চামড়া শিল্প

ক্রেতা আসছে না, উৎপাদন বন্ধ

বদরুল আলম

প্রধান ক্রেতা চীনা ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে আসতেপারছেন না। আবার চীন থেকে চামড়া প্রক্রিয়াকরণে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক আমদানিও বন্ধ।ফলে সাভার চামড়া শিল্পনগরীর কারখানা আস্ক ইনভেস্টমেন্টের চামড়া প্রক্রিয়াকরণকার্যক্রম বন্ধ রয়েছে ১০ দিন ধরে। উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রস্তুতকৃত ৬কোটি টাকার চামড়া রফতানি করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।

চলমান নভেল করোনাভাইরাস সংকটে ক্রেতাশূন্য হয়েপড়ায় সাভার চামড়া শিল্পনগরীর কারখানাগুলোর রফতানি এখন প্রায় বন্ধ। ফলে প্রস্তুতপণ্যের মজুদ বেড়েছে। এ কারণে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেট্যানারিগুলো। শ্রমিকদের বলা হয়েছে উৎপাদন অব্যাহত না রাখতে।

ট্যানারি মালিকরা জানান, সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে সক্রিয় কারখানা রয়েছে ১৩২টি। এর মধ্যে ১২২টিতেই এখন উৎপাদনবন্ধ। উৎপাদনের পাশাপাশি রফতানি বন্ধ হয়ে পড়ায় শিল্পনগরীতে প্রস্তুত চামড়ার মজুদজমেছে প্রায় ১০০ কোটি টাকার।

আস্ক ইনভেস্টমেন্টের এক ব্যবস্থাপক বণিক বার্তাকেবলেন,এখন কোনো উৎপাদন হচ্ছে না। শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিচ্ছি। কারণ বর্তমানেকেউই চামড়া কিনতে চাচ্ছে না। চাহিদা কমে গেছে। আরেকটা কারণ হলো চীন। দেশটির বাজারখারাপ হয়ে গেছে। চীনের ক্রেতারা কিছু পণ্য নিতেন। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে এখনএকেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ আসা-যাওয়া করতে পারছে না। এমনিতেই বছরখানেক ধরে ব্যবসা খারাপ, এখন আরো খারাপ হয়ে গেছে। কারখানায় মজুদ আছে কমপক্ষে ৬ কোটি টাকার পণ্য।বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে চামড়া নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। আগে টুকটাকব্যবসা হচ্ছিল। চীনের ঘটনার পর বন্ধ হয়ে গেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়া পণ্যের প্রধান রফতানি বাজার হলো চীন। রফতানিতে উৎপাদিত মোট চামড়ার ৫০-৬০শতাংশেরই গন্তব্য চীন। সাধারণত এলসি বা টিটির বিপরীতে চামড়া পণ্য রফতানি হয়ে থাকে।ট্যানাররা বরাবরের মতো সেলস কন্ট্রাক্টের বিপরীতে চামড়া প্রস্তুত করে রেখেছেন।কিন্তু চীনা ক্রেতারা না আসায় তাদের পণ্য সব মজুদ হয়ে পড়ে আছে। বিদ্যমানপরিস্থিতিতে চীনা ক্রেতারা কোনো টিটিও করতে পারছেন না, আবার এলসিও খুলতে পারছেন না।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) জেনারেল সেক্রেটারি শাখাওয়াত উল্লাহ বণিকবার্তাকে বলেন, ১৫ জানুয়ারির পর থেকে চীনা ক্রেতারা আর আসেননি।ওই সময় থেকে কোনো চামড়াও রফতানি হয়নি। চীনের বাজারের জন্য প্রস্তুতকৃত ক্রয়াদেশপ্যাকিং করা আছে প্রায় ১০০ কনটেইনারের কাছাকাছি। সব ট্যানারি মিলিয়ে এ ১০০কনটেইনার পণ্যের মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

এছাড়া কারখানাগুলোর উৎপাদন পরিস্থিতিকে আরো সংকটপূর্ণকরে তুলতে পারে চীন থেকে রাসায়নিক আমদানি বন্ধ থাকার বিষয়টিও। উদ্যোক্তারা জানান, চামড়া প্রক্রিয়াজাতে প্রয়োজনীয় রাসায়নিকের ৩০ শতাংশ আসে চীন থেকে। দেশটি থেকেএখন কোনো শিপমেন্ট করতে পারছেন না সরবরাহকারীরা। কিছু পণ্য বন্দরে এলেও সেগুলোরনথি দিতে পারেননি চীনা রফতানিকারকরা।

সাভারের ট্যানারিগুলোয় সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ কারখানারই উৎপাদন বন্ধ। বণিক বার্তাকে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে একট্যানারি ব্যবস্থাপক বলেন, দুই মাসের মতো হলো এখানে উৎপাদনহচ্ছে না। ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর থেকেচীনারা আসছেন না। আমরা এখন দুর্গতির মধ্যে আছি। ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছি। আমরা খুবকষ্টের মধ্যে আছি। কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হচ্ছে না। কবে এ দুর্দিন কাটবে বুঝতেপারছি না।

ট্যানারি ব্যবস্থাপকরা জানান, এখানকার অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান এখন লোকসানে। এর কারণ হলো, উৎপাদন ও রফতানি বন্ধ। একটি প্রতিষ্ঠানে শুধু গত কয়েকদিনেই ক্ষতি হয়েছে ৫০ লাখটাকার মতো।

বিটিএর তথ্যমতে, কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে তিন বছর ধরে ইউরোপের ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে চামড়া কিনছেননা। ফলে প্রতি বছর সংগৃহীত চামড়ার ৪০-৫০ শতাংশ মজুদ থেকে যাচ্ছে। চীনকে বিকল্পবাজার হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্যযুদ্ধ বিপাকেফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশী রফতানিকারকদের। কারণ চীনা ক্রেতারা চামড়ার দাম কমিয়েদিচ্ছিলেন। এখন নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীনের সঙ্গে কোনো ব্যবসাই হচ্ছে না।

সার্বিক প্রেক্ষাপটে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যেররফতানি এখন এমনিতেই কমতির দিকে। এ পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে নভেলকরোনাভাইরাস। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশ থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি কমেছে ৬শতাংশ। একই সময়ে শুধু চামড়ার রফতানি কমেছে ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এ ধারা অব্যাহতরয়েছে চলতি অর্থবছরেও। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম সাত মাস (জুলাই-জানুয়ারি) শেষে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি কমেছে ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে শুধুচামড়ার রফতানি কমেছে ২৬ দশমিক ১১ শতাংশ।

তথ্যমতে, বর্তমানে বিটিএর সদস্যভুক্ত ট্যানারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৮৮টি।রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারে গড়ে তোলা চামড়া শিল্পনগরীতে এখন পর্যন্ত কারখানাস্থানান্তর হয়েছে ১৫৪টি। এর মধ্যে উৎপাদন শুরু করতে পেরেছে ১৩২টি প্রতিষ্ঠান।কমপ্লায়েন্স না থাকায় এসব কারখানার মধ্যে এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক মান সনদ অর্জন করতেপেরেছে মোটে একটি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন