বাংলাদেশ
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব)। চলতি বছর একুশে পদকের
জন্য মনোনীত হয়েছেন। জার্মানির হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বেলজিয়ামের ঘেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও নেদারল্যান্ডসের
ভাগিনিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস স্কুলে দায়িত্ব পালন করেন
ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে। ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন জাতিসংঘের খাদ্য
ও কৃষি সংস্থায়। ২০০৯ সালে পরিকল্পনা কমিশনে যোগদানের পর তার নেতৃত্বে সাধারণ
অর্থনীতি বিভাগ থেকে বাংলাদেশের প্রথম দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণীত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন
মোকাবেলায় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘমেয়াদি শত বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনা
তৈরিতে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। সম্প্রতি
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, বেসরকারি বিনিয়োগ, আর্থিক খাত এবং
পুঁজিবাজার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
সাক্ষাৎকার
নিয়েছেন এম এম মুসা
আপনারা সফলভাবে
দুটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শেষ করেছেন। আরেকটি তৈরি করছেন। এটিতে নতুন কী আছে?
সফলভাবে প্রথম
প্রেক্ষিত পরিকল্পনা তৈরি করেছি। আরেকটিও সমাপ্তপ্রায়। এখন এনইসিতে নিয়ে যাব। এতে
আছে ২০৪১ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় কত হবে,
আমাদের কৃষি খাতের কত
অবদান থাকবে; শিল্প খাতের, সেবা খাতের
ভূমিকা কী থাকবে। চলতি মাসের যেকোনো দিন এনইসিতে উপস্থাপিত হবে এবং আশা করি ২০৪১
রূপকল্পভিত্তিক
এ দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুমোদন হয়ে যাবে।
কাঠামোগত কোনো
পরিবর্তন আছে কি?
কাঠামোগত বলতে
যেটি আমরা সবসময়ই গুরুত্ব দিয়েছি সেটি হলো,
বহুমুখী রফতানির শক্তিশালী
ভিত গড়ে তোলা। কারণ বাংলাদেশের এগোনোর আর কোনো উপায় নেই। নিজস্ব দেশীয় কোনো সম্পদ
নেই যে তা বেচে দেশ সম্পদশালী হবে। আমাদের যেতে হবে রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধিতে। কোনো
কোনো দেশে রফতানিতে এত জোর দিতে হয় না। কারণ প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকে। যেমন
দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা। সেখানে স্বর্ণের খনি, হীরার খনি আছে। আবার নাইজেরিয়ায় আছে তেলের খনি। আমাদের না
স্বর্ণ, না হীরা,
না রফতানিযোগ্য মিনারেলস, তেমন কিছু নেই। কিছু কয়লা আছে। সেটি আমরা ব্যবহার করছি না।
ফলে আমাদের উন্নয়নের একটা প্রধান অবলম্বন বা উপায় হতে হবে রফতানি বৃদ্ধির পথ। আবার
সেই রফতানি হতে হবে শিল্পপণ্যের,
সেবাপণ্যের রফতানি। মূল্য
সংযোজিত পণ্য রফতানি করতে হবে। আমাদের যন্ত্রপাতি, ইকুইপমেন্ট, টুলস,
মেশিনারি এসব রফতানি শুরু
করতে হবে মালয়েশিয়ার মতো। এছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই।
পরিবর্তনটা আমরা
আগেই শুরু করেছি। ২০১০ সালে আমরা যখন ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করি, তখন সেখানেই একটি মোড় ঘোরানোর সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা
ব্যক্তি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেব। তখন ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ছিল ৭৭ শতাংশ আর
সরকারি বিনিয়োগ ছিল মোট বিনিয়োগের ২২-২৩ শতাংশ। কাজেই এত বৃহৎ অংশ যাদের হাতে, তাদের বাণিজ্যে সুবিধা দেয়া (সুবিধা মানে তারা যেন একটি নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে সেই সুযোগ দেয়া) দরকার। তাদের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা এমন প্রতিযোগিতামূলকভাবে
গড়ে তোলা, যাতে তারা আর্থিক সহায়তা, শিল্পায়নে পুঁজি প্রতিযোগিতামূলক বাজারদরে পেতে পারে। এটা
আমরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকেই। সপ্তম
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ছিল তার ধারাবাহিকতা। এখন অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা একই
ধরনের হবে। তবে এক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে অসাম্য দূর করার ওপর।
আয়বৈষম্য ও আঞ্চলিক বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য সরাসরি অনেক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হবে।
এসব বিষয়ে আমরা পরামর্শ রাখব অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। কারণ এটি আমাদের একটি
বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে।
প্রবৃদ্ধি হোক, এটি আমরা চাই। প্রবৃদ্ধিতে যারা অংশ নিচ্ছে, তাদের বাধা দিতে চাইছি না। কারণ যারা প্রবৃদ্ধিতে অংশ নেয়—ব্যবসায়ী শ্রেণী, উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী—তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে দ্রুত অনেক বেশি অগ্রসর হয়। সে কারণে
তাদের আয় বাড়ে, নিম্নমধ্যবিত্ত বা দরিদ্রদের আয় কিন্তু সেভাবে
বাড়ে না। সেজন্য বৈষম্য বেড়ে যায়। সম্পদ সৃষ্টি হোক, এটি চাই। আমরা
চাইব একটি প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা,
একটি কার্যকর সামাজিক
সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং এতেও অসাম্য সবটা দূর হবে না। আমরা এর সঙ্গে আরো
যেটি করতে চাইব তা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক ব্যয় বৃদ্ধি করা। বিশেষভাবে
প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো সংহত করা, জোরদার করা এবং মেয়েদের যে উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে, তা অব্যাহত রাখা। বিনা মূল্যে বই দেয়া চালু রাখা হয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার নিচের দিকে আমাদের আরো বিনিয়োগ করতে হবে এবং স্বাস্থ্য খাতেও
ব্যাপক ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে,
যাতে এ ব্যয়ে সমাজের নিম্ন
অংশ বেশি উপকৃত হয়। সে কারণে অসাম্য দূর করতে হলে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার
সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর জোর দেব। পল্লী অবকাঠামো
গড়ে তুলেছি এবং সেটি আরো সংহত করা,
সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা
নিলে গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। ব্যাপক বিদ্যুতায়নের ফলে সামগ্রিক
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কেবল বৃদ্ধি পাক তা নয়,
সেই সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে
সাধারণ মানুষ বা উদ্যোক্তা শ্রেণী,
স্বল্প পুঁজির মানুষ
বিদ্যুতায়নের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে তারা বিনিয়োগ করতে পারে। অকৃষি
কার্যক্রমের ব্যাপক বিস্তার প্রয়োজন এবং সেটি হচ্ছেও। এভাবে অসমতা দূর করার একটি
প্রচেষ্টা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় থাকবে এবং সেই সঙ্গে বিশেষ বিশেষ যে
দরিদ্র অঞ্চল আছে, যেগুলো গত খানা আয় জরিপে চিহ্নিত হয়েছে। যেমন
কুড়িগ্রাম, রংপুর বিভাগ, দিনাজপুর, বান্দরবান,
খুলনা প্রভৃতি জায়গায়
বিশেষভাবে অবকাঠামো গড়ে তোলা,
প্রবাসী আয়ের জন্য বিদেশে
শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে অঞ্চলগুলোকে গুরুত্ব দেয়া এবং এ অঞ্চলগুলোয় আরো অবকাঠামো
গড়ে তোলা, যাতে বাজার ব্যবস্থা সংহত হতে পারে। অষ্টম
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমাদের মূল প্রাধান্য এটা থাকবে।
গত দুই
পরিকল্পনায় আমরা দেখেছি যে বেসরকারি বিনিয়োগ তেমন বাড়েনি। নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে
কীভাবে সেটি বাড়াতে চাইছেন?
আসলে আমরা
চেয়েছিলাম প্রতি বছরই ১০-১১ শতাংশ হারে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাক। বৃদ্ধি
পেয়েছে, তবে সেটি ৩-৪ শতাংশ হারে। একেবারে বৃদ্ধি পায়নি
তা নয়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে হয়নি,
যেটি আমরা চেয়েছিলাম। মনে
রাখতে হবে প্রতি বছর মোট ৯৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আমাদের দেশে হচ্ছে। এর মধ্যে
প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগ। আর সাড়ে ২৪ বা ২৫ বিলিয়ন ডলারই
হচ্ছে সরকারি বিনিয়োগ। সরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে অনেক। মনে রাখতে হবে ২০০৯-১০ অর্থবছরে
যে রফতানির পরিমাণ ছিল, তা সাড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারে
উন্নীত করতে পেরেছি। এটা কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের কারণেই হয়েছে।
রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে। সেটিও তো চলতি বছর এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৬ বিলিয়ন
ডলারে পৌঁছেছে। আশা করা হচ্ছে,
বছর শেষে তা ১৮ বিলিয়ন
ডলারে উন্নীত হবে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আমাদের দেশে হতে পারছে না, এর কারণ নানাভাবে আমাদের দেশ থেকে পুঁজি পাচার হচ্ছে। এটি
তো অস্বীকার করার উপায় নেই। যে কারণেই হোক,
আমাদের দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা শ্রেণীর মধ্যে আস্থাহীনতার একটি প্রভাব তো আছেই। কারণ তারা এ দেশের
বিনিয়োগের একটি অংশ বিনিয়োগ না করে পুঁজি বাইরে নিয়ে গিয়ে বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি
ক্রয় করছেন। কেউ কেউ হয়তো বিদেশে খুচরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে
থাকতে পারেন।
বলা হয়, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থটাই বেশি যাচ্ছে।
যেহেতু এটি
অনুমোদিত পথে যাচ্ছে না, সেহেতু বলতে হবে অবৈধ পথে যাচ্ছে। সেটি হুন্ডির
মাধ্যমে হোক বা আমদানি ও রফতানিতে ওভার ইনভয়েসিং করে হোক কিংবা আন্ডার ইনভয়েসিং
করে হোক।
নিয়ে যাচ্ছে
দেশের টাকাই। আগে যারা এ দেশ থেকে চলে গেছে,
তারাও দেশের স্থাবর
সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। সেটি মালয়েশিয়া হতে পারে, থাইল্যান্ড হতে পারে,
কানাডা হতে পারে। হচ্ছেও
সেটি। এটা এক ধরনের আস্থাহীনতা থেকে হতে পারে। দেশের অর্থ ব্যবস্থা বা
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা অর্থনৈতিক সুশাসন বলি সেটির ব্যর্থতা কিছুটা দায়ী।
আমাদের দেশ থেকে পুঁজি পাচার অনেক আগে থেকে হয়ে আসছে। এটি নতুন নয়। থাইল্যান্ড
থেকে কিন্তু পুঁজি পাচার হয় না। বহুদিন ধরে সেখানে পুঁজি পাচারের কোনো অভিযোগ নেই।
ফিলিপাইন এবং আমাদের দেশে দুর্ভাগ্যবশত পুঁজি পাচার একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেটির মূল
কার্যকারণ হিসেবে কোনো না কোনোভাবে আস্থাহীনতা আছে। হয়তো বিষয়টি আরো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। রাজনৈতিকভাবে বা সমাজতাত্ত্বিকভাবে সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমরা যেটি দেখতে পাই, সেটি হলো বিনিয়োগের একটি অংশ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। কাজেই
পরিকল্পনার দিক থেকে আমরা চাইব আস্থার পরিবেশটা তৈরি হোক। নীতি কাঠামোর মধ্যে এ
পরামর্শ আমরা অবশ্যই রাখব। আস্থার পরিবেশ তৈরি করা, পুঁজি এ দেশে
রাখা এবং বেআইনিভাবে পুঁজি চলে গেলে সেটি নিরোধ করারও পদক্ষেপ নিতে হবে। কার্যকর, দৃশ্যমান পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে হবে এবং সেটি হলেই ক্রমান্বয়ে
পুঁজি যাওয়া বন্ধ হতে পারে। তখন এ দেশে বিনিয়োগের অর্থের অভাব হবে না। কারণ
বিনিয়োগের জন্য যে ভৌত পরিবেশ,
সেটি কিন্তু চমৎকারভাবে
আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে। সরকার কাজটি অত্যন্ত ভালোভাবে করেছে। বিনিয়োগের জন্য যে
অবকাঠামো দরকার ২০০৯-১০ সাল থেকেই সেটি অত্যন্ত দ্রুত গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে।
এমনকি সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে অনেক জোর দিতে বলেছিলাম। তার পরেও
বিদ্যুৎ খাতে, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে। এরও
একটি মূল কারণ ছিল আসলে বিনিয়োগের পরিবেশটি এ দেশে তৈরি করা। এখন যে আমরা ১০০
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি,
সেখানে বিনিয়োগের প্রচুর
সুবিধা বাংলাদেশে তৈরি হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির পূর্ণ নিশ্চয়তা আমরা পেতে যাচ্ছি।
২০২১ সালের মধ্যে এমন কোনো ঘর থাকবে না,
যেখানে বিদ্যুতের সুবিধা
থাকবে না। সেটি দূর অতিক্রম্য অঞ্চল হোক বা সহজগম্য অঞ্চল হোক। আমরা পাব পূর্ণ
আলোকিত দেশ।
দীর্ঘদিন ধরে
দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও আছে। কিন্তু ভয় ও আস্থাহীনতা কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না।
সেজন্য বিশেষ করে পুঁজি পাচার রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের বড় দুর্বলতা হলো, মোট দেশজ উৎপাদনের
(জিডিপি) অংশ হিসেবে রাজস্ব আয় অনেক কম। বিষয়টিতে যদি আমরা মনোযোগ না
দিই, সংস্কারের মাধ্যমে হোক কিংবা সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক পদক্ষেপ
গ্রহণের মাধ্যমে হোক, তাহলে আমাদের ওপর বিদেশীদেরও আস্থাশীলতা অর্জিত
হবে না, যতক্ষণ আমরা নিজের দেশের সম্পদ যথেষ্ট সৃষ্টি
করতে না পারি। কারণ আমাদের দেশে এত প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, যা দেখে বিদেশী বিনিয়োগ আসবে। আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য
দেখলে তারা এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে আসবেন। আর যারা বিনিয়োগ করবেন, তারা চাইবেন যেকোনো সময় আইনসংগতভাবে যেন পুঁজিটা নিয়ে যেতে
পারেন। বাংলাদেশ সরকারকে সেই সামর্থ্য দেখাতে হবে—আমাদের নিজস্ব
অর্থনৈতিক সামর্থ্য যথেষ্ট। বিনিয়োগ করলে তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই, যেকোনো সময় চাইলে পুঁজি নিয়ে চলেও যেতে পারবে। এ ধরনের
নিশ্চয়তা সব দেশকেই দিতে হয় বিদেশী বিনিয়োগের জন্য। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
আরেকটি হলো, আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থায় এক ধরনের অস্থিতিশীলতা আছে। এটা
অস্বীকার করা যাবে না। সেটিও অনেক দিন ধরে চেষ্টা করা হচ্ছিল যে অনেক ব্যাংকের
অনুমোদন দিলে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। মুক্তবাজার বা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে
প্রতিযোগিতাই হলো বড় নিয়ামক। ভোক্তারাও নিম্নতম খরচে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারেন
প্রতিযোগিতার বাজারে। প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হলে ব্যাংক সেবাগুলো সহজে ও স্বল্প
ব্যয়ে গ্রাহক শ্রেণী পেত। আমাদের এখানে অনেক ব্যাংক অথচ সার্ভিসের জন্য গ্রাহকদের
অনেক বেশি চার্জ করে থাকে। এটা প্রতিফলন ঘটায় যে ব্যাংকগুলোর মধ্যে যথেষ্ট
প্রতিযোগিতা নেই। ব্যাংক ব্যবস্থায় অলিখিত
‘কার্টেল’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা,
এটি আমাদের অবশ্যই দেখা
দরকার। কোনো অবস্থায় কার্টেল ব্যবস্থা বা সংগঠিত হয়ে ব্যাংকের কোনো মৌলিক
সিদ্ধান্ত যেন না নিতে পারে,
সেটি নিশ্চিত না করা
পর্যন্ত ব্যাংক খাতের এ অস্থিতিশীলতা সহজেই যাবে বলে মনে হয় না।
পরিকল্পনায় এ
বিষয়ে কোনো পরামর্শ রেখেছেন কি?
এটা অনেক
চ্যালেঞ্জিং। আমি সহজভাবে একটি দুর্বোধ্য সমস্যাকে ব্যাখ্যা করলাম। এটি আমাদের
পরিকল্পনায় অবশ্যই আবেদন থাকবে এবং এটি সরকারেরই পরিকল্পনা। মূলত অনেক অনেক
সংস্কারের জন্যই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করা হয়। এগুলো প্রয়োজন হবে অর্থনীতির
প্রবৃদ্ধিটাকে পরবর্তী ধাপে ধরে রাখার জন্য। স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্য এবং উন্নত
দেশ হতে চাইলে এ সংস্কারগুলো পরিহার করে আমাদের যাওয়ার পথ নেই। তাহলে আমাদের
প্রবৃদ্ধির হার অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। এমনকি প্রবৃদ্ধি হার কমেও যেতে পারে।
সেক্ষেত্রে পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থা,
দেশের প্রতি আস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা, রাজনৈতিক পদ্ধতির প্রতি আস্থা তৈরি করা অপরিহার্য। আস্থা
তৈরি করতে হবে। জনগণকে বার্তা দিতে হবে যে নিয়ম-শৃঙ্খলার বাইরে
গিয়ে কেউ ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবেন না। এটি হলে সব ভোক্তার জন্য তা সুখকর হবে। সব
উৎপাদকদের জন্য সমতল ক্ষেত্র তৈরি হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীই হলেন আসলে
গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদক। আমরা যে অসামঞ্জস্য দেখতে পাই, সেটি মূলত উপরের
শ্রেণীর মধ্যে।
আর্থিক খাত ও
পুঁজিবাজারের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট সুপারিশ রাখছেন কী?
সুখের বিষয় হলো, আমাদের কৃষি খাত চমৎকারভাবে পারফর্ম করেছে, কর্মসম্পাদন করেছে গত ১১টি বছর। সেবা খাতও ভালোভাবে
এগিয়েছে। সেবা খাতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক ভালো করেছে। ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ
ছিল ব্যাপকভাবে। ছোট, মাঝারি ব্যবসায়ীদের কথা বিশেষভাবে বলব। তারা
অর্থনীতির চাকাটা সচল রেখেছেন। আমাদের সেবা খাতের ব্যাপক বিকাশ হয়েছে। পর্যটনেও
বিকাশ হয়েছে। আরো বহুদূরে যেতে হবে। আমাদের ভোগ্যসামগ্রী কিংবা রেস্টুরেন্ট বা
খাদ্য-খাবারের
(হসপিটালিটি সেক্টর) যে বিকাশ ঘটেছে,
সেটি বেশ চমৎকার। আমাদের
প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রেখেছে কৃষি ও সেবা খাত। এ দুটো খাত আমাদের চমৎকার সহায়তা
দিয়েছে। এ সহায়তা আরো হতে পারত,
যদি সেবা খাতের ব্যাংকিং
সেক্টরটি ভালো থাকত। এটি বহুল আলোচিত। সবাই জানে। তার পরও আমরা বলতে চাইব ব্যাংকের
বিকাশের জন্য সরকার অনেক করেছে। অনেক আলোচনা-সমালোচনা সত্ত্বেও প্রতিযোগিতা সৃষ্টির জন্য
ব্যাংকের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এখন এর মধ্যে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
এখানে যেন কোনো গোষ্ঠীবদ্ধ ভূমিকা কেউ না নিতে পারে, সেটি নিশ্চিত
করতে হবে। সুনির্দিষ্ট ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর
‘কার্টেল’ সৃষ্টি কোনো ব্যবসার জন্যই কাম্য নয়। সেটি যদি হয়, তাহলে তা সাধারণ উৎপাদক শ্রেণী ও ভোক্তা শ্রেণীর প্রতিকূলে
যাবেই। ব্যাংকের ক্ষেত্রেও এটি সত্য। কাজেই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে, যেগুলো অনুমোদন হয়েছে,
তার কোনোটিই যদি না-ই চলে বা ভেঙে পড়ে, তাহলে মার্জারে (একত্রীকরণ) যেতে হবে। ব্যাংক একীভূত হওয়া আমাদের দেশে নয়, সব দেশেই আছে। সেই আইনগুলো স্পষ্টায়ন করতে হবে।
একেবারে একটি
অচল ব্যাংককে টাকা দিয়ে সচল করা উচিত নয়। সমর্থন দেয়া যেতে পারে এর সম্ভাব্যতা
যাচাই করে। যদি সেটি না হয়,
তাহলে যেন একত্রীভূতকরণের
সুযোগ সৃষ্টি হয়, সে বিষয়ে আইনকানুনের দিক থেকে আমার মনে হয় আরো
পরিবেশ সৃষ্টি করা ও আইনকানুন তৈরির প্রয়োজন পড়বে। ব্যাংক খাত ভালোভাবে পারফর্ম না
করলে আর কোনো খাতই দীর্ঘদিন ভালো পারফর্ম করতে পারে না। কারণ অর্থ ব্যবস্থা হলো
অর্থনীতির মূল স্রোত, চালিকাশক্তি। সেখানে ব্যবস্থাপনা সঠিক না হলে বা
গোষ্ঠীবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ তৈরি হলে তা সার্বিকভাবে জনগণ ও ব্যবসায়ী
শ্রেণীর প্রতিকূলে যাবে। বিষয়টি অবশ্যই আমাদের দেখতে হবে।
অনেকেই পরিমাণের
চেয়ে গুণগত মানকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। আপনারা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এখানে
গুণগত মানকে কীভাবে রক্ষা করবেন?
আমি মনে করি, মানের জন্য সরকারি ভূমিকাটাই মুখ্য সর্বক্ষেত্রেই। রেফারির
ওপর নির্ভর করে খেলার মান। সেটি বাজারের পণ্য হোক বা নিরাপদ খাদ্য হোক, সেটিও মানের ব্যাপার। মান নিশ্চিত না করলে নিরাপদ খাদ্য
আমরা পেতে পারি না। আর নিরাপদ খাদ্যের প্রতি জনগণের আস্থাশীলতা তৈরি হলে বাজারের
সামগ্রিক চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে। আশঙ্কায় আমরা অনেক প্রক্রিয়াজাত বিভিন্ন পণ্য
খেতে চাই না। ফলফলাদি খেতে চাই না। এসব পণ্যের বিশুদ্ধতা নিয়ে মানুষের মনে গভীর
সন্দেহ আছে। এটি অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। আমাদের প্রবৃদ্ধির একটি বড়
অংশ হলো সামগ্রিক ভোগ ব্যয়। ভোগ ব্যয় যথেষ্ট বাড়ানো গেলে প্রবৃদ্ধিও যথেষ্ট বাড়বে।
বিভিন্ন ভয়ভীতিতে ভোগ ব্যয় সীমিত হয়ে আছে।
শুধু ভোগ্যপণ্য
নয়, শিল্পপণ্যের মানও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেই। যদি এটি প্রমাণিত
হয় তাহলে আমরা কিন্তু রফতানি বাড়াতে পারব না। আর যদি ক্রমান্বয়ে আমরা মান রক্ষা
করতে পারি তাহলে আমাদের পণ্যের চাহিদা সারা বিশ্বেই বেড়ে যাবে। সেটি বাড়ার জন্য
একমাত্র অবলম্বন হলো পণ্যের মান নিশ্চিত করা। পণ্যের মান নিশ্চিত করতে হলে
প্রযুক্তির ওপর বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। তাতেও হবে না, প্রতিটি বড় উৎপাদন
প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি গবেষণা ব্যয় বাড়াতে হবে। গবেষণার মানে হলো, কীভাবে পণ্যের মান উন্নয়ন করা যায়, খরচ কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, ডিজাইনের দিক
থেকে পণ্যকে আরো কীভাবে আকর্ষণীয় করা যায়। এক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত গবেষণা করতে হবে।
এটা শুধু সরকারি গবেষণা দিয়ে হবে না,
সরকার তো করবেই। বড় বড়
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি অংশের এখন গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে। সরকারের দিক থেকে
প্রতিনিয়ত নিরীক্ষণ-পরিবীক্ষণ থাকতে হবে। যে পণ্যই বাজারে আসবে তার
মান নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য বিএসটিআইয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিএসটিআই যেসব
পণ্যে সিল দেবে, মানুষ যেন মেনে নেয় যে তা খাওয়া যায়। এ আস্থা
তৈরি করতে হবে।
শিক্ষা খাতেও
মান আমাদের ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। আধুনিক পাঠক্রম, শিক্ষা পদ্ধতি, মূল্যবোধে জোর দিতে হবে। শিক্ষা অবশ্যই মূল্যবোধতাড়িত হতে
হবে। শিক্ষার মধ্যে দেশপ্রেম,
সমাজপ্রেম বা সমাজের প্রতি
অনুভূতি এ বিষয়গুলো সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি ধর্মীয় শিক্ষাও যদি আধুনিক
নীতিবোধতাড়িত না হয়, তাহলে সেটিও খুব একটা কার্যকর হয় না। সম্ভবত শুধু
ধর্মীয় শিক্ষা দিয়েও মানুষকে নৈতিক বানানো যায় না, যা আমরা অহরহ
দেখছি নানা অপকর্মের ঘটনায়। শিশুদের প্রতি নির্যাতন, নারীদের প্রতি
নির্যাতনে এটি প্রমাণিত হয় যে ধর্মশিক্ষাও যথেষ্ট নয় একজন মানুষকে নীতিমান হিসেবে
গড়ে তুলতে। একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ে তুলতে হলে সত্যিকার অর্থে আধুনিক শিক্ষায়
বা বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষায় আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শিক্ষার মানের প্রশ্নটি নিয়ে
এখন ব্যাপক বলা হচ্ছে। সংখ্যার দিক থেকে আমরা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি।
সাধারণ শিক্ষার জন্য আর তেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না গড়ে তুললেও বোধহয় চলবে। কারণ
একসময় আমাদের জনসংখ্যা কমতে থাকবে। আমরা এটা রুখতে পারব না।
আজ থেকে ৪০
বছরের মধ্যে জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে। এটি মাথায় রাখতে হবে। কাজেই এমন প্রতিষ্ঠান
গড়ব না, ২০-৩০ বছর পর এটি প্রয়োজন হবে না। এখন থেকে এভাবে
পরিকল্পনা করে আমাদের এগোতে হবে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি, সেগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে এনে পরিচালনা করা, দক্ষভাবে পরিচালনা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং যেসব
প্রতিষ্ঠানে কী কর্মসম্পাদন হচ্ছে,
সেটি নিরীক্ষণ করা সরকারের
দায়িত্ব। এ বিষয়গুলোকেও আমরা মূল পরিকল্পনার চেতনায় ধরতে চাইব। এখন প্রতিটি
ক্ষেত্রে মানোন্নয়নের প্রশ্নটি অতি প্রাসঙ্গিক। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আমরা উন্নততর
দেশের দিকে যাচ্ছি। উন্নততর দেশ মানে মূল্যবোধের দিক থেকেও উন্নততর হতে হবে।
বিশ্বাসবোধ ও ব্যবহারের দিক থেকেও আমাদের উন্নত হতে হবে। আমাদের বৈষয়িক অনেক
পরিবর্তন হয়েছে, ভৌত অনেক সুবিধা আমাদের হাতের কাছে এসেছে, হাতের মুঠোয় আমাদের অনেক প্রযুক্তি এসেছে। কিন্তু
মনমানসিকতায় এখনো কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি। মনোজগতের পরিবর্তনটা খুব
ধীরগতিতে হচ্ছে বাংলাদেশে। অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধি যেভাবে দ্রুত এগোচ্ছে,
তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে
আমাদের মানবচেতনা শাণিত হচ্ছে না। এটা হলো আমার ধারণা। এ পরিবর্তনের বিষয়টি
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বেসরকারি
বিনিয়োগে অবকাঠামো বড় ধরনের সমর্থন জোগায়। কিন্তু এখানে মানসম্পন্ন সড়ক, রেল ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে না। পরবর্তী পরিকল্পনায় এটাতে
প্রাধিকার দিচ্ছেন কি?
আমরা বহু
দালানকোঠা গড়ে তুলেছি। অবকাঠামো গড়ে তুলেছি। অনেক বাঁধ গড়ে তুলেছি। অনেক সড়ক-জনপথ গড়ে তুলেছি। এগুলো সংরক্ষণ-রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এজন্য ব্যয় রাখতে হবে।
এটি সম্পর্কে অতীতে আমাদের ধ্যানধারণা ছিল না। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেন, বড় বড় সড়ক-জনপথ,
সেতু, কালভার্টে পরিবহনের জন্য টোল নিতে হবে। অর্থাৎ এটার যে
সংরক্ষণ ব্যয়, সেটি কোথা থেকে আসবে, সে বিষয়ে আমাদের ভাবনা থাকতে হবে। বিশেষভাবে সুবিধা
ব্যবহারকারীর কাছ থেকেও অর্থ আদায় করতে হবে। যে ব্যবহার করবে, সে-ই অর্থ পরিশোধ করবে। এ নীতি দুনিয়ার সর্বত্রই
প্রচলিত। বিভিন্ন সুবিধাসংবলিত বড় অবকাঠামো ব্যবহার করলে অবশ্যই ব্যবহারকারীকে
একটা ফি বা টোল দিতে হবে। এটি এ কারণে নয় যে সরকার আয় করবে। এর উদ্দেশ্য সংরক্ষণ
ব্যয় মেটানো। ভবিষ্যতে এটি ভেঙে গেলে বা ধ্বংস হয়ে গেলে যেন আরেকটি তৈরি করা যায়, সেই সম্পদ সৃষ্টি করা। কাজেই সামগ্রিক যে ভৌত কাঠামো, এর মান নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। মানোন্নয়নের বিষয়টি আমাদের
সামগ্রিক জীবনের সঙ্গে পরিব্যাপ্ত। শিক্ষা,
পণ্য থেকে শুরু করে ভৌত
অবকাঠামোসহ সর্বত্র এখন মানসম্মত জীবনধারণের দিকে আমাদের যেতে হবে। সরকারের কাজ
হবে পরিবীক্ষণ। এজন্য সরকারকে সবার সরকার হয়ে উঠতে হবে। সুশাসনের জন্যই এটি
প্রয়োজন। এছাড়া আমাদের বিকল্প নেই।
আমরা একটা
স্বপ্নতাড়িত জাতি। আমাদের সামনে স্বপ্ন আছে অনেক। উচ্চতর স্বপ্ন। আমরা উচ্চ
প্রবৃদ্ধির দেশ হব। শুধু টাকা-পয়সার প্রবৃদ্ধি নয় বা ভৌত সুযোগ-সুবিধার দেশ নয়। উচ্চ মানবিক মূল্যবোধের একটি দেশ আমাদের গড়ে তুলতে হবে। এটা
ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা ভৌত প্রবৃদ্ধি যেকোনো মুহূর্তে অসার হয়ে যেতে পারে, যদি মানবিকভাবে আমাদের উত্তরণ না ঘটে, বহু দেশ কিন্তু অনেক এগিয়েও পিছিয়েছে, এ রকম বহু নজির আছে। কাজেই আমাদের জোর দিতে হবে ভৌত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক উন্নয়নে। সেই সঙ্গে মানবিক
মূল্যবোধের যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
[চলবে]
শ্রুতলিখন: হুমায়ুন কবির