ছায়ায়। অবশ্য ১৯৮০ এর দশকে আবার প্রাণ ফিরে পায়, বিদেশী ব্যবসায়ীরাও আসতে শুরু করে। উহান ক্রমেই গাড়ি উৎপাদনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। বর্তমানে সেখানে হোন্ডা, সিট্রোন, জেনারেল মোটরসের মতো বড় কোম্পানির কারখানা রয়েছে। ওষুধ কোম্পানি ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির বিকাশেও এ শহর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যদিও ভাইরাস সংক্রমণের আগে কখনোই পত্রিকার প্রথম পাতায় আর উহানের জায়গা হয়নি।

সিএনএন অবলম্বনে জাহাঙ্গীর আলম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন