ভূমি ব্যবস্থাপনা

জনভোগান্তি নিরসনে অটোমেশন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে হবে

উত্তরাধিকার-ভিত্তিক জমি হস্তান্তরে পদ্ধতিগত দুর্বলতা ও দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোর মধ্য দিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা বেশ জটিলতাপূর্ণ। ফলে ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ ও জনহয়রানি এখানে একটি পুরনো সমস্যা। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে ৮০ শতাংশ ফৌজদারি মামলাই জমিসংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে। গ্রামগঞ্জে মারামারির অন্যতম কারণও এটি। সেই বিবেচনায় বিরোধ এড়িয়ে নির্ঝঞ্ঝাটে জমির মালিকানা নিশ্চিত এখানে প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি আরাধ্য বিষয়। কিন্তু ভূমি ব্যবস্থাপনার প্রশাসনিক প্রক্রিয়াটি এখানে সহজ নয়। এজন্য ভূমিসংক্রান্ত যেকোনো সেবা পেতে সেবাপ্রার্থীকে নানা রকম হয়রানির শিকার হতে হয়। নকশা খতিয়ান থেকে শুরু করে দলিল-দস্তাবেজ ঘিরে রয়েছে নানা অনিয়ম। অধিকন্তু অর্পিত সম্পত্তি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বিদ্যমান বৈচিত্র্যময় জটিলতা। এছাড়া বহু সরকারি জমি ব্যক্তির নামে এবং ব্যক্তির জমি সরকারের নামে রেকর্ড হওয়ার অভিযোগও এন্তার। এসব কারণে ভূমি নিয়ে ঘরে ঘরে বিবাদ এখানে নিত্যকার ঘটনা। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, আদালতে ভূমিসংক্রান্ত ১৮ লাখের অধিক মামলা চলমান। এসব বিড়ম্বনা থেকে দেশবাসীকে রেহাই দিতে ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল করার বিষয়টি অনেক দিনের একটি আলোচিত ইস্যু।

যুগ চাহিদার বাস্তবতায় সংগত কারণেই ভূমিসংক্রান্ত হয়রানি রোধে সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন করার উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন ভূমি অফিসে অনলাইনে খতিয়ান সরবরাহ, -নামজারি ও ই-সেটলমেন্ট কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু সেই কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিত গতি পায়নি। ফলে মানুষের ভোগান্তির নিরসন হচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী অটোমেশন প্রক্রিয়ায় সাতদিনের মধ্যে নামজারি হওয়ার কথা। অথচ বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে এক গ্রাহক ছয় মাস ঘুরেও নামজারি করতে পারেননি। শুধু নামজারি নয়; জমি কেনাবেচা, রেকর্ড, জরিপ, খাজনা পরিশোধ, ঋণ নিয়ে জমি বন্ধক ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেগ পেতে হচ্ছে সেবাগ্রহীতাকে। বলা যায়, অটোমেশন কার্যক্রমের ঢিমেতালে প্রত্যাশিত সুফল পাচ্ছে না মানুষ। যথাসম্ভব দ্রুত এ অবস্থার উত্তরণ জরুরি।

এদিকে ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা থিতিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, সার্ভার জটিলতা এবং মাঠপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনাগ্রহ। এ কারণগুলো সমাধান করা কঠিন নয়। তবে তার জন্য চাই ভূমি অধিদপ্তরের নজরদারি ও সক্রিয়তা। একই সঙ্গে নিশ্চিত করা চাই প্রশাসনিক জবাবদিহিতার সংস্কৃতি। বর্তমানে পাইলট ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশনের প্রকল্প চলমান। এর কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে, কিছু বাস্তবায়নাধীন। এসব প্রকল্পের সুফল কেন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।  মূলত জটিলতা, হয়রানি ও অনিয়ম নিরসনই ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশনের প্রধান উদ্দেশ্য। সেটি অর্জিত না হলে অর্থের অপচয় হবে মাত্র, জনভোগান্তি এতটুকু কমবে না। কাজেই সর্বোচ্চ সুফল নিশ্চিতে সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনপূর্বক ভূমি মন্ত্রণালয় তথা সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরকে ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে হবে।  

সংশ্লিষ্টরা অটোমেশন সেবা নিশ্চিতের জন্য ই-তথ্য ব্যবস্থাপনা, দক্ষ জনবল ও সার্বক্ষণিক সেবা চালু রাখার জন্য যে ধরনের আইটি সেবা প্রয়োজন, তা একটি সক্রিয় ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসায় জোর দিচ্ছেন। তা না হলে সাধারণ মানুষের কাছে সেবা পৌঁছানো সহজ হবে না। সেটি বিবেচনায় নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপ কাম্য। ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বয়ংক্রিয়তার সফল প্রয়োগ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় নজির হয়ে আছে। সেসব দেশে জনগণ এর প্রত্যক্ষ সুফল পাচ্ছে। কোন প্রক্রিয়ায় দেশগুলো ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা এগিয়ে নিয়ে গেছে, সেসব অভিজ্ঞতা আমরা আমলে নিতে পারি। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে সরকার টু সরকার পর্যায়ে মিথস্ক্রিয়ার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ডিজিটালাইজেশন বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি এবং সর্বক্ষেত্রে এটির ব্যবহারের কারণে জনগণের কাছে অনেক সেবা সহজলভ্য হয়েছে। তেমনি ভূমি ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি ডিজিটালাইজেশনের মধ্যে নিয়ে এলে দেশে ভূমিসংক্রান্ত হয়রানি বন্ধ হবে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। সুতরাং বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অটোমেশন কার্যক্রম আরো জোরদারে সংশ্লিষ্টদের সক্রিয়তা আশা করব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন