কোথায় বাংলাদেশী চলচ্চিত্র হোয়াট আ বিউটি!

সারওয়ার হাবীব

ধর্ষণ নিয়ে পৃথিবীজুড়ে এখন সংগীত আরম্ভ হয়ে গেছে—‘দ্য র্যাপিস্ট ইজ ইউ যদিও মূলকথা এক, সারমর্ম এক কিন্তু ভাষার বহিঃপ্রকাশে যার যার ভাষা, সে সে ভাষাতেই সারমর্মকে উল্লাস করে উদযাপন করে বাঁধভাঙা আন্দোলনে নেমে পড়েছেন, বিশেষ করে নারীরা চিলি থেকে আন্দোলন চিল পাখি হয়ে উড়ে উড়ে পৃথিবীর সর্বত্র আজ প্রতিবাদে মুখর করে তুলেছে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফ্রান্স যখন আন্দোলন ফরাসি ভাষাতেই করছে, সেটা স্প্যানিশ হয়ে যাচ্ছে না জার্মানদেরটা ফরাসি হচ্ছে না ইংরেজদেরটা জার্মান হচ্ছে না এমনকি ভারতীয়দেরটাও ইংরেজদের মতো হচ্ছে না শুধু সারমর্ম ছাড়া প্রত্যেকে স্ব-স্ব ভাষায় একই আন্দোলনের সহযাত্রী হয়েছে একই কাতারে জাতীয়তাবাদটা কেউ ছেড়ে দেয়নি বাংলাদেশের শাহবাগেও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে বাঙালি প্রগতিশীল নারী অংশ, বাংলা ভাষাতেই এটাই জাতীয়তাবোধ

হোয়াট বিউটি!
পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতার আলোকে এক ইতালিয়ানকে বলেছিলাম, তুমি ফরাসি ভাষা পারো? তোমার তো পাশের দেশ তার উত্তর, না, পারি না আমি ঠিক মেলাতে পারি না; হয়তো সে জানে কিংবা না- জেনে থাকতে পারে কিন্তু কখনই বলছে না যে সে অন্যের ভাষাটা পারে ইউরোপের প্রতিটি দেশ ঘেঁষাঘেঁষি করে সহাবস্থানে থেকেও নিজের ভাষাটাকে অন্য সীমারেখার সংস্কৃতির সঙ্গে কখনই মেলাবে না অন্য আরেকটা ভাষা জানতে পারাটা অবশ্যই বুদ্ধিমানের কিন্তু সংস্কৃতির সম্প্রসারণে নিজেরটাই আগে, এখানে বিকল্প বলে কোনো কথা নেই এটাই জাতীয়তাবোধ হোয়াট বিউটি!

সম্প্রতি অস্কারের ৯২তম আসরের সমাপ্তি ঘটেছে সেখানে অন্য বিভাগগুলোর একটি ছিল সেরা আন্তর্জাতিক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পাঁচ দেশের পাঁচটি চলচ্চিত্র মনোনীত হয়েছিল পোল্যান্ড থেকে জন কমাসার করপাস ক্রিস্টি, নর্থ মেসিডোনিয়া থেকে যৌথভাবে দুই নির্মাতা লুজভ তামারার হানিল্যান্ড, ফ্রান্সের লাদি লাইয়ের লা মিজারেবল বলে রাখা ভালো, এটি তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র স্পেন থেকে ছিল পেদ্রো আলমোদোভার নির্মিত পেইন অ্যান্ড গ্লোরি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নির্মাতা বং জুন হো পরিচালিত প্যারাসাইট এটিই অবশ্য জিতে নিয়েছে সেরা ছবির পুরস্কার শুধু তা- নয়, ইতিহাস সৃষ্টি করে এই প্রথম কোনো বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র জিতে নিল ২০১৯ সালের সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার হোয়াট বিউটি!

পুরস্কার কে পেল না-পেল, সেটা আমার চলতি আলোচনার বিষয়বস্তু নয় আলোচনার বিষয় হচ্ছে, পাঁচ দেশের পাঁচ রকম জাতীয়তাবাদী বিশ্বাসকে তারা কীভাবে পাঁচজন আলাদা আলাদাভাবে সঠিক মানদণ্ডে সমান করে স্থায়িত্ব দান করেছেন করপাস ক্রিস্টি দেখলে সেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না হানিল্যান্ড অথবা লা মিজারেবল অন্যদিকে পেইন অ্যান্ড গ্লোরির সঙ্গে কখনই মেলানো যাবে না প্যারাসাইটকে প্রতিটি চলচ্চিত্রের গঠন প্রণালি, ভাষা, পারফরমার, পারফরম্যান্স কিংবা স্বদেশী অবকাঠামো অথবা শব্দ সংযোজন, গান এমনকি ভায়োলেন্স সবকিছুই আলাদা-স্বতন্ত্র পাঁচ রকম জাতীয়তাবাদী বিশ্বাসকে পাঁচজন নির্মাতা আলাদা আলাদাভাবে সঠিক মানদণ্ডে তুলে ধরেছেন নিজেদের আইডেন্টিটিকে স্ব-স্ব অবস্থানে নিয়ে গেছেন কারো সঙ্গে কারোর মিল নেই মিল শুধু একটা জায়গাতেইইন্টারপ্রেটেশনের মাধ্যমটা চলচ্চিত্র হোয়াট বিউটি!

এবার আমার, আমাদের সবার প্রাণের বাংলাদেশ দেশী অন্য যত শিল্পমাধ্যম আছে, সেগুলো আমার আলোচনায় স্থান পাবে না বাংলা চলচ্চিত্র এর ইন্ডাস্ট্রি ঘিরে এগিয়ে যাবে বয়ান

আলোচনার প্রসঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তানের চলচ্চিত্রের কথা একটু বলতে চাই আফগানিস্তানের চলচ্চিত্র ওসামা দেখলেও বুঝতে সমস্যা হয় না যে কীভাবে একটা দেশ পর্দায় উঠে এসে নিজেদের গল্পটা বলে যায় সেখানকার মানুষ, ভাষা, অবকাঠামো, রঙ, হেরে যাওয়ার গল্প অথবা বিজয়ের আনন্দ, গান, শব্দ, হাসি-কান্না কীভাবে জায়গা করে নেয় পর্দায় আর অন্যান্য ভাষার মানুষ তাকে কীভাবে গ্রহণ করে ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র বহির্বিশ্বে বিভিন্ন উৎসবে পুরস্কারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভাগে গোল্ডেন গ্লোব পর্যন্ত জয় করে নেয় অন্যদিকে আর্থিক দিক দিয়েও সফল, মাত্র ৪৬ হাজার ডলার বাজেটের চলচ্চিত্র মিলিয়ন ডলার বাগিয়ে নেয় বক্স অফিসে হোয়াট বিউটি!

প্রবল আইডেন্টিটির গুরুত্ব বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে কমবেশি যারা জড়িত, তাদের কাছে কীভাবে পৌঁছাবে? সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্র দেখা হয়, পৃথিবীর মানচিত্র ভেসে আসে পর্দায় অথচ যখন মুহূর্তে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দেখতে বসি তখন কেমন করে যেন দেশের সিনেমায় বাংলাদেশকে পাই না স্বর্ণালি যুগের রূপকথার গল্প এখানে বলে স্বভাবতই কোনো লাভ নেই আমাকে বলতে হবে সময়ের কথা চলচ্চিত্রে সত্যিই প্রিয় বাংলাদেশকে দেখি না বাংলাদেশের মানুষ, ভাষা, অবকাঠামো, রঙ, হেরে যাওয়ার গল্প অথবা বিজয়ের আনন্দ, গান, শব্দ, হাসি-কান্নাএসব বাংলার মতো করে থাকে না চলচ্চিত্রে যখন সুধীজনের সঙ্গে আলোচনায় বসি, অনেকেই বলেন, বাংলা চলচ্চিত্র দিয়ে কিছু হবে না প্রত্যুত্তরে আমাকে বলতে হয়, যেদিন আবারো সত্যিকারের বাংলা ভেসে আসবে রঙিন পর্দায়, সাদা-কালো বাঙালি জীবনদর্শন, আর যদি নিজস্ব আইডেন্টিটিকে স্থায়িত্ব দেয়া যায়, মানুষ আবার সেদিন চলচ্চিত্র উপভোগ করতে প্রেক্ষাগৃহে ফিরবে সাধারণ মানুষ আজ দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলেছে তার গল্পটা সে তার অবচেতন মনে দেখতে পাচ্ছে না গল্পটা তাকে শোনাতে হবে, বোঝাতে হবেএটাই তোমার জীবন এভাবেই তুমি ভাষা প্রকাশ করো, অবকাঠামো তৈরিতে মাতো, রঙ দিয়ে নিজেকে মাখো, হেরে যাওয়ার গল্প অথবা বিজয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করো, পেটে ক্ষুধা নিয়ে গান করো, শব্দ করে বিপ্লব করো, হাসি-কান্না দিয়ে প্রিয়তমার কাছে পৌঁছে যাও, সেখানে থাকে একরাশ লুকানো লজ্জা আর গুছিয়ে রাখা আদর-ভালোবাসা এসব যেদিন আবার বাংলার মতো করে ফিরে আসবে চলচ্চিত্রে, সেদিন পুনরায় ফিরে আসবে বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ স্বর্ণিল সন্ধ্যায় ভালোবেসে পেছনে গান বাজতে থাকবে—‘দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয় ধর্ম অনেকেই বিশ্বাস করে না, এটা সত্যি কিন্তু তাদের অনেকের মধ্যে বিশ্বাসটা এমনভাবে সততার সঙ্গে কাজ করে যে প্রার্থনা ঠিকমতো করলে ঈশ্বরেরও সান্নিধ্য মেলে প্রার্থনা চলচ্চিত্রে আজ হচ্ছে না বহু বছর বর্তমান বাংলদেশের ৯৯ শতাংশ চলচ্চিত্র পরিচয়হীন সন্তানের মতো মা সত্যিকার অর্থে জানেনই না সন্তানের পিতা কে? লেখনীর জায়গাটায় আমি বলতে পারছি নাহোয়াট বিউটি! এখানে আমি লজ্জিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সবকিছু নষ্টের অধিকারে চলে গেছে জানিয়ে দিলাম আবার নতুন করে নষ্টের পরিশোধন প্রয়োজন ধরেই নিলাম বিশ্বচলচ্চিত্রের মহাসাগরে আমাদের যাওয়ার দরকার নেই আপাতত আমাদের শতাংশে ছিলেন অনেকের মধ্যে একজন আলমগীর কবির গল্পগুলো এভাবেই গাঁথতেন তিনি—‘আমি একদিন পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম প্রদীপকে এয়ারফোর্সের পাইলট ছিল বাংলাদেশের যুদ্ধে ওর একদিন ডাক এসেছিল কয়েক দিন পর খবর এল, ঢাকার যুদ্ধে প্রদীপ মারা গেছে সারা ভারত-বাংলাদেশ যখন জয়ের আনন্দে মত্ত, আমি তখন নিজেকে ঘৃণা করেছি বাংলাদেশকে ঘৃণা করেছি আমার চোখেও ঘুম ছিল না আমি থাকতে না পেরে চলে এসেছি দেখতে, জানতেবাংলাদেশ কী এমন জিনিস! যার জন্য আমাকে চিরকাল দগ্ধে দগ্ধে মরতে হবে আর যেন মেঘনার বুকে ভাসতে ভাসতে উত্তর পেলাম; হঠাৎ যেন মনে হলো, দেশের মুক্তির জন্য যেকোনো মূল্য দেয়া যায় মেঘনা আমায় নতুন করে বাঁচতে শেখাল সমিত-দা

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যারা এখন প্রথম সারির মহাকাণ্ডারি হিসেবে প্রাণহীন মূর্তির মতো বর্তমান হয়ে আছেন, তাদের জানিয়ে দিলাম আবার নতুন করেআমরা এই এভাবেই অভ্যস্ত ইউ গাইজ হ্যাভ টু আন্ডারস্ট্যান্ড দিস লাইনস অন টপ অ্যান্ড অ্যাডমিট হোয়াট বিউটি!

এসব রস আচ্ছাদন না করে আমাদের গল্পগুলো আজ ভুল পথে এগিয়ে যাচ্ছে একটা অপরিচিত পথে আমরা বহুদিন ধরে হাঁটছি এজন্যই আমাদের গল্পগুলো বলা হচ্ছে না বাংলাদেশকে ধারণ করা যাচ্ছে না পর্দায় অথচ এখনই সময় আমাদের গল্পগুলো বলতে পারার অভিপ্রায় জানানো যদি পুরোটা গল্প আমাদের হয়, ছোট আকারেই হয়, তাহলে মানুষ সেই গল্প শুনবে শুনতে বাধ্য করবে নিজেদের নতুনরা, আগন্তুকরা নতুন শিল্পের সন্ধানে সানন্দে গ্রহণ করবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকেপ্যারাসাইট বিজয়ী হওয়ার সময় যেভাবে হলভর্তি দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করে, ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের সিনেমাও সেই আইডেন্টিটি স্থায়িত্বের মধ্যে যখন নিজেদের দাঁড় করিয়ে ফেলবে, সেদিন বিভিন্ন বর্ণের মানুষ হলভর্তি দর্শক হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করবে, হাততালি দিতে দিতে বলবেহোয়াট বিউটি!

ফিরে আসি কথার শুরুতে

দ্য র্যাপিস্ট ইজ ইউ’—বিভিন্ন ভাষায় প্রতিবাদ চলছে বিশ্বজুড়ে গল্পের থিম কিন্তু একই ধর্ষণকে রুখে দিতে হবে! পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষায় চলচ্চিত্র আন্দোলনে নিজেদের সেই কাতারে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে হবে আমাদের হাসি-কান্নায় গল্পের থিমটাও একই হতে পারে কাকতালীয়ভাবে কোনো সমস্যা নেই তাতে কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রটা বানাতে হবে আমাদের গল্পটাকে গল্পের মতো করে তুলে আনতে হবে এবং অবশ্যই বাংলায় তাহলে কোথায় লুকিয়ে আছে আমাদের সেই গল্প? আছে, আমাদের গল্পের নায়ক সারা দিন রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনার যে দুরবস্থা, সেই প্রতিবাদ অনেকাংশে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর বাকিটা আবার আগামীকাল থেকে শুরু করবে যখন মনস্থ করে আর দুপুরের খাবারটা খেতে ভুলে যায় অন্যদিকে তাকে কাছে না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় প্রিয়তমা চোখে কাজল দিয়ে কষ্টের জল ঢাকার চেষ্টায় মত্ত হয়ে আছে বিজয়ের আনন্দ প্রত্যাশায় আমাদের নায়কের হঠাৎ মনে পড়ে যাবেতাকে তো দেখা হয়নি বাংলাকে তো দেখা হয়নি ক্ষুধা পেটে নিয়েই আন্দোলন বিরতির ফাঁকে নায়ক দরজায় কড়া নাড়বে নাড়লেই ওপাশ থেকে খিল খুলে দিয়ে কপালের লাল টিপে, হয়তোবা সবুজ শাড়িতে প্রিয়তমা অভিমানে মুখ ফিরিয়ে থাকবে আর নায়ক তার মুখ উঁচিয়ে লজ্জা ভাঙিয়ে দিয়ে বলবেহোয়াট বিউটি! এটাই আমাদের বাংলাদেশের গল্প

আমাদের গল্প-ছবির সংখ্যাটা বাড়ুক বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে উন্মুক্ত হোক বাংলাদেশের চলচ্চিত্র মানুষ বলুক এবং বলতে শিখুকহোয়াট বিউটি!

লেখক: স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন