গোলাম মুস্তাফাকে বলতে পেরেছি ‘আপনার অভিনয় আমার ভালো লাগে’

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শক্তিমান অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা। তিতাস একটি নদীর নাম, উপহার ও বলাকা মন-এর মতো ছবিতে তার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী কবরী সারোয়ার। অভিনয়ের সুবাদেই জ্যেষ্ঠ এ অভিনেতার সঙ্গে কবরীর গড়ে উঠেছিল চমত্কার এক সম্পর্ক। গোলাম মুস্তাফার আজ ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাকে নিয়ে প্রথমবারের মতো স্মৃতিচারণ করেছেন এ অভিনেত্রী। টকিজের পাঠকদের জন্য স্মৃতিচারণটি তুলে ধরা হলো

.

প্রযোজক হিসেবে আমি যখন কাজ শুরু করি, মূলত তখন থেকেই অভিনেতা গোলাম মুস্তাফার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত। এর আগে তার সঙ্গে সে অর্থে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। একটাই কারণ, তিনি যখন চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা, তখন আমি ছবির জগতেই পা রাখিনি, তিনি আমাদের চেয়ে অনেক বড়।

.

সুতরাং ছবির মাধ্যমে অভিষেকের পর থেকে নিয়মিত অভিনয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম এবং সবার কাছে এক নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। সে সময় কবরী-রাজ্জাক জুটির ছবি মানেই ব্লকবাস্টার, সুপারডুপার হিট; ঠিক সে রকম একটা সময়ে জ্যেষ্ঠ এ অভিনেতার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। আমার সৌভাগ্য যে আমার প্রযোজিত উপহার ও বলাকা মন ছবিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আর আমিও তার সঙ্গে অভিনয় করেছিলাম।

.

মুস্তাফা ভাই আমাকে শ্রীমতি বলে সম্মোধন করতেন। অন্য কোনো ছবির সেটে কাজ করলেও ফুরসত পেলেই আমাদের সঙ্গে গল্প করতে আসতেন। তার সঙ্গে কথা বলে, কাছ থেকে দেখে তাকে নিয়ে আমার একটা ধারণা জন্মেছে, তার স্নেহের ধরনটা ছিল কিছুটা কাব্যিক। সহশিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মতো বিষয়গুলোও তার মধ্যে উপস্থিত ছিল ঢের। সবকিছু মিলিয়ে খুবই সৌন্দর্যপ্রবণ ও শিল্পীসুলভ আচরণ তিনি সবার সঙ্গে করতেন। অন্যদের বেলায় কী করেছেন বলতে পারব না কিন্তু সহশিল্পী হিসেবে আমার ও রোজী আফসারীর প্রতি তার বিশেষ সহমর্মিতা ও ভালোবাসার একটা জায়গা ছিল বরাবরই। আবার এ ভালোবাসাটা ঠিক সমসাময়িকদের মতো নয়। একটু দূরত্ব বজায় রেখে শ্রদ্ধা ও স্নেহের আবরণে মোড়ানো ছিল সে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

.

মুস্তাফা ভাই, রাজ্জাক, ববিতা, সুজাতাসহ আমরা সবাই মিলে মস্কোয় চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়েছিলাম একবার। আমরা ওখানে খুব আনন্দ করেছিলাম। সেখানেও খেয়াল করেছি, মুস্তাফা ভাই অভিভাবকের মতোই আমাদের আগলে রাখতেন। কাজের সুবাদে হয়তো তার সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হতে পারে কিন্তু ঝগড়া-বিবাদের মতো কিছু ঘটেনি। মানুষ বলে না, সম্পর্কের টানাপড়েন, তো এ রকম কিছু ছিল না আমাদের সম্পর্কে। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল প্রাণখোলা ও নির্মল আকাশের মতো সুন্দর। যদিও অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ওনার বাড়ির ভেতরও কখনো যাওয়া হয়নি আমার। কিন্তু আমাদের যতটুকু পরিধি ছিল, সেই সীমানার মধ্যে তার এবং আমার সম্পর্কের উষ্ণতার মাত্রা ছিল সত্যিই অনন্য।

.

চলচ্চিত্রে চরিত্র ধারণের যে আবহ গোলাম মুস্তাফার মধ্যে বিরাজমান ছিল, তা তার ব্যক্তিগত চরিত্রের সঙ্গেও অনেক মিল ছিল বলে আমার মনে হয়। এ কথা দিয়ে বোঝাতে চাইছি, তার ব্যক্তিত্বের প্রভাবটা অভিনয়ের চরিত্রায়ণেও প্রকাশ পেত। তার সঙ্গে আমি যে ধরনের ছবিতে কাজ করেছি, তাতেহা হা হা, মেরে ফেলব, কেটে ফেলব’—এ রকম কোনো সংলাপ বা আবহ ছিল না। তিনি সবসময়ই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করে নিয়েছিলেন, যা ছিল আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটা নতুন মাত্রা। গোলাম মুস্তাফা খলচরিত্রে অভিনয় করেছেন বিষয়টি শুধু এ রকম নয়। এর মানে হলো, ভিলেনরাও সুন্দর-স্মার্ট হতে পারে। অতি অভিনয়, উচ্চস্বরে সংলাপ না দিয়েও একজন খলনায়ক অভিনয় করতে পারে, তা তিনি করে দেখিয়েছেন সাবলীলভাবে; যা বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রির জন্য বড় পাওয়া।

.

গোলাম মুস্তাফা খল অভিনেতা হিসেবে যে দক্ষতা নিয়ে কাজ করে গেছেন, তিনি চলে যাওয়ার পর অন্যদের মধ্যে সে ধারাবাহিকতা দেখা গেল না কেন কিংবা পরম্পরাটা তৈরি হলো না কেন? এর উত্তরে আমার পর্যবেক্ষণ, কারো অভিনয়জীবন আসলে কপি করা যায় না কিন্তু এ থেকে ধারণা নেয়া যায়। একইভাবে তার কাছ থেকে যদি কেউ কিছু গ্রহণ করতে পারে, তা তারই একান্ত বিষয়। তবে আমি শুধু বলব, মুস্তাফা ভাইয়ের পর অন্য অনেকেই হয়তো খলনায়ক হয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছেন কিন্তু তার মতো কেউই এত বেশি ভার্সেটাইল ছিলেন না।


.

ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম ছবিতে তার সঙ্গে অভিনয় করেছি। তিনি ছবিটিতে হিন্দু-মুসলমান দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সব চরিত্রের মধ্যে ঢুকে পড়ার যে সক্ষমতা একজন শক্তিমান অভিনেতার থাকে, তা তার মধ্যে প্রবলভাবে উপস্থিত ছিল। আমি মনে করি, এর পেছনে তার লেখাপড়া, অভিনয়ের পূর্বচর্চা প্রভাব রেখেছে। তিনি অসম্ভব ভালো আবৃত্তি করতেনসব মিলিয়ে তিনি নিজেকে নিয়ে ভাবতেন, চিন্তা করতেন, যার ছাপ পড়ত অভিনয়ে। তিনিস্থূল ছবিতেও অভিনয় করেছেন। তবে ওই ছবিগুলো নিয়ে খুব একটা ভাবতেন না, এ কথা তিনি নিজেই বলেছেন। আমাকে একদিন বলেছিলেন, ‘শ্রীমতি শুনেছেন, ডিরেক্টর কী বলে। আসলে তখনকার সময় সবার সম্পর্কের মধ্যে একটা সম্মানবোধ ছিল, তিনিও সবাইকে সম্মান করতেন। যে কারণে ওনাকে তখনো দেখেছি, ডিরেক্টর যদি কোনো কিছু জোর করে বলতেন, তিনি তাকে বুঝিয়ে বলতেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি যখন এত করে বলছেন তাহলে আপনার মতো করেই করি কিন্তু আমি হলে এমনটি করতাম না। এ কথার মধ্য দিয়ে হয়তো তার মধ্যে যে একটা চাপা রাগ ছিল তা বোঝা যেত, কিন্তু কোনোভাবেই তিনি সেই রাগ প্রকাশ করতেন না। যখন আমরা তিতাস একটি নদীর নাম করি, তখন আমরা কাদামাটিতে বসে মুড়ি খেতাম, গল্প করতাম, নৌকার মধ্যে তিনি আবৃত্তি করতেন। ঋত্বিক ঘটক তখন গাইতেনতুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা...’ আর আমরা সবাই শুনতাম। আসলে এ রকম    হূদ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যেই চলচ্চিত্রজগতে আমার বেড়ে ওঠা।

.

শুটিং সেটে গোলাম মুস্তাফা সবসময় একটা বই হাতে রাখতেন। অবসর পেলেই তা পড়া শুরু করে দিতেন। এটা দেখে ওই ছোট্ট বয়সে ভাবতাম, আমিও তো একটা বই নিয়ে আসতে পারি। এরপর তাকে এও বলেছি, ‘আপনি তো বই পড়তে পারেন, কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন, আমাদের এগুলো শেখান না কেন?’ তিনি শুনে হাসতেন। 

.

দীর্ঘ সময় ধরে এ মানুষটিকে নিয়ে কোনো আলোচনা, কথাবার্তা নেই। আসলে আলাপ না থাকলে স্মৃতিরা ডানা মেলতে পারে না। ছোট্ট একটি গাছকে যদি ইট দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা হয়, তাহলে তা বাঁচতে পারে না নিশ্চয়ই। একইভাবে মানুষের স্মৃতিকেও বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে তা নিয়ে কথা বলতে হয়। তাহলে যাকে নিয়ে আলোচনা হয়, তিনিও বিরাজমান থাকেন সবার সামনে। গোলাম মুস্তাফার জীবদ্দশায় তার সঙ্গে কথা বলেছি, বলতে পেরেছি—‘আপনার অভিনয় আমার ভালো লাগে। কিন্তু কখনো এভাবে এত খোলামেলাভাবে তাকে নিয়ে কথা বলা হয়ে ওঠেনি, আজ বললাম। আমার স্মৃতির কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

 

অনুলিখন: রুবেল পারভেজ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন