শেয়ার মানি ডিপোজিট হিসেবে প্রাপ্ত অর্থের
বিপরীতে ছয় মাসের মধ্যে শেয়ার ইস্যু করতে পাবলিক ইন্টারেস্ট এনটিটি বা জনস্বার্থ
সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি), বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে শেয়ার
ইস্যুর আগ পর্যন্ত শেয়ার মানি ডিপোজিটকে সম্ভাব্য শেয়ার হিসেবে বিবেচনা করে
শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হিসাব করতে হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এফআরসির এ নির্দেশনা পরিপালন করতে হলে
আগামী ছয় মাসের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ছয় সরকারি কোম্পানিকে শেয়ারপ্রতি ১০
টাকা ফেসভ্যালু হিসেবে ৭০০ কোটির বেশি শেয়ার ইস্যু করতে হবে। যদি প্রিমিয়ামসহ
শেয়ার ইস্যু করা হয়, তাহলে শেয়ার সংখ্যা আরো
কমবে। তবে ফেসভ্যালু কিংবা প্রিমিয়াম যেভাবেই শেয়ার ইস্যু করা হোক না কেন, এতে কোম্পানিগুলোর ইপিএস অনেক কমে যাবে।
শেয়ার ইস্যু করা হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে
কোম্পানির বর্তমান শেয়ারহোল্ডার কিংবা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেয়া
অর্থকে শেয়ার মানি ডিপোজিট বলা হয়। শেয়ার ইস্যুর জন্য কিছু আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন
করতে হয়। আর এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগপর্যন্ত এ অর্থকে শেয়ার মানি ডিপোজিট বা
ডিপোজিট ফর শেয়ার খাতে দেখানো হয়। আর্থিক প্রতিবেদনে এটিকে কখনো মূলধনের অংশ আবার
কখনো দায় হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে
মূলত সরকারি কোম্পানিগুলোরই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ শেয়ার মানি ডিপোজিট রয়েছে। এর
মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ
লিমিটেডের (পিজিসিবিএল) কাছে আছে ৫ হাজার ৫৪৯ কোটি ৭০ লাখ টাকার শেয়ার মানি ডিপোজিট। এফআরসির
নির্দেশনা অনুসারে কোম্পানিটিকে এ অর্থের বিপরীতে সরকারের অনুকূলে শেয়ার ইস্যু
করতে হবে। কারণ কোম্পানিটি সরকারের কাছ থেকে ইকুইটি হিসেবে এ অর্থ নিয়েছে। ১০ টাকা
ফেসভ্যালু হিসেবে শেয়ার মানি ডিপোজিটের বিপরীতে ৫৫৫ কোটি শেয়ার ইস্যু করতে হবে
কোম্পানিটিকে। যদি প্রিমিয়ামসহ শেয়ার ইস্যু করা হয়, তাহলে অবশ্য শেয়ার সংখ্যা কমে আসবে। কোম্পানিটির বর্তমান পরিশোধিত মূলধন ৭১২
কোটি ৭৩ লাখ টাকা এবং শেয়ার সংখ্যা ৭১ কোটি ২৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৯১। গতকাল ঢাকা স্টক
এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ৫২ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
পিজিসিবিএলের কোম্পানি সচিব মো. জাহাঙ্গীর আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, এফআরসির নির্দেশনার বিষয়ে করণীয় জানতে আমরা এ মাসের ২৪ তারিখে অনুষ্ঠেয় পর্ষদ
সভায় বিষয়টি উপস্থাপন করব। পর্ষদ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। বর্তমানে পিজিসিবিএলের
বড় কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৬০ শতাংশ ইকুইটি ও ৪০
শতাংশ ঋণ হিসেবে সরকারের কাছ থেকে অর্থ নেয়া হয়। ফলে ভবিষ্যতেও সরকারের কাছ থেকে
পাওয়ার গ্রিডকে অর্থ নিতে হবে। অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় পাওয়ার গ্রিডের বিষয়টি
আলাদা বলেও জানান তিনি।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত
ব্যাংক রূপালী ব্যাংক লিমিটেড। সর্বশেষ সমাপ্ত ২০১৯ হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিক
শেষে ব্যাংকটির শেয়ার মানি ডিপোজিটের পরিমাণ ছিল ৬৮০ কোটি টাকা। ফেসভ্যালু হিসেবে
এর বিপরীতে ব্যাংকটিকে ৬৮ কোটি শেয়ার ইস্যু করতে হবে। বর্তমানে ব্যাংকটির পরিশোধিত
মূলধন ৪১৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা এবং শেয়ার সংখ্যা ৪১ কোটি ৪১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৩৩।
ডিএসইতে গতকাল ব্যাংকটির শেয়ার সর্বশেষ ৩২ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
রূপালী ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মো. শওকত জাহান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ২০১২ সাল থেকেই আমরা রাইট শেয়ার ইস্যুর জন্য চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে অনুমোদন
চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বেশ কয়েকবার চিঠিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত
মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে রাইট শেয়ার ইস্যুর অনুমোদন পাওয়া যায়নি। রাইট শেয়ার ইস্যুর
অনুমোদন পেলে শেয়ার মানি ডিপোজিটের বিপরীতে শেয়ার ইস্যুসহ ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের মাধ্যমে মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী করা সম্ভব হবে।
ছয় মাসের মধ্যে এফআরসির নির্দেশনা পরিপালনের
বাধ্যবাধকতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ সময়ের মধ্যে যদি রাইট শেয়ার ইস্যুর অনুমোদন না পাওয়া যায়, তাহলে সেক্ষেত্রে এফআরসির নির্দেশনা কীভাবে পরিপালন করা যায় সে বিষয়ে পরবর্তী
সময়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বিদ্যুৎ খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) ৩০ জুন ২০১৯ শেষে শেয়ার মানি ডিপোজিটের পরিমাণ ছিল ৫৬৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ফেসভ্যালুতে প্রায় ৫৭ কোটি শেয়ার ইস্যু করতে হবে কোম্পানিটিকে। বর্তমানে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ৩৯৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা এবং শেয়ারের পরিমাণ ৩৯ কোটি ৭৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮০৪টি। ডিএসইতে গতকাল কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ৪২ টাকা ৮০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
টেলিযোগাযোগ খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি
বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) শেয়ার মানি ডিপোজিটের পরিমাণ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯
শেষে ছিল ১৬৬ কোটি টাকা। ফেসভ্যালুতে এর বিপরীতে ১৬ কোটি ৬০ লাখ শেয়ার ইস্যু করতে
হবে তাদের। বর্তমানে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ১৬৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং শেয়ার
সংখ্যা ১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৫ হাজার ৫১০। ডিএসইতে সর্বশেষ কোম্পানিটির শেয়ার ১০৫ টাকায়
লেনদেন হয়েছে।
বিএসসিসিএলের কোম্পানি সচিব মো. আব্দুস সালাম খান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, এফআরসির নির্দেশনার বিষয়ে আমরা অবগত রয়েছি। আগামী মাসে আমাদের পর্ষদ সভায় এ
বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া
হবে বলে জানান তিনি।
রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস
ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ শেষে ১৬৮
কোটি ২৮ লাখ টাকার শেয়ার মানি ডিপোজিট ছিল। এর বিপরীতে ফেসভ্যালুতে ১৬ কোটি ৮২ লাখ
শেয়ার ইস্যু করতে হবে। বর্তমানে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ৯৮৯ কোটি ২২ লাখ টাকা
এবং শেয়ার সংখ্যা ৯৮ কোটি ৯২ লাখ ২১ হাজার ৮৩১। ডিএসইতে সর্বশেষ কোম্পানিটির শেয়ার
৩৬ টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি মেঘনা
পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের শেয়ার মানি ডিপোজিটের পরিমাণ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ শেষে ছিল ৪
কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এর বিপরীতে প্রায় ৫০ লাখ শেয়ার ইস্যু করতে হবে কোম্পানিটিকে।
বর্তমানে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১০৮ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং শেয়ারের
সংখ্যা ১০ কোটি ৮২ লাখ ১৬ হাজার ১০৮। ডিএসইতে সর্বশেষ কোম্পানিটির শেয়ার ১৮৪ টাকায়
লেনদেন হয়েছে।
মেঘনা পেট্রোলিয়ামের কোম্পানি সচিব রেজা মো. রিয়াজুদ্দীন বলেন, এফআরসির নির্দেশনার বিষয়টি
কয়েকদিন আগেই জানতে পেরেছি। বিষয়টি আমাদের জন্য নতুন হওয়ার কারণে এটি সম্পর্কে আরো
বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। তাই এ বিষয়ে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সেটি
এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না।
ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং
স্ট্যান্ডার্ড (আইএফআরএস) অনুসারে মূলধন বা ইকুইটির সংজ্ঞার কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য জনস্বার্থ
সংস্থাগুলোর জন্য এ গাইডলাইন জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এফআরসি। এ গাইডলাইন
বাস্তবায়নে কোনো ধরনের ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন, ২০১৫-এর ৪৮ ধারায় উল্লেখিত দণ্ড কার্যকর করা হবে।
আইনটির ৪৮ ধারায় বলা আছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি এই আইন বা এর অধীনে প্রণীত বিধি, প্রবিধান, গাইডলাইন, স্ট্যান্ডার্ডস বা নির্দেশনার শর্ত ভঙ্গ কিংবা অসাধু পন্থা কিংবা মিথ্যা তথ্য
প্রদানের মাধ্যমে নিরীক্ষক হিসেবে নিবন্ধন লাভ করে অথবা এই আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন
করে,
তাহলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এজন্য অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা
কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।’
এফআরসি বলছে, শেয়ার মানি ডিপোজিটের অর্থ নিয়ে বেশকিছু অনিয়ম কাউন্সিলের নজরে এসেছে। আর এসব
অনিয়ম বন্ধ করার জন্যই এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কেউ যদি শেয়ার মানি ডিপোজিটের
অর্থের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করতে না চায়, সেক্ষেত্রে এটিকে মূলধন বা ইকুইটির অংশ হিসেবে না দেখিয়ে দায় হিসেবে দেখাতে
হবে। তাহলে আইএফআরএস অনুসারে মূলধনের সংজ্ঞা পরিপালনে ব্যত্যয় ঘটবে না। মূলধন
হিসেবে দেখালে শেয়ার ইস্যু করতেই হবে।
এফআরসির অডিট প্র্যাকটিস রিভিউ বিভাগের নির্বাহী
পরিচালক মো. সাইদ আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, শেয়ার মানি ডিপোজিট নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম হচ্ছে। অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ
নেয়ার জন্য মূলধন বেশি দেখাতে শেয়ার মানি ডিপোজিটের অর্থ ব্যবহার করে। পরবর্তী
সময়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পর শেয়ার মানি ডিপোজিটের অর্থ ফেরত নিয়ে যায়। বছরের পর
বছর ধরে কোম্পানিগুলো শেয়ার মানি ডিপোজিটকে মূলধনের অংশ হিসেবে দেখিয়ে এলেও ইপিএস
হিসাবের ক্ষেত্রে এটি বিবেচনা করা হয়নি। এতে শেয়ারহোল্ডারদের কাছে কোম্পানির
প্রকৃত ইপিএসের তথ্য উপস্থাপিত হয়নি। তাছাড়া আন্তর্জাতিক হিসাবমান অনুসরণ করেই
আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে এবং এক্ষেত্রে এফআরসির নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটানোর
সুযোগ নেই। তিনি আরো বলেন, শেয়ার মানি ডিপোজিটের
বিপরীতে যদি ফেসভ্যালুতে শেয়ার ইস্যু করা হয়, সেক্ষেত্রে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে
হবে।