টু হুইলারের বাজার

মোটরসাইকেলের ৮০ শতাংশই দেশে উৎপাদন হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

২০১৬ সালে দেশে মোটরসাইকেলের বাজার চাহিদা ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার, যার প্রায় পুরোটাই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। তবে ২০১৭ সাল থেকেই পাল্টে গেছে পুরো চিত্র। গত তিন বছর বাজারটি সম্প্রসারণ হচ্ছে গড়ে ৩০ শতাংশ হারে। বিপণন ছাড়িয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। বাজার চাহিদার ৮০ শতাংশ মোটরসাইকেলই এখন দেশে উৎপাদন হচ্ছে।

দেশের সাতটি প্রতিষ্ঠান এখন সাত ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল উৎপাদন করছে। ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলগুলোর বেশির ভাগ মডেল দেশে উৎপাদন হচ্ছে। তবে হাই ভ্যালু ও কিছু প্রিমিয়াম মডেল সরাসরি বিদেশ থেকে আমদানি হচ্ছে। ভেন্ডর শিল্প গড়ে না ওঠায় বেশকিছু স্পেয়ার পার্টস আমদানি করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএএমএ) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে বাজারে মোটরসাইকেল বিপণনের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭০ হাজারটি, যার প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হতো। দেশে উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কর ছাড় ও কিছু সুবিধাজনক শর্ত দেয়ার পর দেশে উৎপাদন শুরু করে কোম্পানিগুলো। এতে কমে আসে দাম ও বেড়ে যায় বিপণন। ফলে ২০১৭ সালে বিপণনের পরিমাণ ৩ লাখ ৮৮ হাজারে উন্নীত হয়। এটি আরো বেড়ে ২০১৮ সালে ৪ লাখ ৮৭ হাজার এবং ২০১৯ সালে ৫ লাখ ৪৯ হাজারে দাঁড়ায়। গত বছর বিক্রি হওয়া মোটরসাইকেলের প্রায় ৮০ শতাংশ বা প্রায় ৪ লাখ ৪০ হাজারই দেশেই উৎপাদিত। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিক্রি ছাড়িয়েছে প্রায় ৪৩ হাজার। বিপণনকৃত মোটরসাইকেলের ৩২ শতাংশ ১৫০-১৬০ সিসির, ২৪ শতাংশ ১২৫ সিসির, প্রায় ৪২ শতাংশ ৮০-১১০ সিসির এবং প্রায় ২ শতাংশ স্কুটার। সব মিলিয়ে মোটরসাইকেল ও এ-সম্পর্কিত শিল্পের বাজার ৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিবর্তনশীলতা, জনমিতির সুবিধা ও তরুণদের আগ্রহ, রেমিট্যান্সের প্রভাব, সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে মোটরসাইকেলের বাজার দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে। এছাড়া দাম কমে আসার কারণেও চাহিদা বাড়ছে। আর ২০১৭ সাল থেকে মোটরসাইকেল উৎপাদনে শুল্ক কমিয়ে নীতি সুবিধা প্রদানের ফলে দেশে উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

জানা গেছে, দেশে বিপণনকৃত মোটরসাইকেলের ব্র্যান্ডভিত্তিক বাজার দখলে শীর্ষে রয়েছে উত্তরা মোটরসের বাজাজ ব্র্যান্ড। প্রতিষ্ঠানটির বাজার অংশীদারিত্ব প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাজাজের পরই রয়েছে টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেডের টিভিএস ব্র্যান্ড ও হিরো ব্র্যান্ড। এ দুটি ব্র্যান্ডের প্রত্যেকটি ২০-২২ শতাংশ বাজার দখলে রেখেছে। বাকি বাজার জাপানি ব্র্যান্ড হোন্ডা, ইয়ামাহা, সুজুকি ও দেশীয় ব্র্যান্ড রানারের। এর মধ্যে দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে হোন্ডা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল। আর দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে রানার গ্রুপের রানার ব্র্যান্ড গ্রামীণ পর্যায়ে খুব দ্রুত পৌঁছেছে। প্রিমিয়ার ব্র্যান্ড হিসেবে তরুণদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে এসিআই মোটরসের ইয়ামাহা ব্র্যান্ড।

বিএমএএমএর সভাপতি ও উত্তরা মোটরসের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারের নীতি সহায়তার কারণে দেশেই উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই মধ্যে অত্যাধুনিক কারখানা নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে সাতটি প্রতিষ্ঠান। দেশে উৎপাদন বাড়াতে আরো বিনিয়োগ করতে চায় বিদেশী কোম্পানিগুলো। তবে মোটরসাইকেল শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে সহযোগী শিল্পগুলো উন্নত করতে হবে। বিশেষ করে ভেন্ডর বা ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পকে এগিয়ে নিতে হবে। সেখানে নীতি সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া মোটরসাইকেল কিনতে ব্যাংকঋণ প্রদানের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি নীতিসুবিধা দিলে কয়েক বছরের ব্যবধানে বিপণন দ্বিগুণ করা সম্ভব।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে এনবিআরের এক প্রজ্ঞাপনে উৎপাদনকারী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে মোটরসাইকেলের মূল কাঠামোসহ (চেসিস) পাঁচটি প্রধান যন্ত্রাংশের কমপক্ষে একটি দেশে উৎপাদনের শর্ত দেয়া হয়। এছাড়া করছাড়ের বিষয়টিও গুরুত্ব দেয়া হয়। বর্তমানে পুরোপুরি তৈরি মোটরসাইকেল (সিবিইউ) আমদানি করতে প্রায় ১৫০ শতাংশের মতো কর দিতে হয়। ফলে দাম অনেক বেশি পড়ে। কোম্পানিগুলো তাদেরফ্ল্যাগশিপ মডেলের মোটরসাইকেলগুলোই শুধু সিবিইউ অবস্থায় আমদানি করে। সিবিইউর ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে প্রায় ১৫৩ শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হয়। অন্যদিকে সিকেডির ক্ষেত্রে শুল্ক এখন প্রায় ৯০ শতাংশ। আর দেশে উৎপাদিত মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে শুল্ক দিতে হচ্ছে ২৫-৫০ শতাংশ। তবে দেশে উৎপাদিত মোটরসাইকেলের শুল্ক কমায় কোম্পানি দাম সেই অনুপাতেই কমিয়ে দিয়েছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে বিক্রি হওয়া মোটরসাইকেলের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন ও অনান্য খরচ যুক্ত করলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে দাম অনেক বেশি। তাছাড়া এ শিল্পে নেই কোনো দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা। প্রতি বছরই পরিবর্তন করা হচ্ছে নীতিমালা। ফলে বিদেশীরাও এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারছে না। আবার ইঞ্জিন থেকে শুরু করে চেইন, সিট কভার, যন্ত্রাংশের মতো অনেক উপাদানের প্রয়োজন পড়ে। এ কারণে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প গড়ে না উঠলে দেশীয় শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে হিমশিম খেতে হবে।

টিভিএস ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার রায় এ প্রসঙ্গে বলেন, নীতিমালায় নিয়ম-কানুনের বিষয়ে স্থায়ী কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ফলে শিল্পটি যেভাবে সম্প্রসারণ হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হচ্ছে না। দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা করতে হবে। পাশাপাশি ভেন্ডরনির্ভর ও ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প গড়ে তুলতে হবে। তাহলে দেশে মোটরসাইকেল উৎপাদন টেকসই হবে।

দেশে মোটরসাইকেল শিল্পে বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানসহ এশীয় দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার এখনো অনেক কম। ভারতে প্রতি ৩০ জনের বিপরীতে একটি মোটরসাইকেল রয়েছে। আর বাংলাদেশে রয়েছে প্রতি ৯০ জনের বিপরীতে একটি মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল সবচেয়ে সাশ্রয়ী বাহন। গ্রামে বিক্রি যত বাড়ানো সম্ভব হবে, এ যানটির বাজার তত দ্রুত সম্প্রসারণ হবে।

এ বিষয়ে এসিআই মোটরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. ফা হ আনসারী বলেন, দেশের অর্থনীতিকে আরো সম্প্রসারণ করতে হলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও যুবকদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরো গতিশীল রাখতে হবে। সেটি করতে সবার আগে প্রয়োজন মোটরসাইকেল। যে হারে অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে আর তরুণদের মুভমেন্ট করতে হচ্ছে, তাতে বাহনটিকে বিলাসদ্রব্য বিবেচনা করে উচ্চ শুল্ক বসানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। দেশে মোটরসাইকেলের বাজার যে হারে সম্প্রসারণ হওয়া প্রয়োজন সেটি হচ্ছে না। এছাড়া শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চল সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে সে অঞ্চলকে ঘিরে দেশে ভেন্ডর শিল্প দাঁড়াতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন