দিল্লিতে জয় হয়েছে ন্যায় আর অসাম্প্রদায়িকতার, পরাজয় হয়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদের কর্ণধার মোদি সরকারের।
নির্বাচনী প্রচার বিজেপির আসন বৃদ্ধি করলেও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিজয়রথ থামাতে যথেষ্ট হয়নি।
কেজরিওয়ালের বিজয় ভারতবর্ষে ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে সমতার নতুন এক রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করেছে, যার মূল লক্ষ্য গণমানুষের সেবা।
আশা করা যায়, নতুন এ আন্দোলন দিল্লিতে সীমাবদ্ধ না থেকে ভারতবর্ষে যারা হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধ্যানধারণা রদ করে সবার সমান অংশীদারিত্বে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনে কাজ করতে চান, তাদের আন্দোলনে রসদ জোগাবে।
ভারতীয় রাজনীতিতে মোদি যুগের সূচনা থেকেই বিধানসভার নির্বাচনের গুরুত্ব আঞ্চলিক রাজনীতির চৌহদ্দি ভেঙে জাতীয় রাজনীতির গতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখছে, যার সর্বশেষ নমুনা ছিল পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন।
সে
পথ
ধরেই এবারের বিজেপির দিল্লি দখলের এলাহি আয়োজন, দিল্লির বিধানসভার নির্বাচন গণমানুষকে উত্তাপ দিয়েছে জাতীয় নির্বাচনের মতোই।
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির ৬২ আসনের বিপরীতে মোদির বিজেপি পেয়েছে মাত্র আটটি আসন।
আর
কংগ্রেস আগের মতোই হাত খোলার আগেই আউট, শূন্য হাতে বাড়ি ফিরেছে।
কেজরিওয়ালের বিশাল জয়ের পূর্বাভাস ছিল বুথফেরত সমীক্ষাতেই, কিন্তু বিজেপির সাম্প্রদায়িক ভোটের রাজনীতির উত্থান গণমানুষকে চিন্তায় রেখেছিল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
বিতর্কিত ইভিএম কেজরিওয়ালের সমর্থকদের দুশ্চিন্তায় যোগ করেছিল সন্দেহ।
কিন্তু মঙ্গলবার সকালে নির্বাচন কমিশন থেকে ফলাফল আসতে শুরু করলে মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে থাকে।
গণমানুষের এ স্বস্তির নিঃশ্বাসের পেছনে রয়েছে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির বিদ্যুৎ, পানি, শিক্ষা আর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি পূরণের সফলতা।
গত
নির্বাচনে কেজরিওয়াল ওয়াদা করেছিলেন, ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ থেকে ৭০০ লিটার পানি বিনা মূল্যে সরবরাহসহ দিল্লিতে নারীদের জন্য সরকারি বাস চালুর কথা।
স্বাস্থ্যসেবায় ছিল যুগান্তকারী পরিবর্তনের আশ্বাস।
সবকিছুতেই কেজরিওয়ালের আম আদমি ছিল মোটাদাগে সফল।
সমালোচকরা বলছেন, কেজরিওয়ালের প্রতিশ্রুতি পূরণের সফলতা আর অদম্য ইচ্ছা ভারতে ৭০ বছর ধরে রাজনীতিবিদদের থেকে প্রতারিত হওয়া গণমানুষের আগ্রহ আবার ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে, যা ভারতের ক্ষয়িষ্ণু গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আশার আলো।
বিজেপির দিল্লি দখলের এলাহি আয়োজন দিল্লির বিধানসভার নির্বাচনকে রূপ দিয়েছিল মহল্লার ছেলেদের সঙ্গে জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের ম্যাচের মতো করেই।
নির্বাচনী প্রচারণায় আম আদমি পার্টিকে মোকাবেলা করতে হয়েছে বিজেপির শক্তিশালী নির্বাচনী দলকে।
বিজেপি মাঠে ছিল তার নিখিল ভারতীয় পাইক-পেয়াদা ভর্তি পুরো শক্তির দল নিয়ে, যার অগ্রভাগে ছিলেন অমিত শাহ আর মোদি।
অমিত শাহকে উৎসাহ দিতে মাঠে ছিলেন বিজেপির বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আর লোকসভার সদস্যরা।
বিজেপির এ পাইক-পেয়াদাদের বিধ্বংসী দল কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টিকে প্রচণ্ড গতির ইয়র্কার দিয়েছে ক্ষণে ক্ষণে।
কিন্তু গতির এ ইয়র্কার কেজরিওয়ালের উন্নয়নের রাজনীতিকে নিষ্প্রভ করতে পারেনি, বরং ভোটের আগেই বিজেপির লাগাতার ইয়র্কারে চার-ছয় মেরে দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিলেন কথা ও কাজের মাধ্যমে।
বিজেপির ইয়র্কারে ছিল না কোনো নতুনত্ব।
আগের মতোই ছিল দেশপ্রেম, পাকিস্তান আর সন্ত্রাসবাদ এবং সদ্য যোগ হওয়া শাহিনবাগের আন্দোলন।
বিজেপির আশা ছিল, শাহিনবাগের আন্দোলন তাদের রক্ষায় ভূমিকা রাখবে।
সে
হিসেবেই বিজেপি লাগাতার শাহিনবাগের আন্দোলনকে পাকিস্তানের মদদে পরিচালিত সন্ত্রাসীদের আন্দোলন বলে প্রচার চালিয়েছে।
এমনকি এক ধাপ এগিয়ে এ আন্দোলনে সমর্থন দেয়ার অভিযোগে দিল্লির বিজেপি সংসদ সদস্য পারভেশ ভার্মা কেজরিওয়ালকে একজন সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করলে পুরো নির্বাচনী প্রচারণায় এক ধরনের ঘৃণার উদ্রেগ হয়, যার সমাপ্তি হয়েছে বিজেপি সমর্থকদের শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের মধ্য দিয়ে।
সমালোচকরা বলছেন, গুলিবর্ষণের ঘটনা কেজরিওয়ালের উন্নয়নের রাজনীতিকে গণমানুষের মনে আরো বেশি শক্তিশালী জায়গা দিয়েছে।
কেজরিওয়াল বিজেপির গতিময় ইয়র্কার দেখেশুনে বারবার সীমানাছাড়া করেছেন।
কেজরিওয়াল বিজেপির অভিযোগে নিশ্চুপ থেকে গত পাঁচ বছরের কর্মের নমুনা তুলে ধরে ভোটারদের মন জয়ের তাগাদায় ছিলেন।
আর
এ
তাগাদায় মিলেছে সফলতা।
কেজরিওয়াল মানুষকে আধুনিক শিক্ষা আর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যার বীজ রোপণ করছেন পাঁচ বছর আগে।
সেই বীজ ফল দিয়েছে দিল্লির সব মানুষকে।
সরকারি ক্লিনিকগুলো বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি ওষুধ সরবরাহ করছে, যা দিল্লির খেটে খাওয়া মানুষদের দিয়েছে এক প্রশান্তির স্বপ্ন।
তবে কেজরিওয়ালের শিক্ষানীতিও গণমানুষের আস্থা টেনেছে অনেক।
গত
পাঁচ বছরে কেজরিওয়াল সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেছেন শিক্ষা খাতে, যা টাকার অংকে প্রায় ১৬ হাজার কোটি।
ছাত্ররা পেয়েছে দৃষ্টিনন্দন শ্রেণীকক্ষ আর আধুনিক শিক্ষানীতি, যার কল্যাণেই পিছিয়ে পড়া মানুষের সন্তানরা স্কুলে ফিরতে শুরু করেছে।
শুরু হয়েছে শিক্ষায় সমতার আন্দোলন।
ঘৃণা আর হিংসার বিরুদ্ধে জয় হয়েছে কর্মের, জয় হয়েছে অসাম্প্রদায়িকতার।
মোদি আর অমিত শাহের নাকের ডগায় আগামী পাঁচ বছর দিল্লি পরিচালনা করবেন কেজরিওয়াল।
অতীতের দলিলে চোখ বুলিয়ে নির্ভারে বলা যায়, মোদি সরকারের সব বাধা উপেক্ষা করে কেজরিওয়াল তার গণমুখী প্রকল্পগুলো অব্যাহত রাখবেন।
এর
মাধ্যমে উপকৃত হবে দিল্লিসহ আশপাশের কোটি কোটি মানুষ।
তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, কেজরিওয়াল ভারতবর্ষের আগামীর রাজনীতির এক অর্থপূর্ণ কারিগর হবেন।
কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি থেকে শুরু করে আঞ্চলিক দলগুলো জোট গঠনে সম্মত হলে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ইতি ঘটতে সময় লাগবে না।
সম্ভাব্য এ জোটের ইঙ্গিত এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মমতার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, যা আগামীর ভারতের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।
রাহুল আনজুম: ইস্তাম্বুলে বসবাসরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের
সাবেক শিক্ষার্থী