রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিলম্ব

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের নতুন ইউনিট

নিহাল হাসনাইন

রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘ হচ্ছে। বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। এরই মধ্যে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অনেকেই জড়িয়ে পড়েছে মাদক, হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, মানব পাচার, ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। অনুমতি ছাড়াই করছে সভা-সমাবেশ। এছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বলেও তথ্য আছে গোয়েন্দাদের কাছে। রোহিঙ্গাদের এসব সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে কক্সবাজারে ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) গঠন করেছে পুলিশ।

পুলিশ অধিদপ্তরের সাংগঠনিক কাঠামোয় কক্সবাজার এলাকার নিরাপত্তার জন্য একটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন ১৬) গঠন এবং এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৫৮৮টি পদ সৃজন ও ৪৭টি যানবাহন টিওঅ্যান্ডইভুক্ত করতে চিঠি পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। নবগঠিত ইউনিটের পদগুলোর মধ্যে সাতটি ক্যাডার পদ স্থায়ীভাবে ও অন্য ৫৮১টি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাকে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে চিঠির মাধ্যমে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের জন্য কঠোর নির্দেশনা হচ্ছে, তারা ক্যাম্পের মধ্যেই অবস্থান ও বসবাস করবে। রোহিঙ্গা কোনো নর-নারী বাংলাদেশের কারো সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে ক্যাম্পের মধ্যে জীবনযাপনের নির্দেশনা দেয়া হলেও তাদের ক্যাম্পে আটকে রাখার জন্য কোনো সীমানাপ্রাচীর বা কাঁটাতারের বেড়া নেই। ফলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে তারা, যা দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশে আসার পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৫৮ হাজার ৩৬১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে কক্সবাজার ও বান্দরবানের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়েছে। এসব রোহিঙ্গাকে সহযোগিতা করার অভিযোগে ৫৩৬ জন দালালকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, পুলিশ সদর দপ্তরের ওই চিঠিতে এপিবিএন ১৬ সাংগঠনিক কাঠামোয় মোট ১৫ জন লোকবল নিয়োগ করা হয়েছে। ইউনিটের প্রধান করা হয়েছে একজন পুলিশ সুপারকে (এসপি) তারপর রয়েছেন দুজন অতিরিক্ত এসপি। এ কাঠামোয় এএসপি পদ রাখা রয়েছে চারটি, ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) চারটি। ইন্সপেক্টর (সশস্ত্র) পাঁচটি, এসআই (নিরস্ত্র) ছয়টি। ২৫টি পদ রয়েছে এসআই (সশস্ত্র), সার্জেন্ট দুটি, এএসআই (নিরস্ত্র) ১০টি ও এএসআই (সশস্ত্র) পদ রয়েছে ৫০টি।

এর বাইরে এপিবিএন ১৬-তে নায়েক পদ রয়েছে ২০টি, কনস্টেবল ৪৫০টি, কনস্টেবল (বাবুর্চি) ছয়টি, কনস্টেবল (টেইলর) একটি এবং কনস্টেবল (ইন্ডবিআর) পদ দুটি। এপিবিএনের এই ইউনিটটির জন্য ৪৭টি যানবাহন বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি জিপ, দুটি পিকআপ, ৪০ সিটের একটি বাস, তিন টনের একটি ট্রাক, এপিসি একটি, ওয়াটার ক্যানন একটি ও মোটরসাইকেল ৪০টি।

নতুন এই ইউনিটের ব্যয় পুলিশ অধিদপ্তরের বাজেট-সংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে বহন করা হবে। এজন্য অতিরিক্ত কোনো অর্থ বরাদ্দ দেয়া হবে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পন্ন হলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ১৪ ও ১৬ প্রয়োজন অনুসারে অন্যত্র স্থানান্তর করা হবে। তাছাড়া নতুন জনবল নিয়োগের আগে টিওঅ্যান্ডইভুক্ত যানবাহন ক্রয় করতে পারবে না এপিবিএন ১৬।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, প্রত্যাবাসনের পক্ষে ও বিপক্ষে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গোষ্ঠী অবস্থান নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের হিট পয়েন্ট গ্রুপ, আল-ইয়াকিনসহ কয়েকটি গোষ্ঠী হত্যা, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় ও মাদক চোরাচালানের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এটি দিন দিন বেড়েই চলেছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে তিনটি দল তৈরি হওয়ায় অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। একটি গোষ্ঠী কোনোভাবেই মিয়ানমার ফিরে যেতে আগ্রহী নয়। দ্বিতীয় দলটি অন্য কোনো দেশে অভিবাসী হতে চাচ্ছে এবং অন্য গোষ্ঠীটি পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা পেলে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাচ্ছে। এ নিয়ে গোষ্ঠীগুলোর মতবিরোধের কারণে নতুন অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে।

কক্সবাজারের ক্যাম্পে অবস্থানরত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার জন্য নেই পর্যাপ্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। ক্যাম্পগুলোয় দায়িত্বরত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানান, রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে চলেছে। সে তুলনায় পর্যাপ্ত পুলিশ নেই। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপত্তা ও ক্যাম্পের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ১ হাজার ৫৫০ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে শুধু রোহিঙ্গাদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় ১৪ এপিবিএনের ৫৮৮ জন সদস্য রয়েছেন। এর বাইরে ৯ এপিবিএনের (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) ৩০৭ জন, ৪ এপিবিএনের ৪৩ জন, চট্টগ্রাম রেঞ্জের বিভিন্ন জেলার ৩৫৭ জন এবং বাকি ২২৫ জন পুলিশ সদস্য কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ির।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট ১৬ এপিবিএল প্রধানত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং তাদের চলাচল কেবল ক্যাম্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে কাজ করবে। গত ১৮ ডিসেম্বর ইউনিটটি গঠিত হওয়ার পরই অর্পিত দায়িত্ব পালনে এরই মধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন