দ্রুত বড় হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। ৮ শতাংশ
ছাড়িয়েছে প্রবৃদ্ধির হার। ২০১৯ সালে বাংলাদেশকে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচেয়ে
দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ বলে ঘোষণা দেয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
২০১৯ সালেই নিজের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত কয়েক
দশকে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে
এডিবি। ১৯৬০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশগুলোর অগ্রযাত্রার নানা তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে ‘এশিয়াস জার্নি টু
প্রসপারিটি: পলিসি, মার্কেট অ্যান্ড টেকনোলজি ওভার ফিফটি ইয়ারস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থনীতির এ
উল্লম্ফন একেবারেই সাম্প্রতিক। গত কয়েক দশকে এশিয়ার উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশ যে
গতিতে এগিয়েছে, সে গতিতে এগোতে পারেনি বাংলাদেশ। বিশেষ করে মাথাপিছু জিডিপির পরিসংখ্যান
বিশ্লেষণে বলা যায়, এখনো অনেক পথ পাড়ি দেয়া বাকি বাংলাদেশের।
এডিবির পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৬০ সালেও বাংলাদেশের (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান) মাথাপিছু জিডিপি ছিল এশিয়ার
উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় মাথাপিছু জিডিপির তুলনায় বেশি। সে সময় এশিয়ার উন্নয়নশীল
দেশগুলোর গড় মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ৩৩০ ডলার (ডলারের ২০১০ সালের বিনিময় হার অনুযায়ী)। বাংলাদেশের ছিল ৩৭২ ডলার। কিন্তু এর পরের তিন দশকে অন্যরা
এগিয়েছে তরতর করে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল প্রায় স্থবির, শম্বুকগতির। ১৯৯০ সালের
মধ্যেই উন্নয়নশীল এশিয়ার গড় মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি তখন মোটে ৪০০ ডলার ছাড়িয়েছে।
এ ব্যবধান থেকে গেছে পরের তিন দশকেও। ২০১৮ সালে
বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২০৩ ডলার। উন্নয়নশীল এশিয়ার গড়
মাথাপিছু জিডিপি তখন দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৯০৩ ডলারে। অর্থাত্, ৩ হাজার ৭০০ ডলারের ব্যবধান
রয়ে গেছে এখনো। এখনো বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড়
মাথাপিছু জিডিপির এক-চতুর্থাংশেরও কম।
এ ছয় দশকে দেশের মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে প্রায়
সোয়া তিন গুণ। যেখানে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ
বেড়েছে প্রায় ১৫ গুণ।
বর্তমানে মাথাপিছু জিডিপির দিক থেকে বাংলাদেশের
চেয়ে পিছিয়ে কেবল পাকিস্তান। ১৯৬০ সালে দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ছিল মাত্র ৩০৪
ডলার। বাংলাদেশের চেয়ে ১৯৯০ সালে এদিক থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলেও বর্তমানে আবারো
পিছিয়ে পড়েছে দেশটি। ২০১৮ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ১ হাজার
১৯৭ ডলার।
এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অগ্রযাত্রা সম্পর্কে
প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সময় সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রায় দেশগুলো অনেক দূর এগিয়েছে। অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামোগত রূপান্তর, দারিদ্র্য বিমোচন এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়ন—সবদিক থেকেই দেশগুলোর
পারফরম্যান্স ছিল প্রত্যাশার চেয়েও ভালো। ১৯৬০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এশিয়ার
উন্নয়নশীল দেশগুলোর সার্বিক মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৫ গুণ। অথচ এ
সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ বেড়েছে তিন গুণ। এর ফলে বৈশ্বিক
জিডিপিতে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবদান এ সময় ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪
শতাংশে।
সার্বিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্নয়নশীল এশিয়ার এ
অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। এসব দেশের
অর্থনীতির উল্লম্ফনকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন বিশ্লেষকরা। তবে মোটা দাগে বলা যায়, অর্থনৈতিক সংস্কার, নীতিগত সহায়তা ও পদক্ষেপ, কার্যকর মুদ্রানীতি, শিল্প ও সেবা খাতের গুণগত
রূপান্তর এবং গ্রামীণ ও কৃষি অবকাঠামোয় ব্যাপক বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ এখানে
সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।
১৯৬০ সালে সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৩
হাজার ৫০৩ ডলার। ২০১৮ সালের মধ্যে প্রায় ১৭ গুণ বেড়ে তা দাঁড়ায় ৫৮ হাজার ২৪৮
ডলারে। একই সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু জিডিপি ২৮ গুণ বেড়ে ৯৪৪ ডলার থেকে
দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৭৬২ ডলারে। চাইনিজ তাইপের মাথাপিছু জিডিপি ১৯৬০ সালে ছিল ৯১৯
ডলার। ২৫ গুণের বেশি বেড়ে ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় ২৩ হাজার ১১৩ ডলারে।
এছাড়া এ ছয় দশকে ইন্দোনেশিয়ায় মাথাপিছু জিডিপির
পরিমাণ বেড়েছে ছয় গুণের বেশি। ১৯৬০ সালে দেশটির মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ৬৯০
ডলার। ২০১৮ সাল শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৮৫ ডলারে। মালয়েশিয়ার বেড়েছে প্রায় নয়
গুণ। ১৯৬০ সালের ১ হাজার ৩৫৪ ডলার থেকে বেড়ে ২০১৮ সালে দেশটির মাথাপিছু জিডিপির
পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১০৯ ডলারে।
একই সময়ে থাইল্যান্ডের মাথাপিছু জিডিপি ৫৭১ ডলার
থেকে বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার ৩৬২ ডলার। ১ হাজার ৫৯ থেকে ৩ হাজার ২২ ডলার হয়েছে
ফিলিপাইনের মাথাপিছু জিডিপি।
এডিবি বলছে, এসব দেশের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অর্থনীতির
সাফল্যের পেছনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে কার্যকর রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও প্রাতিষ্ঠানিক
শক্তিমত্তা। বিশেষ করে নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে দূরদর্শিতা, নিজের ও অন্যদের সাফল্য এবং
ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণের সক্ষমতা ও অথনৈতিক পুনর্গঠনে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের
প্রবণতা দেশগুলোকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্মক্ষম জনসংখ্যার
দ্রুতবর্ধনশীলতার কারণে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে’ ভালোভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ। অর্থনৈতিক পরিবেশের
বাহ্যিক ক্ষেত্রেও উন্নত দেশগুলোর মুক্ত বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুবিধাগুলোকেও কাজে
লাগানো সম্ভব হয়েছে। দ্রুত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন সাম্প্রতিক কয়েক দশকে
এসব দেশের অগ্রগতিকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। উপরন্তু স্বল্প আয়ের অর্থনীতির
দেশগুলোকে দ্রুত বাড়ার সুযোগ করে দিয়েছে
‘কনভারজেন্স’
(তুলনামূলক দরিদ্র দেশগুলোর সমৃদ্ধ দেশগুলোর চেয়ে
দ্রুতবর্ধনশীলতার অর্থনৈতিক ধারণা)
প্রক্রিয়া।
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগিয়ে এ সময় অনেক
দূর এগিয়েছে চীন ও ভারত। ১৯৬০ সালেও চীনের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল বাংলাদেশের
প্রায় অর্ধেক, ১৯২ ডলার। ১৯৯০ সালে তা ছিল ৭২৯ ডলারে। দেশটির অর্থনীতির পরের তিন দশকের
উল্লম্ফন বেশ লক্ষণীয়। এ সময়ের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এর ১০ গুণেরও বেশিতে, ৭ হাজার ৭৭৫ ডলারে।
অনেকটা একই ধারার অগ্রগতি দেখিয়েছে ভারত।
প্রতিবেশী দেশটিও ১৯৬০ সালে মাথাপিছু জিডিপির দিক থেকে বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে
ছিল। ১৯৯০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশকে অতিক্রম করে যায় ভারত। বর্তমানে দেশটির
মাথাপিছু জিডিপি ২ হাজার ১০০ ডলারেরও বেশি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কার্যকর বাজার ও রাষ্ট্র
ব্যবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোক্তা গড়ে তোলায় দেশগুলোর
কার্যকর নীতিসহায়তা এ অগ্রযাত্রায় মূল জ্বালানির ভূমিকা রেখেছে। মানবসম্পদ
ব্যবস্থাপনার নিরন্তর উন্নয়ন এসব দেশের বিশাল জনসংখ্যাকে পরিণত করেছে বৃহত্ দক্ষ
শ্রমভাণ্ডারে। অর্থনীতির জ্ঞানভিত্তিক রূপান্তরকে সম্ভব করেছে শিক্ষা ও শ্রম
ব্যবস্থার উন্নয়ন, দক্ষ সমন্বয় সাধন।
এ তালিকার অন্য দেশগুলোর মধ্যে ১৯৬০ সালে
কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান ও ভিয়েতনামের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ নিয়ে কোনো তথ্য পাওয়া
যায়নি। তবে ১৯৯০ সালের পর এই তিন দেশেও মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ বেড়েছে দুই থেকে
চার গুণ।
অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ধীর শিল্পায়ন, কৃষির আধুনিকায়নে পিছিয়ে
পড়া, প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতা, সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব,
অকার্যকর ও বাস্তবতাবিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থাসহ নানাবিধ
সমস্যায় দীর্ঘকাল জর্জরিত ছিল বাংলাদেশ। জ্ঞানভিত্তিক রূপান্তর ঘটেনি অর্থনীতির।
আর্থিক খাতসহ সমাজের নানা স্তরে লুটপাট হয়েছে নানাভাবে। ফলে দেশের অর্থনীতি
এগিয়েছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বর্তমানে এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এলেও এখনো উন্নতির আরো
অনেক মাইলফলক পেরোনো বাকি বাংলাদেশের।
তবে সার্বিকভাবে অনেক ক্ষেত্রে এখনো অনেক
উন্নতির অবকাশ ও প্রয়োজনীয়তা দুটোই রয়েছে বাংলাদেশের। দেশের প্রধান রফতানি খাত তথা
অর্থনীতি এখনো শ্রমনিবিড় পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। শ্রমশক্তির বৃহদংশ এখনো
অদক্ষ। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সুশাসনের দিক থেকে এখনো কাঙ্ক্ষিত অবস্থান অর্জন
করা যায়নি। এছাড়া উন্নতি প্রয়োজন দেশের কৃষি খাতেরও। যথাযথ আধুনিকায়ন না হওয়ায়
বাংলাদেশ কৃষি উত্পাদনশীলতার দিক থেকে এখনো বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় অনেক পিছিয়ে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও টেকসই
প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে এশিয়ার সফল অর্থনীতির দেশগুলো বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে
বরাবরই প্রয়োজনীয় ও কার্যকর নীতি অনুসরণ করে এসেছে। এজন্য দেশগুলো কৃষির
আধুনিকীকরণ ও শিল্প খাতের রূপান্তরকে সুগম করার পাশাপাশি প্রাযুক্তিক উন্নয়নে
সহায়তাদান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। একই সঙ্গে বিনিয়োগের
কার্যকারিতা বাড়াতে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়কে সচল করা ছাড়াও অবকাঠামো উন্নয়ন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে
নির্ভুল নীতির প্রয়োগ এবং দারিদ্র্য বিমোচন ও অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর দিকে জোর
দিয়েছে দেশগুলো।