[পূর্ব প্রকাশের পর]
গাউসের
জন্ম জার্মানিতে ৩০ এপ্রিল, ১৭৭৭ সালে, মৃত্যু ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৫। জন্ম অতি সাধারণ পরিবারে। পিতা ব্রিক লেয়ার ঘরবাড়িতে ইট বসানোর কাজ করতেন। মা লেখাপড়া জানতেন না, তাই জন্মতারিখের কোনো হিসাব রাখেননি। গাউস নিজেই বড় হয়ে অংক কষে বের করেছিলেন নিজের জন্মতারিখ। গাউস অংক করতে শিখেছিলেন অক্ষর জ্ঞান হওয়ার আগেই। যাকে বলে শিশুপ্রতিভা, গাউস ঠিক তা-ই। তাকে নিয়ে অনেক গল্পকথা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটা হলো, তিন বছর বয়সেই শিশু গাউস বাবার হিসাব খাতার ভুল ধরেছিলেন। আরেকটা তার প্রাইমারি স্কুল নিয়ে। কাহিনীটা এ রকম যে, প্রাইমারি স্কুলের এক শিক্ষক ক্লাসে এসে ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত যোগ করতে বললেন। শিক্ষক হয়তো ভেবেছিলেন ছাত্রদের ব্যস্ত রেখে সে সময়ে অন্য কোনো কাজ করবেন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে একজন বলল, আমার হয়ে গেছে। উত্তর ৫০৫০। সেই ছাত্র হলো গাউস। বয়স মাত্র সাত বছর। গাউস পুরোটাই করলেন মাথায়। সংখ্যাগুলোকে উল্টো করে সাজালেন। যোগ করলেন, ভাগ করলেন। নিচে প্রক্রিয়াটা দেখানো হলো:
১
+ ২ + ৩.......... + ৯৯
+ ১০০
১০০
+ ৯৯ .......... + ১ + ২ + ৩
----------------------------------
যোগ করে: ১০১ + ১০১ + ১০১
+ ............ + ১০১ = ১০১ ^ ১০০ = ১০১০০
ভাগ করে: ১০১০০ ÷ ২ = ৫০৫০
গাউসের
মা
লেখাপড়া না জানলেও বুঝতে পেরেছিলেন তার এই ছেলে বিশেষ কিছু। পিতার আপত্তি সত্ত্বেও গাউসকে তাদের পারিবারিক কাজের প্রশিক্ষণ, মানে ইট বসানোর কাজ শিক্ষা থেকে বিরত রাখা হলো। লেখাপড়ার টাকা জোগাড় করা হলো নানাভাবে। কিছু বৃত্তিপ্রাপ্তির সুবাদে সম্ভব হলো গোয়েটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার। সেখানেই কাটালেন সারা জীবন।
গাউস
গণিতের সব শাখায় অবদান রেখেছেন। তার পর আর কেউ একসঙ্গে এত বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারেননি। গাউস ও তার সমসাময়িক ওগুস্তা লুই কোশিকে (১৭৪৯-১৮৫৭) বলা হয় গণিতের সর্বশেষ অলরাউন্ডার, যাদের গণিতের সব শাখায় দক্ষতা ছিল। গাউস শুধু গণিত নয়, পদার্থবিজ্ঞানেও চিরস্থায়ী অবদান রেখে গেছেন। বিশেষ করে তার সহকর্মী ভিলহেম ভেবেরকে (১৮০৪-১৮৯১) সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছেন পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র পরিমাপণে। চৌম্বকত্ব পরিমাপণের ইউনিটকে তার নাম অনুসারেই ‘গাউস’ বলা হয়। এছাড়া ভেবেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন প্রথম বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ।
গণিতশাস্ত্রে
কিছুদূর এগোলেই গাউস নামটা বারবার হাজির হওয়া শুরু করে। মডুলার পাটিগণিত হিসেবে গণিতের যে ধারা, তা গাউসের মাধ্যমেই সুসংবদ্ধ রূপ লাভ করে। মডুলার পাটিগণিত বর্তমানে ক্রিপ্টোগ্রাফি বা তথ্যগুপ্তি বিদ্যার অবিচ্ছেদ অংশ। তথ্যগুপ্তি বিদ্যা পাটিগণিতের আরেকটা মূল সূত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সূত্রটি হলো, যেকোনো যৌগিক সংখ্যাকে মৌলিক সংখ্যার গুণফল হিসেবে এবং শুধু এক রকম ভাবেই দেখানো যাবে। একটি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটা দেখানো যাক:
৪=২×২
৬=২×৩
৮=২×২×২
১০=২×৫
১২=২×২×৩
উপরে
দেখুন প্রত্যেকটি যৌগিক সংখ্যা মৌলিক সংখ্যার মাধ্যমে নির্মিত হচ্ছে ও এ নির্মাণের প্রত্যেকটিই আলাদা। পাটিগণিতের এ মূল সূত্রের প্রমাণ ইউক্লিডের এলিমেন্টসে আছে, তবে এর আধুনিক প্রমাণ এসেছে গাউসের মাধ্যমে। আপাতত সূত্রটাকে খুব সাধারণ মনে হলেও এ মূল সূত্রের প্রমাণ অতি জরুরি ক্রিপ্টোগ্রাফির জন্য।
গাউসের
হাত ধরে এসেছে বীজগণিতের মৌলিক তত্ত্বও, যা বীজগণিতীয় সমীকরণের সমাধানের সঙ্গে জটিল সংখ্যার (কমপ্লেক্স নাম্বার) সম্পর্ক প্রকাশ করছে। জটিল সংখ্যাকে a+bi আকারে প্রকাশ ঘটেছে গাউসের মাধ্যমে। গাউসের আরো অনেক অবদান আছে, যা বোঝা ও প্রকাশ করা আমার সাধ্যের বাইরে। তাই এ নিয়ে বেশি কথা না বলে আমার নিজের যে পেশা অর্থনীতি, সে-সম্পর্কিত বিষয়ে গাউসের অবদান নিয়ে খানিকটা আলোকপাত করব।
অর্থনীতির
ছাত্রদের অবশ্যপাঠ্য বিষয় হলো ইকোনমেট্রিকস, যাকে বাংলায় অর্থমিতি বলা হয়। এর কাজ হলো ডাটা অর্থাৎ উপাত্ত বিশ্লেষণ করা। মনে করি, আমাদের কাছে আয় ও ব্যয়ের উপাত্ত আছে। আয়ের সবটুকুই মানুষ ব্যয় করে না। কিছুটা সঞ্চয়ও করে। মনে করি, আয় হলো X ও ব্যয় হলো Y।
আয়
ব্যয় যদি সমান হয় তাহলে হবে Y=X, কিন্তু তা ঘটছে না, বরং আয়ের একটি অংশ ধরা যাক b অংশ ব্যয় হচ্ছে, অর্থাৎ Y=bX।
উদাহরণস্বরূপ মনে করি, আয় হলো ১৫০ টাকা। আয়ের ৯০ শতাংশ ব্যয় হয়। মানে b = ০.৯।
তাই ব্যয় হলো ০.৯ ^ ১৫০ = ১৩৫। আমরা আয় ব্যয়ের সম্পর্ক আগে থেকেই জানি বলে ১৩৫ টাকা খরচ হবে জানতে পেরেছি। কীভাবে আমরা জানলাম যে আয়ের ৯০ ভাগ ব্যয় হবে? এর জন্য আমাদের দরকার হবে আয় ব্যয়ের কিছু উপাত্ত এবং সে উপাত্তগুলো ব্যবহার করে আয়-ব্যয়ের সম্পর্কের পরিমিতিগুলো বের করা যাবে। অর্থনীতির ছাত্রদের এজন্য যে পদ্ধতিটা সবার আগে শিখতে হয় তার নাম লিস্ট স্কয়ার মেথড বা ক্ষুদ্রতম বর্গ পদ্ধতি। এ পদ্ধতি উদ্ভাবনের কৃতিত্ব মূলত গাউসের। এ রকম একটি পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমেই গাউস সেরেস নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রহের কক্ষপথ বের করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে পড়েছিলেন। সে সময়ে গাউসের বয়স ছিল ২৪ বছর। গাউস লিস্ট স্কয়ার ছাড়াও ম্যাক্সিমাম লাইকলিহুড মেথড নামে আরেকটি পদ্ধতি উদ্ভাবনের কৃতিত্বেরও দাবিদার।
পরিসংখ্যানের
একটি জরুরি ধারণা হলো, নরমাল প্রবাবিলিটি ডিস্ট্রিবিউশন বা নরমাল সম্ভাবনা বিন্যাস। এ ধারণার সঙ্গে মাধ্যমিক ও তার থেকে উচ্চতর পর্যায়ে পরিসংখ্যান করেছেন এমন সবাই মোটামুটি পরিচিত। অর্থনীতির উপাত্ত বিশ্লেষণে প্রতি মুহূর্তেই নরমাল ডিস্ট্রিবিউশনের কথা চলে আসে। এ বিন্যাস উদ্ভাবনের কৃতিত্বও মূলত গাউসের। এজন্য নরমাল বিন্যাসকে গাউসীয় বিন্যাসও বলা হয়। উচ্চতর পরিসংখ্যানে নরমালের চেয়ে গাউসীয় শব্দটাই বেশি দেখা যায়।
মোটের
ওপর গণিতের সব জায়গাতেই গাউসের বিচরণ। অনেকেই হয়তো তার নাম আগে শোনেননি কিন্তু গাউস উদ্ভাবিত গণিতের সঙ্গে সবাই কমবেশি পরিচিত। গাউস তাই সত্যিকার অর্থেই ‘অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ’। শুধু একটা জায়গায় তার অবস্থান প্রশ্নসাপেক্ষ, তাহলো নন-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি। এ জায়গায় এসে আমরা আমাদের অতি বড় বৃদ্ধ পতির চরিত্রের মন্দ দিকটা দেখব।
গণিতের
প্রমাণের ক্ষেত্রে গাউস ছিলেন খুঁতখুঁতে স্বভাবের। মনঃপূত না হলে তিনি গণিতের ধারণাগুলো প্রকাশ করতে চাইতেন না। ইউক্লিডের জ্যামিতি নির্ভর করে কতগুলো স্বতঃসিদ্ধের ওপর। তার একটা হলো সমান্তরালের স্বতঃসিদ্ধ, যার কারণে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রি হয়। এ স্বতঃসিদ্ধকে প্রশ্ন করেই আধুনিক জ্যামিতি শুরু হয়েছে। একটি সমতল কাগজের ওপর আঁকলে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রিই হবে। কিন্তু আসুন, একটা গোলকের উপরে ত্রিভুজটা একে দেখি। দেখবেন তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রির উপরে। আবার একটি খাবারের পাত্রের ভেতরের অবতল অংশে ত্রিভুজ আঁকলে তিন কোণের সমষ্টি হবে ১৮০ ডিগ্রির কম। কাজেই ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি নির্ভর করছে কোন ক্ষেত্রের ওপর ত্রিভুজ আঁকা হচ্ছে তার ওপর। ক্ষেত্রের বক্রতার নিধারণ করে দিচ্ছে তিন কোণের সমষ্টি।
গাউস
বক্রতা কীভাবে পরিমাপ করতে হয় তা নিয়ে কিছু কাজ করেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন। তিনি নন-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি নিয়েও কিছু কাজ করেছিলেন এবং তা তার নোট খাতায় লিখে রেখেছিলেন কিন্তু কোনো কারণে প্রকাশ করেননি। খুঁতখুঁতে স্বভাবের গাউস আসলে অনেক কিছুই তার জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। বলা হয়, তিনি যদি তার নোট খাতা জীবদ্দশায় প্রকাশ করতেন তবে গণিত আজকে ৫০ বছর এগিয়ে থাকত।
গাউস
তার নন-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির ধারণা প্রকাশ না করলেও অন্য গণিতবিদরা বসে থাকেননি। এর মধ্যে আছেন হাঙ্গেরির ইয়ানোস বলিয়ই (১৮০২-১৮৬০)। বলিয়ইয়ের বাবা গাউসের বন্ধু মানুষ ছিলেন, সেই সুবাদে গাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন বলিয়ইয়ের নন-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির প্রবন্ধ বিষয়ে। গাউস বলিয়ইয়ের প্রশংসা করে লিখেছিলেন যে, নন-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি নিয়ে এ রকম তিনি নিজেও দীর্ঘসময় ধরে ভাবছেন, তাই বলিয়ইয়ের প্রশংসা করা হবে নিজেরই প্রশংসা করা। বলিয়ই এ উত্তরে স্বাভাবিক ভাবেই হতাশ হয়েছিলেন। কাজের কোনো প্রকাশ্য স্বীকৃতি না পেয়ে গণিতকে ত্যাগ করে একসময় তিনি অন্য পেশায় চলে গিয়েছিলেন।
গাউসের
সামান্য প্রশংসাই তখন বলিয়ইয়ের জীবন বদলে ফেলতে পারত। এ রকম আরো অনেকেই ছিলেন, যারা গাউসের কাছে তাদের কাজের বিষয়ে মতামত চেয়েছিলেন। কিন্তু গাউস তাদের সবাইকেই উপেক্ষা করেছিলেন। এই হলো গাউসের চরিত্রের মন্দ দিক। অতি বড় বৃদ্ধ পতি হয়তো নিজেকে নিয়েই সবসময় ছিলেন মশগুল।
তবে
গাউসের সুদৃষ্টিও কারো কারো ওপর পড়েছিল। এর মধ্যে একজন সোফি জারমেইন (১৭৭৭-১৮৩১)। ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও সোফি জারমেইনের চিঠির উত্তর গাউস দিয়েছিলেন। সোফি গাউসকে জানাননি যে তিনি একজন নারী। পরে গাউস যখন তা জানতে পারেন, তখন রীতিমতো অবাক হয়ে পড়েছিলেন। সোফির জন্য মৃত্যু-পরবর্তী একটা ডিগ্রিরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। গাউস শিক্ষকতা পছন্দ করতেন না, বলতেন এতে সময় নষ্ট হয়। কিন্তু গাউসের অনেক ছাত্রই গণিতের বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেন বেরনার্ড রিমান (১৮২৬-১৮৬৬), যার হাত
ধরে নন-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি পরিপূর্ণতা লাভ করে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এসেছে নন-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির ধারাবাহিকতাতেই।
অতি
বড়
বৃদ্ধ পতি গাউসের অবদানের তাই ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। তবে ভালো দিকটাই মনে হয় মন্দ দিকের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তবে মন্দ দিকের কারণেই গাউস অতিমানব না হয়ে শেষমেশ একজন মানুষ হিসেবে ধরা দেন।
গাউসকে
নিয়ে আমার শেষ কথা। গাউস সমাহিত আছেন গোয়েটিংগেন শহরের আলবানি নামের এক কবরস্থানে। আমার ২০১৮ সালের জুনে সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। গাউস সমাহিত হয়েছিলেন তার মস্তিষ্ক বাদে। গাউসের মস্তিষ্ক গবেষণার জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছিল। এখনো তা গোয়েটিংগেনেই সংরক্ষিত আছে।
মেহেদী মাহমুদ
চৌধুরী: যুক্তরাজ্যের
বোর্নমাউথ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির শিক্ষক