নির্বাচনের ডামাডোলে মার্কিন শেয়ারবাজার

চলতি বছরটা মার্কিন রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির অর্থনীতির জন্যও বটে। কেবল যুক্তরাষ্ট্র কেন, শীর্ষ অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়ার সুবাদে মার্কিন রাজনীতি ও অর্থনীতি পুরো বিশ্বের জন্যই গুরুত্ববহ। ফলে এ বছরের শেষার্ধের দিকে বিশেষ নজর থাকবে বিভিন্ন দেশের সরকার, নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারী সবারই। কারণ একটাই—৫৯তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৩ নভেম্বর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

আগামী চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউজ কার ঠিকানা হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে নির্বাচনের ডামাডোল এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। রিপাবলিকান পার্টি ও ডেমোক্রেটিক পার্টি তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া ‘প্রাইমারি’ ও ‘ককাস’ শুরু করে দিয়েছে। চির বিবদমান দুই দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুখোমুখি লড়াইয়ে কে নামবেন, তা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় কম উঠছে না। তবে কেবল রাজনীতি বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক কর্মীদেরই নয়, আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ রয়েছে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদেরও।

কিন্তু আসলেই কি শেয়ারবাজারের ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বড় প্রভাব রয়েছে? এ ব্যাপারে ইতিহাস কী বলে? ১৯২৮ সাল-পরবর্তী ২৩টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরে এসঅ্যান্ডপি-৫০০ সূচকের রিটার্ন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কেবল চারবার সূচকটির রিটার্ন ঋণাত্মক হয়েছে। বাকি ১৯ বারই ইতিবাচক রিটার্ন দেখা গেছে।

আসলে শেয়ারবাজারের পারফরম্যান্স ভালো হলে সরকারপ্রধানরা তার জন্য বাহবা পান। আর পারফরম্যান্স খারাপ হলে শোনেন দুয়োধ্বনি। তবে সত্য কথাটা হলো, মার্কিন বাজার ও অর্থনীতির ওপর দেশটির প্রেসিডেন্টের প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা অনেক কম। করহার, ব্যয়নীতি, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণকারী আইন প্রণয়ন—সবকিছুর নেপথ্যে রয়েছে দেশটির আইনসভা কংগ্রেস। তবে অর্থনীতির ওপর প্রেসিডেন্টের ‘পাওয়ার প্র্যাকটিস’-এর সুযোগ যে একেবারেই নেই, তা নয়। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে প্রেসিডেন্ট আইনের ব্যাখ্যা নির্ধারণ করতে পারেন, যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

অর্থাৎ ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও বাজারের গতিপ্রকৃতি কেমন হবে, তা কিছুটা হলেও নির্ভর করছে হোয়াইট হাউজের নিয়ন্ত্রণ কে নিচ্ছেন তার ওপর। ফলে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে মার্কিনরা তাদের প্রেসিডেন্ট বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে বাজার ও অর্থনীতির কল্যাণের বিষয়টি মাথায় রাখবেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে বাণিজ্য শুল্ক আরোপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে বসিয়ে দিয়ে বিশ্ববাণিজ্যে কর্তৃত্ব খাটানোর চেষ্টা করছেন, ভবিষ্যতে তেমন কাউকে ওয়াশিংটন ডিসির মসনদে বসাতে চান কিনা তা মার্কিনদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে বহির্বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে যেন নিজেদের সাজানো ঘর তছনছ হয়ে না যায়, সে কথাটাও মাথায় রাখতে হবে তাদের।


এ তো গেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরের কথা। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার কেমন আচরণ করতে পারে? আগেই বলা হয়েছে, গত ২৩টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরে এসঅ্যান্ডপি-৫০০ সূচকের ঋণাত্মক রিটার্ন হয়েছে চারবার। আর ইতিবাচক রিটার্ন হয়েছে ১৯ বার। সুতরাং অতীত বিশ্লেষণে দেখা যায়, নির্বাচনের বছরটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শেয়ারবাজারের জন্য ভালো যায়।

তবে অতীতের ঘটনাকে ভিত্তি ধরে কোনো উপসংহারে আসাটা বোকামি হবে। কারণ শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় অতীতকে বিবেচনায় নিলেও পুরোপুরি এর ওপর নির্ভরশীল থাকেন না। ফলে বাজারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আচরণ কেমন হবে, অতীত তা পুরোপুরি বলে দিতে পারে না।

অবশ্য অতীতের বাজার আচরণের ওপর ভিত্তি করে দুজন বাজার বিশ্লেষক নির্বাচনের বছরে পুঁজিবাজারে সফল হওয়ার তত্ত্ব বাতলে দিয়েছেন। তাদের একজন মার্শাল নিকলস। পিপারডাইন ইউনিভার্সিটির এ অধ্যাপক ২০১০ সালে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনস অ্যান্ড স্টক মার্কেট সাইকেলস’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এতে তিনি দেখিয়েছেন, একজন প্রেসিডেন্টের মেয়াদের দ্বিতীয় বছরের ১ অক্টোবর শেয়ার কিনলে ও চতুর্থ বছরের ৩১ ডিসেম্বর বিক্রি করলে তা লাভজনক বিনিয়োগ কৌশল হতে পারে। অন্যদিকে স্টক ট্রেডার্স অ্যালমানাকের স্রষ্টা ইয়েল হিরশখ তার ‘প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন সাইকেল থিওরি’তে বলেছেন, প্রেসিডেন্সিয়াল সাইকেলে বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে লাভজনক সময় হলো তৃতীয় বছর। এ তালিকায় এরপর রয়েছে যথাক্রমে চতুর্থ, দ্বিতীয় ও প্রথম বছর।

কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এসব তত্ত্ব সবসময় কার্যকর না-ও হতে পারে। মার্শাল ও ইয়েলের তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রথম বছরের চেয়ে চতুর্থ বছরে রিটার্ন বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু জর্জ ডব্লিউ বুশের মেয়াদের প্রথম বছরে (২০০৫ সাল) যেখানে এসঅ্যান্ডপি-৫০০ বেড়েছে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ, সেখানে চতুর্থ বছরে (২০০৮ সাল) রিটার্ন কমেছে ৩৭ শতাংশ। ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বেশি রিটার্ন পাওয়া গেছে প্রথম দুই বছরে। আর বর্তমান রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে দ্বিতীয় বছরের চেয়ে প্রথম বছরটা পুঁজিবাজারের জন্য বেশি লাভজনক ছিল।

উইকিপিডিয়া ও দ্য ব্যালান্স অবলম্বনে শরিফুল আলম শিমুল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন