বাংলাদেশে সড়কে প্রাণহানির উচ্চহার

টেকসই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

বাংলাদেশে বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুহার উচ্চ আয়ের দেশগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ শিশু কর্মক্ষম বয়সের মানুষ বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিশ্বব্যাংক বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিমাণ হ্রাস করতে এবং সড়ক ব্যবস্থা নিরাপদ করতে আগামী দশকে বাংলাদেশকে বিনিয়োগ করতে হবে প্রায় ৭৮০ কোটি মার্কিন ডলার সড়ক দুর্ঘটনা এখন শুধু মানবিক নয়, অর্থনৈতিক সমস্যা হয়েও দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের উচিত এখন সড়ক নিরাপত্তায় বেশি নজর দেয়া অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, জনগণের অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, রাস্তা নির্মাণে ত্রুটি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া প্রভৃতি মূল কারণ বলে চিহ্নিত করা যায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিরাপদ সড়কের গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কে সড়ক নিরাপত্তা দশক হিসেবে ঘোষণা করেছে সময়ের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনার বিষয়ে সদস্য দেশগুলো একমতও হয়েছে এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এরই মধ্যে বহু দেশে সড়ক নিরাপত্তায় দৃশ্যমান অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তত্পরতা দৃশ্যমান নয়

দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির প্রায় ৪৭ শতাংশ পথচারী আমাদের সড়ক-মহাসড়কে স্বল্প খরচে ফুটপাত, জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, ওভারপাস নির্মাণ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব ফুটপাত দখলমুক্ত করে পথচারীর যাতায়াত নিশ্চিত করা গেলে এই বিশাল অর্জন সম্ভব উন্নত বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব পরিকল্পনা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেগুলো খুবই সুনির্দিষ্ট হয় কিন্তু বাংলাদেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন দায়সারা গোছের কত বছরে কী পরিমাণ দুর্ঘটনা প্রাণহানি কমানো হবে, কীভাবে তা অর্জিত হবে, কারা তা সফল করবেএটা স্পষ্ট করা দরকার পরিকল্পনা করে রেখে দিলে বা প্রতিদিন নতুন নতুন প্রতিশ্রুতি দিলে বা রাস্তায় রাস্তায় লিফলেট দিলে দুর্ঘটনা কমে যাবেএটা আশা করা ঠিক নয় আইন প্রয়োগের দুর্বলতা, সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা, চালক-মালিকদের বেপরোয়া মনোভাব খাতকে দিন দিন অনিরাপদ করে তুলছে

নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হবে, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা পাশাপাশি অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য নিরাপদ সড়ক তৈরির স্বল্প, মাঝারি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য এবং বাস্তবায়নের ব্যাপারেও উদ্যোগ নেয়া উচিত এক্ষেত্রে নীতিমালা অনুযায়ী নির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং প্রকল্পগুলোর উন্নয়ন, বাস্তবায়ন মূল্যায়ন পদ্ধতিও নিয়মিতভাবে নজরে রাখতে হবে প্রকল্প উন্নয়নের সময় অবশ্যই স্বচ্ছ উন্নত পদ্ধতি মেনে করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ সড়কের বিষয়সংশ্লিষ্ট প্রকল্পকে সফল করা এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চাইলে শুরুতে সমস্যার গভীরে যেতে হবে

রাস্তায় গাড়ি চালানোর নিয়ম, গাড়িচালকদের লাইসেন্স ইত্যাদি বিষয় উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও রয়েছে ঠিকভাবে তা পালন কিংবা পরীক্ষা করা হয় না তবে গাড়ির গতি, ত্রুটিযুক্ত যানবাহন নিয়ে রাস্তায় নামা, ট্রাফিক নীতিমালা অনুসরণ না করা, দুর্ঘটনা ঘটলে সেটি কর্তৃপক্ষকে না জানানো বিষয়গুলো নজরে রেখে এগিয়ে যাওয়া উচিত এগুলোর মধ্যে অপরাধজনিত বিষয়গুলো যদি গাড়িচালকের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়, তাহলে দ্রুত ড্রাইভিং লাইসেন্স জব্দ করা উচিত এছাড়া চালকদের নিরাপদ সড়ক ট্রাফিক আইনকানুনের প্রশিক্ষণ দিয়ে সেখানে যাতে সবাই বিষয়গুলো ভালোভাবে জানতে পারেন, সে বিষয়ে লক্ষ রাখলে এক্ষেত্রে উন্নতি সম্ভব

সড়ক তৈরির ক্ষেত্রেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশেষভাবে দেখা উচিত নিরাপদ সড়ক তৈরির জন্য সুবিধামতো রাস্তার নকশা করা এবং এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে কাজ করাটা জরুরি মহাসড়কগুলোর পাশে পর্যাপ্ত জায়গা রাখা উচিত, যাতে দ্রুতগতির গাড়িগুলোও নিরাপদে চলতে পারে এছাড়া কম গতির গাড়ি, মোটরবিহীন যানবাহনও যাতে চলতে পারে, সেজন্য ক্লিয়ার জোনও রাখা উচিত আর মহাসড়কের পাশে থাকা ছোট বাজার, মানুষজন রাস্তা পারাপার হয়এমন স্থানগুলোয় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে

মাথায় আঘাত, হূিপণ্ডে আঘাত, প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ার ফলে দুর্ঘটনায় পড়া ব্যক্তির মৃত্যু দ্রুত ঘনিয়ে আসে এসব ক্ষেত্রে দ্রুতগতির জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিশেষ চিকিৎসক দল দরকার, যারা এসব ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুততার সঙ্গে গিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় কাজ করা খুব সহজ নয় এজন্য বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন তবে এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) কার্যক্রম এগোনো যেতে পারে এছাড়া দুর্ঘটনার খবর দ্রুত সেলফোনের মাধ্যমে স্থানীয় পুলিশকে জানানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে এজন্য একটি নির্দিষ্ট ইউনিক টেলিফোন নম্বর থাকতে পারে তবে ব্যবস্থার উন্নয়ন সামগ্রিক নিরাপদ সড়কের ব্যাপারে কাজ করতে চাইলে প্রয়োজন আইনপ্রণেতা, প্রকৌশলী, পরিকল্পনাকারী, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণকারী, ইমার্জেন্সি মেডিকেল সার্ভিস (ইএমএস) দল, পাবলিক হেলথ সার্ভিস, লাইসেন্স এবং এর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সবার যৌথ উদ্যোগ ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে নিরাপদ সড়কের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে এবং তবেই একটি উন্নত দেশ গড়ে তোলা সম্ভব সড়ক নিরাপদ করতে আলাদা বরাদ্দ রাখা এখন সময়ের দাবি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন