নতুন বৈশ্বিক অর্থনীতি

অসমতাবিষয়ক তথ্য ঘাটতি ও ডাটা ডার্ক এইজ এড়াতে করণীয়

টমাস পিকেটি , লুকাস চ্যাঞ্চল, ফাকুন্দ আলভ্যারাদো , ইমানুয়েল সায়েজ , গ্যাব্রিয়েল জাকম্যান

আমরা বৈষম্য বা অসমতাবিষয়ক পরিসংখ্যানের অন্ধকার যুগে (ডার্ক এইজে) বাস করছি মহামন্দার (২০০৭-০৮ সাল) পরে এক দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও সরকারগুলো এখনো যথাযথভাবে আয় সম্পদের বিবর্তন চিহ্নিত করতে পারেনি বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষ-প্রতিষ্ঠানগুলো সামগ্রিকভাবে পুরো জনসংখ্যার আয় প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান তৈরি করে বটে; কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণী, শ্রমজীবী শ্রেণী কিংবা শীর্ষ শতাংশ শূন্য দশমিক শতাংশের জন্য আলাদাভাবে পরিসংখ্যান তৈরি করে না গুগল, ফেসবুক, ভিসা, মাস্টারকার্ড এবং অন্যান্য বহুজাতিক করপোরেশন যখন আমাদের ব্যক্তিজীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানে, তখন সরকারগুলো আয় সম্পদ বণ্টন সম্পর্কিত সবচেয়ে মৌলিক পরিসংখ্যান প্রকাশ দূরে থাক, সেগুলো ঠিকমতো সংগ্রহই করে না কাজেই সেগুলো সম্পর্কে তারা জানে না 

সন্দেহ  নেই, সমাজে সরকারের দিক থেকে তথ্যগুলোর না জানার ব্যর্থতার ব্যাপক ক্ষতি রয়েছে ভোটারদের জন্য সম্ভাব্য যেকোনো জ্ঞাত-ওয়াকিবহাল পছন্দের (ইনফর্মড চয়েস) ঘাটতির পাশাপাশি অনেক দেশে যে অসমতা অসমর্থনীয় উচ্চতায় উন্নীত হচ্ছে, বিষয়টি বক্তৃতাবাজ জননেতা গণতন্ত্রের সমালোচকদের বড় রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে

সময় যত গড়াচ্ছে, অসমতা এর ধরনগুলো অধিকতর খারাপ হচ্ছে এদিকে অসমতাবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এটিকে (অসমতা) মাঝেমধ্যে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিগত অ্যাপ্রোচের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল একটি বিষয় হিসেবে বর্ণনা করেন বিশেষত ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের সাম্প্রতিক প্রচ্ছদ স্টোরিতে এটিকে ইনইকুয়ালিটি ইলোজনস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে প্রকৃতির দিক থেকে সামাজিক বিজ্ঞানের তথ্যগুলো অবশ্যই চ্যালেঞ্জ করার জন্য উন্মুক্ত, যা পদ্ধতিগত তর্কগুলোকে ব্যাপকভাবে অপরিহার্য করে তোলে কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, অসমতা মাত্রা প্রবণতা এবং সম্পূর্ণভাবে অসমতা অস্বীকারের মধ্যে কোথায় তাহলে বৈধ একাডেমিক মতভিন্নতার সীমারেখা টানতে হবে?

বলার অপেক্ষা রাখে না, অসমতা গ্রহণযোগ্য কি গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি সম্পর্কে আমাদের কিছু করতে হবে কি হবে না, এটি একটি সামষ্টিক পছন্দের বিষয় তর্কগুলোকে ঋদ্ধ করতে বিশ্বজুড়ে ১০০ জনেরও বেশি গবেষক ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডাটাবেজের (ডব্লিউআইডি) মাধ্যমে অসমতাবিষয়ক পরিসংখ্যানগুলো সংকলনের জন্য উদ্ভাবনমূলক পদ্ধতিগুলো উন্নয়নে যোগ দিয়েছে ডব্লিউআইডি এখন ১০০-এর বেশি দেশে বিস্তৃত ডব্লিউআইডিতে খানা জরিপ, কর প্রশাসনের তথ্য, জাতীয় হিসাব এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত সম্পদ র্যাংকিংসহ প্রাপ্ত তথ্য উেসর সম্ভাব্য বিস্তৃত ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয় এর মধ্যে পানামা পেপার্সও অন্তর্ভুক্ত, যার মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসরা বিভিন্ন কর অবকাশস্থলে রাখা নানা দেশের সম্পদশালীদের তথ্য উন্মোচন করেছিল

ডব্লিউআইডির পদ্ধতি এমনভাবে বিন্যাস করা হয়, যাতে ফলাফল পুনঃউৎপাদন করা বিতর্ক তোলা এবং একই সঙ্গে প্রাপ্ত তথ্যের সম্প্রসারণ উন্নয়নে অবদান রাখার সুযোগ থাকে বিভিন্ন অঞ্চল দেশে এটি ধারাবাহিকভাবে যখন প্রয়োগ করা হয়েছে, তখন বিচিত্র ধরন আবির্ভূত হয়েছে কিছু দেশে অসমতা বেড়েছে, বাড়ছে কিছু দেশে স্থবির থেকেছে, থাকছে এবং কিছু দেশে কমেছে, কমছে এলআইএস ক্রস-ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার, কমিটমেন্ট টু ইকুইটি ইনস্টিটিউট, বিশ্বব্যাংক এবং ওইসিডির মতো বহু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ডব্লিউআইডি কেবল অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান, যা উল্লিখিত ইস্যুগুলো সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া উন্নয়নে এখন ফলপ্রসূভাবে কাজ করছে 

তবে সাম্প্রতিক কিছু নীতিগত উন্নয়ন দ্বারা অসমতা পরিমাপে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে, যা বৃহত্তর স্বচ্ছতাবিষয়ক বয়ান মিথ্যা প্রতিপন্ন করে প্রবেশাধিকার তথ্যের এই প্রধান উেসর বিশ্লেষণ কঠিন করে তোলার মাধ্যমে অনেক প্রাগ্রসর উন্নত দেশই প্রতি বছর সম্পাদিত রাজস্ব অডিটের সংখ্যা কমিয়েছে একইভাবে মূলধন আয়ের ওপর প্রগতিশীল কর আরোপ বাদ দেয়া (ফেজ আউট) এবং সম্পদ উত্তরাধিকার কর সংশোধন করায় সম্পদ বৈষম্যের ওপর তথ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উৎস বিলুপ্ত হয়ে গেছে

মূলধন আয় সম্পদের ওপর উচ্চমানসম্পন্ন আর্থিক প্রশাসনিক তথ্যের ঘাটতির কারণে অনেক পর্যবেক্ষকই বিশ্বের বেশ কয়েকটি স্বনামখ্যাত ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিলিয়নেয়ার র্যাংকিংসহ অন্য উৎসগুলোয় মনোযোগ দেবে, দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে তবে এসব উৎস মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারলেও সেগুলো পদ্ধতিগত যথার্থতার মান এবং ধারণাগত স্পষ্টতা মেটাতে পারবে না, যার ওপর ভিত্তি করে জ্ঞানসমৃদ্ধ জনসংলাপ এগিয়ে যেতে পারে

এসব কারণে গবেষক, গণমাধ্যম নাগরিক সমাজের সংগঠনের লোকদের আরো বেশি যুক্ত হতে হবে এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, আয় সম্পদ অনুসন্ধান শনাক্ত করতে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু সূচকের উন্নয়ন ঘটিয়েছি বিভিন্ন দেশের সরকারি পরিসংখ্যান দপ্তরগুলোর শীর্ষ শতাংশ, শূন্য দশমিক শতাংশ এবং শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য শতাংশ লোকের সম্পদ আয় স্তর প্রকাশ করতে হবে একই সঙ্গে ওইসব জনগোষ্ঠীর দেয়া কার্যকর করও (ইফেক্টিভ ট্যাক্স) প্রকাশ করতে হবে

আলোচ্য উদ্দেশ্য পরিপূরণে আগামী তিন বছরের মধ্যে জাতিসংঘের সিস্টেম অব ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টসে প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক মাইলফলক সংযোজিত হবে ( প্রচেষ্টার জন্য আমরা বর্তমানে বিভিন্ন দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান বিভাগ, ওইসিডি এবং জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ করছি) মৌলিকভাবে মহামন্দার সময়ে জাতীয় আয়ের হিস্যা নির্ধারণে জিডিপিসংক্রান্ত পরিসংখ্যানগুলো গবেষকদের দৃঢ় অঙ্গীকার থেকে জন্ম হয়েছিল বণ্টনগত প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নির্ধারণের জন্য জিডিপি প্রবর্তনের শতবর্ষ কিংবা আরেকটি মন্দার জন্য অপেক্ষা করা বড় ধরনের দুঃখজনক বিষয় হবে

সব সমাজ জাতিকে স্বচ্ছ অর্থনৈতিক উৎপাদন তা ছড়িয়ে দেয়ায় অধিকভাবে যুক্ত হওয়া অবশ্যই এখনই শুরু করতে হবে আমরা নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, সরকার এবং অ্যাকাডেমিক কমিউনিটি থেকে আগ্রহীদের একুশ শতকের অসমতাবিষয়ক তথ্যকে সমৃদ্ধ করা এবং সামনে নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় যোগ দিতে আহ্বান জানাই  

[স্বত্ব:প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

টমাস পিকেটি: প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক এবং ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডাটাবেজের সহপরিচালক

লুকাস চ্যাঞ্চল: ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডাটাবেজের সহপরিচালক

ফাকুন্দ আলভ্যারাদো: ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডাটাবেজের সহপরিচালক

ইমানুয়েল সায়েজ: ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের সেন্টার ফর ইকুইটেবল গ্রোথের পরিচালক এবং ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডাটাবেজের সহপরিচালক

গ্যাব্রিয়েল জাকম্যান: ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডাটাবেজের সহপরিচালক

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন