জাপানের ঐতিহ্যবাহী বিষাক্ত বোলতা খাওয়ার উৎসব

বণিক বার্তা অনলাইন

বোলতার কামড় খেয়ে শরীর তো অনেকেই ফুলিয়েছেন। কিন্তু বোলতা বা বোলতার লার্ভার স্বাদ কি কখনো নিয়েছেন? এটি খেতে নাকি বেশ নরম, ক্রিমি আর সুস্বাদু! জাপানে বোলতার খাওয়ার প্রচলন একেবারে কমে গেলেও দেশটির এনা জেলার কুশিহারা গ্রামের মানুষেরা আজও তাদের এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এমনকি তারা এই পতঙ্গকে নিয়ে প্রতিবছর নভেম্বরের প্রথম রোববার উৎসবের আয়োজন করে থাকে। ‘কুশিহারা হেবো মাশতুরি’ নামের এ উৎসব রীতিমতো জাতীয় টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়।

কুশিহারা গ্রামে কালো বোলতার দুটি প্রজাতি ‘হেবো’ নামেই পরিচিত। এগুলো তেমন আগ্রাসী না হওয়ায় সহজেই ধরা যায়। সংগ্রহ করা হয় লার্ভাসহ বোলতার বাসা। বেশ দামি বোলতার বাসা। এক কেজি ওজনের একটি বাসার মূল্য ৬৪ পাউন্ড। ‘কুশিহারা হেবো মাশতুরি’ উৎসবটি নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে উদযাপন করা হয়। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে শুরু এই ব্যতিক্রমধর্মী উৎসব। গানের তালে তালে বোলতার প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করেন স্থানীয়রা। নানা রকম খাবার আর পানীয় হিসেবে বোলতা হয়ে ওঠে উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। 

উৎসবে প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়। যার বোলতার বাসার ওজন সবচেয়ে বেশি হয়, তার হাতে ওঠে জয়ের ট্রফি। এ জয় তাদের কাছে সম্মানজনক। অনুষ্ঠানে আসা দর্শণার্থীরা ইচ্ছে করে বোলতার দু’একটা কামড় উপভোগ করেন! কেউ কেউ কিনে নিয়ে যান বাড়িতে রান্না করে করে খাবেন বলে।

জাপানের অন্যান্য গ্রামের মতো কুশিহারা ছেড়ে উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে মানুষ। ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এখানকার জনসংখ্যা ১২ শতাংশ কমে দাঁড়ায় মাত্র ৫১ হাজার ৭৩ জনে। একই সঙ্গে বোলতা শিকারীর সংখ্যাও দিনে দিনে কমে আসতে থাকে। ১৯৯৩ সালে শুরু হয় ‘কুশিহারা হেবো মাশতুরি’। শিকারীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে ২০১০ সালে এই উৎসব বন্ধ করে দিতে দিয়েছিলেন আয়োজকেরা। তখনই এগিয়ে আসে নতুন প্রজন্ম। গ্রামের তরুণরা বড়দের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিবছর এই উৎসবের আয়োজন করে যাচ্ছে।

৪২ বছর বয়সী স্থানীয় ফরেস্ট রেঞ্জার দাইসুক মিয়াকে বলেন, হেবো ভালোবাসে এমন একটি মানুষ জীবিত থাকলেও তারা এ উৎসব চালিয়ে যাবেন। তার কাছে হেবো হলো মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার একটি উপলক্ষ। ছয় বছর আগে মিয়াকে এবং শহরের কিছু তরুণ এই উৎসব পরিচালনার দায়িত্ব নেন।

বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। গ্রীষ্মের শুরুতেই শিকারীর দল পাহাড়ে অবস্থান নেয়। গভীর জঙ্গলে এক টুকরো সাদা কাগজের উপর তাজা মাছের টুকরো রেখে ওঁৎ পেতে বসে থাকে শিকারী। কোনো বোলতা এসে মাছের টুকরোটি মুখে নিয়ে উড়াল দিয়ে কাগজের টুকরোটিও সঙ্গে লেগে থাকে। ফলে সহজেই বোলতাটি গতিবিধি লক্ষ্য করা যায়। তখন শিকারীরা একে অনুসরণ করে পৌঁছে যায় বোলতার বাসায়। মাটি থেকে সযত্নে বাসাটি তুলে একটি কাঠের বাক্সে স্থানান্তর করা হয়। এরপর শরৎকাল পর্যন্ত এই বাক্সেই বোলতাগুলোর লালন পালন করা হয়। উৎসবের আগে যাতে প্রচুর বোলতা ও লার্ভা পাওয়া যায় সে জন্য এগুলোকে নিয়মিত পানি, চিনি ও কাঁচা মাংস খাওয়ানো হয়। 

টোকিওর রিক্কিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারডিসিপ্লিনারি কালচারাল স্টাডিজের অধ্যাপক কেনিচি নোনাকার মতে, বোলতা খাওয়ার ঐতিহ্য আজ জাপানে মৃতপ্রায়। তবে আশার কথা হলো কুশিহারা এই চর্চা হারিয়ে যেতে দেয়নি। তিনি প্রায় ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই অঞ্চল নিয়ে গবেষণা করছেন। অনেকে মনে করেন, এক সময় এখানকার লোকদের জন্য বোলতা আমিষের একটি মূল্যবান উৎস ছিল। তবে এ তত্ত্বের সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেন নোনাক। কেননা ১০০ গ্রাম হেবোতে অন্য উৎসের তুলনায় বেশি আমিষ আছে এটা সত্য, তবে বাস্তবে কেউ একসঙ্গে এই পরিমাণ বোলতা বা লার্ভা খায় না। 

অবশ্য জাপানের বিভিন্ন স্থানে হেবোকে সম্পূরক খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। শুধু খাওয়ার জন্যই হেবো সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু কুশিহারার লোকেরা কিছুটা ব্যতিক্রম। তারা এ হেবো সংগ্রহকে একটি সামাজিক কর্মসূচি হিসেবে নেয় এবং এগুলোকে বাড়ির পাশেই লালনপালন করে। কেবলমাত্র মুনাফা লাভের আশায় নয়। বোলতা-শিকার অনুশীলন স্থানীয়দের সংস্কৃতি এবং পরিচয় বহন করে। এটা তাদের একটা শখ।

সূত্র: বিবিসি

ভিডিও দেখুন...

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন