নাঈমা খুলনা শহরের একটি নামি বেসরকারি স্কুল থেকে এ বছর একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে।
শ্রেণী কার্যক্রম পরিদর্শনের ফাঁকে নাঈমার সঙ্গে কথা হলো।
মেয়েটি অকপটে যা বলল, তাতে আমি অভিভূত।
সে
বলল, তার মা-বাবা তাকে বেশি বেতন দিয়ে পড়াতে পারবে না বলে এখানে ভর্তি করে দিয়েছে।
কিন্তু নাঈমা এখন খুব খুশি! প্রথমে ওর খুব খারাপ লেগেছিল এত দিনের পরিচিত স্কুল ছেড়ে আসতে।
তবে এখানে আসতেই সে সহজে সবার সঙ্গে মিশে গেছে এবং স্কুলের নানা কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
শিক্ষকরা ক্লাসেই পড়া তৈরি করে দেন বলে স্কুলের পর কোচিংয়ের চাপ নেই।
স্কুলের বর্তমান সময়সূচিও তার খুব ভালো লাগে।
ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে খানিক হই-হুল্লোড় করার অবসর পাওয়া যায়।
এখানে সবাই খুব আন্তরিক।
স্কুলের খোলামেলা পরিবেশে তারা সব শিক্ষার্থী মিলে আনন্দে সময় কাটায়।
নাঈমার মতো আরো অনেকেরই একই অভিব্যক্তি।
প্রাথমিক শিক্ষা প্রসঙ্গ এলে তিন দশক আগের যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছবি ফুটে ওঠে, আমার চোখে আজ তা অনেকখানি বদলে গেছে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগে।
এ
উন্নয়ন আমরা খালি চোখেই দেখতে পারি।
যেমন সুপরিসর বিদ্যালয় ভবন, সজ্জিত শ্রেণীকক্ষ, উচ্চশিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক, বিসিএস যোগ্যতাসম্পন্ন প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তা, কার্যকর ব্যবস্থাপনা কমিটি, বছর বছর লক্ষাধিক টাকার আনুষঙ্গিক ব্যয় বরাদ্দ, শিক্ষকদের নিয়মিত সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধাসহ পাঠদানের জন্য বিশেষায়িত শ্রেণীকক্ষ, কয়েকশ শিক্ষক-কর্মকর্তার বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণ, শখানেক বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারী শিক্ষা কর্মকর্তা, দেশ ও দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার সুযোগসংবলিত পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম, সব শিশুর জন্য উপবৃত্তি ও বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিল প্রচলন, সহশিক্ষাক্রমিক কাজকে সমান গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া, উদ্ভাবন উদ্যোগকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া, শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের বিজ্ঞানসম্মত কারিকুলাম দ্বারা পরিচালিত প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী, বিদ্যালয়কে আকর্ষণীয় করার আরো নানা উদ্যোগ তো আছেই।
সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষার কারিকুলাম পরিমার্জনের কাজও এগিয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে।
উন্নত জাতি গড়ার জন্য যে রকম বিশ্বমানের প্রাথমিক শিক্ষা প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করতেই এত আয়োজন।
পরিবর্তিত এ প্রেক্ষাপটে সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়া এখন সময়ের দাবি।
আমার কর্মস্থল খুলনা মহানগরীতে ১২৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
যেখানে প্রায় এক হাজার শিক্ষক কর্মরত।
যাদের একাডেমিক যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ ও কাজের অভিজ্ঞতা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাদানের জন্য এ দেশে সর্বোত্তম পর্যায়ের।
কেননা তারা সবাই চাকরিতে আসার পর সিইনএড কিংবা ডিপিএডের মতো দীর্ঘ পেশাগত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং নিয়মিতভাবে স্বল্পমেয়াদি ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন।
এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় সবারই রয়েছে সুপরিসর বিদ্যালয় ভবন এবং উপরোল্লিখিত সুবিধাদিযুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা কাঠামো।
বিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশই নিজ নিজ ক্যাচমেন্ট এলাকার শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা সেবার সুযোগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
অথচ এসব বিদ্যালয় শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুদেরই কেবল আকৃষ্ট করতে পেরেছে বিনা মূল্যের শিক্ষাসেবা দিয়ে।
শহরের সামর্থ্যবান অভিভাবকরা কেউই তাদের সন্তানের জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে পছন্দের তালিকায় রাখছেন না।
তারা টাকা দিয়ে সন্তানের জন্য শিক্ষা কিনে নিচ্ছেন, এমন সব দোকান থেকে যাদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ন্যূনতম কোনো যোগ্যতার মানদণ্ডে পরিমাপ করা হয়নি আজ পর্যন্ত।
সামর্থ্যবানরা কেন এমনটি করছেন? উত্তর খুঁজলে বেরিয়ে আসে কিছু প্রচলিত ধারণার প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা।
প্রথমত, তারা মনে করেন শহরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেহেতু গরিবের সন্তানেরা ফ্রি লেখাপড়ার জন্য যায়, এখানকার পরিবেশ ভালো নয়।
উপরন্তু এদের ভাষা, আচরণ আমাদের তথাকথিত ভদ্রশ্রেণীর মানুষের মতো নয়।
কোনো কোনো সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকও এ ধারণার বশবর্তী হয়ে নিজের সন্তানকে নিজের বিদ্যালয়েই শিক্ষার জন্য নিয়ে যান না, যদি ওইসব শিশুর মুখের ভাষা ও আচরণ দ্বারা তার সন্তান প্রভাবিত হয়।
তিনি হয়তো জানেন না সমাজের সিংহভাগ খেটে খাওয়া মানুষের ভাষা ও আচরণের মধ্যে শিশুর জীবনের বাস্তবমুখী শিক্ষার বীজ রোপিত।
অথবা তিনি নিজে যে বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সেখানে তার নিজের সন্তানকে পড়াতে না পারার লজ্জা হয়তো তাকে স্পর্শ করে না।
দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ পিতা-মাতা লেখা আর পড়া শেখাকেই শিক্ষার চূড়ান্ত বলে ধরে নেন।
ফলে এ লেখা আর পড়া যেখানে সুলভে কিনতে পাওয়া যায়, তারা সেখানেই ভিড় জমান।
প্রাথমিক শিক্ষা যে শুধু লেখা আর পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এই ভাবনা হয়তো তাদের বিচলিত করতে পারে না।
তৃতীয়ত, নিজের সামর্থ্যের সবটুকু বিনিয়োগ করে হলেও সমাজের প্রচলিত প্রথায় নিজের সন্তানের জন্য একটা দামি স্কুলের বন্দোবস্ত করতে পারলে যে মর্যাদা ও আত্মতৃপ্তি লাভ হয়, তার সঙ্গে আর কিছুরই তুলনা চলে না।
অথচ আজকে যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে মেধার স্বাক্ষর রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তাদের প্রাথমিক শিক্ষার বৃত্তান্ত আমাদের সামনে সহজেই দৃশ্যমান।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনা মূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগকে যারা অবজ্ঞার চোখে দেখেন কিংবা মনে করেন এখানে ভালো শিক্ষা সম্ভব নয়, তাদের জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে প্রস্তুত।
আমি এখানে শুধু খুলনা মহানগরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র তুলে ধরছি।
শহরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে যারা গরিবের স্কুল আখ্যা দিয়ে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন, তারা একবার আপনার নিকটস্থ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখে আসুন, আপনার ভুল ভেঙে যাবে নিশ্চিত।
সুপরিসর বিদ্যালয় ভবন, সজ্জিত শ্রেণীকক্ষ, উচ্চশিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তা শুধু নয় শিশুদের কর্মব্যস্ততাও আপনাকে মুগ্ধ করবে।
কাবদল, হলদে পাখি, ক্ষুদে ডাক্তার, স্টুডেন্ট কাউন্সিল, চাইল্ড ইন্টিগ্রিটি ও শিশু বঙ্গবন্ধু ফোরাম, আইসিটি কক্ষ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, অটিজম কর্নার, খেলনা সজ্জিত প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীকক্ষ, শিশুবরণ ঘিরে শিশুদের উচ্ছ্বাস, ফুলের বাগান, সততার দোকান, মহানুভবতার দেয়াল আরো বহুবিধ সহপাঠক্রমিক কাজে ব্যস্ত শিশুদের সামগ্রিক বিকাশের চিত্র আপনাকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী করবে।
কেননা এসবই হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে।
প্রাথমিক শিক্ষার দক্ষ শিক্ষক দলের সমন্বয়ে বিশাল কর্মীবাহিনী নিরলস কাজ করে যাচ্ছে উন্নত জাতি বিনির্মাণে।
প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের নেতৃত্বে থাকা কর্মকর্তারা যেমন সক্রিয় রয়েছেন, তেমনি এ কর্মযজ্ঞে শামিল হয়েছেন বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন।
যিনি এ বছর খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসক মনোনীত হয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে তার অবদানের জন্য।
উল্লেখ্য, খুলনা মহানগরীর প্রাথমিক শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে নিয়োজিত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থানা রিসোর্স সেন্টার খুলনা সদরের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এমন একজন ব্যক্তি যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিজ্ঞানের স্নাতক।
উপরন্তু তিনি শিশুশিক্ষা বিষয়ে যুক্তরাজ্য ও জাপানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করেছেন নিজেকে।
তার উদ্ভাবনী উদ্যোগ প্রধান শিক্ষকের ডায়েরি বিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমে নতুন গতিসঞ্চার করেছে।
‘সব শিশুর জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’
এই
প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে খুলনা মহানগরীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও পরিবেশের মানোন্নয়নের মাধ্যমে শিশু শিক্ষাক্ষেত্রে যথেচ্ছা ব্যক্তি উদ্যোগ ও বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধে থানা রিসোর্স সেন্টার সচেষ্ট।
আশার কথা, এরই মধ্যে অনেকে ফিরে আসতে শুরু করেছে।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় একটি বিষয়ে ১০০তে ৯৯ পাওয়া একজন শিক্ষার্থীর পিতা-মাতাও যখন ১ নম্বর কম পাওয়ার কারণ জানতে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে শিক্ষাটা তাদের কাছে কী বস্তু।
তাই প্রাথমিক শিক্ষার এ অচলায়তন ভেঙে এগিয়ে চলার দায় আমাদের সবাইকে নিতে হবে।
ফিরে আসতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার মূল স্রোতে, যেখানে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ ভবিষ্যৎ সুনাগরিক গড়ার লক্ষ্যে।
জগজ্জীবন বিশ্বাস: ইন্সট্রাক্টর
থানা রিসোর্স সেন্টার, খুলনা সদর