রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে

শেখ মুজিবুর রহমান

শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারেনি। যেকোনো জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতিই কোনোকালে সহ্য করেনি। এ সময় সরকারদলীয় মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুর জন্য জান-মাল কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু জনসমর্থন না পেয়ে একটু ঘাবড়ে পড়েছিলেন। তারা শেষতাবিজ নিক্ষেপ করলেন। জিন্নাহকে ভুল বোঝালেন। এরা মনে করলেন, জিন্নাহকে দিয়ে উর্দুর পক্ষে বলাতে পারলেই আর কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস পাবে না। জিন্নাহকে দল-মত নির্বিশেষে সবাই শ্রদ্ধা করতেন। তার যেকোনো ন্যায়সংগত কথা মানতে সবাই বাধ্য ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনমত কোন পথে, তাকে কেউই তা বলেননি বা বলতে সাহস পাননি। ১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকায় এলে হাজার হাজার লোক তাকে অভিনন্দন জানাতে তেজগাঁও হাওয়াই জাহাজের আড্ডায় হাজির হয়েছিল। আমার মনে আছে, ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিন আমরা সবাই ভিজে গিয়েছিলাম, তবুও ভিজে কাপড় নিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করার জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিলাম। জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড়দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। আমরা প্রায় চার পাঁচশ ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, ‘মানি না। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’, তখন ছাত্ররা তার সামনেই বসে চিত্কার করে বলল, ‘না, না, না। জিন্নাহ প্রায় ৫ মিনিট চুপ করে ছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তার মুখের ওপর তার কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচে ছিলেন আর কোনোদিন বলেননি, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। ঢাকায় জিন্নাহ দুই দলের ছাত্রনেতাদের ডাকলেন। বোধহয় বাংলা ভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদেরও ডেকেছিলেন। তবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের দুজন করে প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করলেন। কারণ তিনি পছন্দ করেননি, দুইটা প্রতিষ্ঠান কেন হবে এই মুহূর্তে! আমাদের পক্ষ থেকে মিস্টার তোয়াহা আর শামসুল হক সাহেব ছিলেন, তবে আমি ছিলাম না। জিন্নাহ আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামটা পছন্দ করেছিলেন। নিখিল পূর্ব পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের নাম যখন আমাদের প্রতিনিধি পেশ করেন, তখন তারা দেখিয়ে দিলেন যে এদের অধিকাংশ এখন চাকরি করে অথবা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। তখন জিন্নাহ তাদের ওপর রাগই করেছিলেন। শামসুল হক সাহেবের সঙ্গে জিন্নাহর একটু তর্ক হয়েছিল, যখন তিনি দেখা করতে যান বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার বিষয় নিয়ে, শামসুল হক সাহেব আমাকে এসে বলেছিলেন। শামসুল হক সাহেবের সৎসাহস ছিল, সত্য কথা বলতে কাউকেও ভয় পেতেন না।

জিন্নাহ চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা হয়। তাতে একজন ছাত্র বক্তৃতা করেছিল, তার নাম মনে নাই। তবে সে বলেছিল, “জিন্নাহ যা বলবেন তাই মানতে হবে। তিনি যখন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা বলেছেন তখন উর্দুই হবে। আমি তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা করেছিলাম, আজও আমার এই একটা কথা মনে আছে। আমি বলেছিলাম, “কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন হযরত ওমরকে (রা.) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে বাংলা ভাষা শতকরা ছাপ্পান্নজন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি। সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শোভাযাত্রা করে চলল। দিন দিন জনমত সৃষ্টি হতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে দেখা গেল, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কোনো সমর্থক রইল না। কিছু নেতা রইল, যাদের মন্ত্রীদের বাড়ি ঘোরাফেরা করা আর সরকারের সকল কিছুই সমর্থন করা ছাড়া কাজ ছিল না।

...............................................................

নাজিমুদ্দীন সাহেব প্রধানমন্ত্রী হয়ে কিছুদিন পর তিনি পূর্ব বাংলায় আসেন। প্রথমবার তিনি কিছুই বলেননি। কিছুদিন পর বোধহয় ১৯৫১ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় তিনি বক্তৃতা করলেন। সেখানে ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। তিনি ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ওয়াদা করেছিলেন, সে ওয়াদার খেলাপ করলেন। ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন এবং নিজেই পূর্ব বাংলা আইসভায় প্রস্তাব পেশ করেছিলেন যে পূর্ব বাংলার অফিসিয়াল ভাষাবাংলা হবে। তাছাড়া যাতে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয়, তার জন্য কেন্দ্রীয় আইনসভায় কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করা হবে। এ প্রস্তাব পূর্ব বাংলার আইনসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। যে ঢাকায় বসে তিনি ওয়াদা করেছিলেন, সেই ঢাকায় বসেই উল্টা বললেন। দেশের মধ্যে ভীষণ ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। তখন একমাত্র রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং যুবাদের প্রতিষ্ঠান যুবলীগ সবাই এর তীব্র প্রতিবাদ করে।

আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত ১টার পর আসতে বললাম। আরো বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুবসহ আরো কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পেছনের বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে। আমি অনেক রাতে একা হাঁটাচলা করতাম। রাতে কেউ আসে না বলে কেউ কিছু বলত না। পুলিশরা চুপচাপ পড়ে থাকে, কারণ জানে আমি ভাগব না। গোয়েন্দা কর্মচারী একপাশে বসে ঝিমায়। বারান্দায় বসে আলাপ হলো এবং আমি বললাম সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হলো। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেননি, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছেন। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হয়নি, তবু আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালোবাসত। আরো বললাম, ‘খবর পেয়েছি, আমাকে শিগগিরই আবার জেলে পাঠিয়ে দেবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এসো। আরো দু-একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরদিন রাতে এক এক করে অনেকেই এল। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে। আমি আরও বললাম, ‘আমি আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব। আমার ছাব্বিশ মাস জেল হয়ে গেছে। আমি এ কথাও বলেছিলাম, ‘মহিউদ্দিন জেলে আছে, আমার কাছে থাকে। যদি সে অনশন করতে রাজি হয়, তবে খবর দেব। তার নামটাও আমার নামের সাথে দিয়ে দিবে। আমাদের অনশনের নোটিস দেওয়ার পরই শওকত মিয়া প্যামপ্লেট ও পোস্টার ছাপিয়ে বিলি করার বন্দোবস্ত করবে।

দুই দিন পরেই দেখলাম একটা মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে আমাকে এক্সামিন করতে এসেছে।

...............................................................

এদিকে জেলের ভেতর আমরা দুজনে প্রস্তুত হচ্ছিলাম অনশন ধর্মঘট করার জন্য। আমরা আলোচনা করে ঠিক করেছি, যা-ই হোক না কেন, আমরা অনশন ভাঙব না। যদি এ পথেই মৃত্যু এসে থাকে তবে তাই হবে। জেল কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে সুপারিনটেনডেন্ট আমীর হোসেন সাহেব ও তখনকার দিনে রাজবন্দিদের ডেপুটি জেলার মোখলেসুর রহমান সাহেব আমাদের বুঝাতে অনেক চেষ্টা করলেন। আমরা তাদের বললাম, আপনাদের বিরুদ্ধে আমাদের বলার কিছু নেই। আর আমরা সেজন্য অনশন করছি না। সরকার আমাদের বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটক রাখছে, তারই প্রতিবাদ করার জন্য অনশন ধর্মঘট করছি। এতদিন জেল খাটলাম, আপনাদের সাথে আমাদের মনোমালিন্য হয়নি। কারণ আমরা জানি যে সরকারের হুকুমেই আপনাদের চলতে হয়। মোখলেসুর রহমান সাহেব খুবই অমায়িক, ভদ্র ও শিক্ষিত ছিলেন। তিনি খুব লেখাপড়া করতেন।

১৫ ফেব্রুয়ারি সকালবেলা আমাকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হলো এ কথা বলে যে আমার সাথে আলোচনা আছে অনশন ধর্মঘটের ব্যাপার নিয়ে। আমি যখন জেলগেটে পৌঁছলাম। দেখি একটু পরই মহিউদ্দিনকেও নিয়ে আসা হয়েছে একই কথা বলে। কয়েক মিনিট পর আমার মালপত্র, কাপড়চোপড় ও বিছানা নিয়ে জমাদার সাহেব হাজির। বললাম, ব্যাপার কী? কর্তৃপক্ষ বলল, আপনাদের অন্য জেলে পাঠানোর হুকুম হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, কোন জেলে? কেউ কিছু বলেন না। এদিকে আর্মড পুলিশ, আইবি অফিসারও প্রস্তুত হয়ে এসেছে। খবর চাপা থাকে না। একজন আমাকে বলে দিল, ফরিদপুর জেলে। দুজনকেই এক জেলে পাঠানো হচ্ছে। তখন ৯টা বেজে গেছে। ১১টায় নারায়ণগঞ্জ থেকে জাহাজ ছাড়ে, সেই জাহাজ আমাদের ধরতে হবে। আমি দেরি করতে শুরু করলাম। কারণ তা না হলে কেউই জানবে না আমাদের কোথায় পাঠাচ্ছে! প্রথমে আমার বইগুলো এক এক করে মেলাতে শুরু করলাম, তারপর কাপড়গুলো। হিসাব-নিকাশ, কত টাকা খরচ হয়েছে, কত টাকা আছে। দেরি করতে করতে ১০টা বাজিয়ে দিলাম। রওনা হতে আরো আধা ঘণ্টা লাগিয়ে দিলাম। আর্মড পুলিশের সুবেদার ও গোয়েন্দা কর্মচারীরা তাড়াতাড়ি করছিল। সুবেদার পাকিস্তান হওয়ার সময় গোপালগঞ্জে ছিল এবং সে একজন বেলুচি ভদ্রলোক। আমাকে খুবই ভালোবাসত এবং শ্রদ্ধা করত। আমাকে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে দেখেছে। আমাকে দেখেই বলে বসল, ‘ইয়ে কেয়া বাত হ্যায়, আপ জেলখানা মে। আমি বললাম, ‘কিসমত। আর কিছুই বললাম না। আমাদের জন্য বন্ধ ঘোড়ার গাড়ি আনা হয়েছে। গাড়ির ভেতর জানালা উঠিয়ে ও দরজার কপাট বন্ধ করে দিল। দুজন ভেতরেই আমাদের সঙ্গে বসল। আরেকটা গাড়িতে অন্যরা পেছনে পেছনে ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে রোডের দিকে চলল। সেখানে গিয়ে দেখি পূর্বেই একজন আর্মড পুলিশ ট্যাক্সি রিজার্ভ করে দাঁড়িয়ে আছে।

.............................................................

২১ ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম। রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। রেডিওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, আরো অনেক স্লোগান। আমার খুব খারাপ লাগল। কারণ ফরিদপুর আমার জেলা, মহিউদ্দিনের নামে কোনো স্লোগান দিচ্ছে না কেন? শুধুরাজবন্দিদের মুক্তি চাই বললেই তো হতো। রাতে যখন ঢাকার খবর পেলাম তখন ভীষণ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লাম। কত লোক মারা গেছে বলা কষ্টকর। তবে অনেক লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে শুনেছি। দুজনে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আছি। ডাক্তার সাহেব আমাদের নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু উত্তেজনায় উঠে বসলাম। দুজন কয়েদি ছিল আমাদের পাহারা দেয়ার এবং কাজকর্ম করে দেয়ার জন্য। তাড়াতাড়ি আমাদের ধরে শুইয়ে দিল। খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। গুলি করার তো কোনো দরকার ছিল না। হরতাল করবে, সভা ও শোভাযাত্রা করবে, কেউ তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না। কোনো গোলমালা সৃষ্টি করার কথা তো কেউ চিন্তা করেনি। ১৪৪ ধারা দিলেই গোলমাল হয়, না দিলে গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। অনেক রাতে একজন সিপাহি এসে বলল, ছাত্র মারা গেছে অনেক। বহু লোক গ্রেফতার হয়েছে। রাতে আর কোনো খবর নেই। ঘুম তো এমনিই হয় না, তারপর আবার এই খবর। পরদিন ৯-১০টার সময় বিরাট শোভাযাত্রা বের হয়েছে, বড় রাস্তার কাছেই জেল। শোভাযাত্রাকারীদের স্লোগান পরিষ্কার শুনতে পেতাম, হাসপাতালের দোতলা থেকে দেখাও যায়, কিন্তু আমরা নিচের তলায়। হর্ন দিয়ে একজন বক্তৃতা করছে। আমাদের জানানোর জন্যই হবে। কী হয়েছে ঢাকায় আমরা কিছু কিছু বুঝতে পারলাম। জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনো খবর দিতে চায় না। আমরা যেন কোনো খবর না পাই, আর কোনো খবর না দিতে পারি বাইরে, এই তাদের চেষ্টা। খবরের কাগজ তো একদিন পরে আসবে, ঢাকা থেকে।

২২ তারিখে সারা দিন ফরিদপুরে শোভাযাত্রা চলল। কয়েকজন ছাত্রছাত্রী এক জায়গায় হলেই স্লোগান দেয়। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বেড়ায় আর স্লোগান দেয়। ২২ তারিখে খবরের কাগজ এল, কিছু কিছু খবর পেলাম। মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয়নি। নুরুল আমিন বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাকে কোথায় নিয়ে গেল। গুলি হলো মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেফতার করলেই তো চলত। আমি ভাবলাম, দেখব কিনা জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নেই। মানুষের যখন পতন আসে তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে। বাংলাদেশের মুসলিম লীগ নেতারা বুঝলেন না, কে বা কারা খাজা সাহেবকে উর্দুর কথা বলালেন, আর কেনই বা তিনি বললেন! তারা তো জানতেন, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলে মিস্টার জিন্নাহর মতো নেতাও বাধা না পেয়ে ফিরে যেতে পারেননি। সেখানে খাজা সাহেব ও তার দলবলের অবস্থা কী হবে? একটা বিশেষ গোষ্ঠী, যারা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করতে শুরু করেছেন, তারাই তাকে জনগণ থেকে যাতে দূরে সরে পড়েন তার বন্দোবস্ত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার সমর্থক নূরুল আমিন সাহেবও যাতে জনগণ থেকে বিছিন্ন হয়ে যান সে ব্যবস্থা করালেন। কারণ ভবিষ্যতে এ বিশেষ গোষ্ঠী কোনো একটা গভীর ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। যদিও খাজা সাহেবের জনসমর্থন কোনোদিন বাংলাদেশে ছিল না।

খবরের কাগজে দেখলাম, মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ এমএলএ, খয়রাত হোসেন এমএলএ, খান সাহেব ওসমান আলী এমএলএ এবং মোহাম্মদ আবুল হোসেন ও খোন্দকার মোশতাক আহমদসহ শত শত ছাত্র ও কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। দু-একদিন পর দেখলাম কয়েকজন প্রফেসর, মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক সাহেব ও বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। নারায়ণগঞ্জে খান সাহেব ওসমান আলীর বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভীষণ মারপিট করেছে। বৃদ্ধ খান সাহেব ও তার ছেলেমেয়েদের ওপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে। সমস্ত ঢাকায় ও নারায়ণগঞ্জে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের কোনো কর্মীই বোধহয় আর বাইরে নেই।

(সূত্র: ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

 

শেখ মুজিবুর রহমান: জাতির জনক ও বঙ্গবন্ধু

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন