পর্যটন, ব্যবসা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশীদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয়
স্থান সিঙ্গাপুর। এশিয়ার বিস্ময় ক্ষুদে এই দ্বীপরাষ্ট্র কয়েকদিন আগেও অসংখ্য
পর্যটকের পদচারণায় ছিল মুখরিত। কিন্তু করোনাভাইরাস আতঙ্কে হঠাৎ থমকে গেছে সবকিছু।
শহরের পর্যটন এলাকাগুলো এখন জনশূন্য,
রাস্তাঘাটও ফাঁকা। কোনো
কোলাহল নেই ক্যাসিনোগুলোয়। সব মিলিয়ে ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম
সেরা এ শহর।
যাত্রী আগমন ও
সেবা বিবেচনায় একাধিকবার বিশ্বে শীর্ষস্থান পেয়েছে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দর।
কিন্তু করোনাভাইরাস আতঙ্কে এরই মধ্যে যাত্রী হারাতে শুরু করেছে বিমানবন্দরটি।
সিঙ্গাপুর ট্যুরিজম বোর্ড (এসটিবি)
বলছে, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিন ১৮ থেকে
২০ হাজার যাত্রী কম আসছে, যা ভবিষ্যতে আরো কমতে পারে। আর পর্যটকের অভাবে
সিঙ্গাপুরের বড় বড় হোটেলও অনেকটা ফাঁকা। আর ব্যবসায়িক প্রয়োজনে যারা এখনো
সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করছেন, তারাও হোটেল ও কাজের ক্ষেত্র ছাড়া খুব বেশি বের
হচ্ছেন না।
প্রতিদিন
সিঙ্গাপুরে বিদেশ থেকে যেসব পর্যটক যান,
তার উল্লেখযোগ্য একটা অংশ
যান চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। সিঙ্গাপুর মেডিকেল ট্যুরিজমের অন্যতম গন্তব্য হলেও এরই
মধ্যে বিদেশী রোগীদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করেছে দেশটির হাসপাতালগুলো। নতুন করে
কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হচ্ছে না বিদেশীদের।
পর্যটন
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভাইরাস আতঙ্কে ইতিমধ্যেই সিঙ্গাপুরের সব ট্যুরের
বুকিং বাতিল করেছেন পর্যটকরা। এতে সিঙ্গাপুর যেমন ক্ষতির মুখে পড়েছে, তেমনি ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এয়ারলাইনস ও ট্যুর
অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো।
ট্যুর অপারেটর
প্রতিষ্ঠান বিজকন হলিডেজের সিইও তসলিম আমিন শোভন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভাইরাস আতঙ্কে পর্যটকরা তো ভ্রমণ বাতিল
করছেনই, ব্যবসায়ীরাও সিঙ্গাপুরে যেতে চাচ্ছেন না। এমনকি
অন্য দেশে যাওয়ার সময় ট্রানজিট হিসেবেও সিঙ্গাপুরকে এড়িয়ে চলছেন যাত্রীরা। বেশ বড়
একটি গ্রুপের ইন্দোনেশিয়ার বালিতে ভ্রমণের বুকিং রয়েছে আমার প্রতিষ্ঠানে।
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের টিকিটও বুকিং দিয়েছিলাম। কিন্তু ওই গ্রুপের কেউই সিঙ্গাপুরে
ট্রানজিট দিয়ে বালিতে যেতে চাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে মালয়েশিয়ায়
ট্রানজিট দিয়ে বালি যায় এমন একটি এয়ারলাইনসের টিকিট কিনতে হয়েছে।
এদিকে ভাইরাসের
সংক্রমণ বাড়তে থাকায় আগামী মার্চে অনুষ্ঠিতব্য তিনটি মেগা শো স্থগিত করেছে
সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। সিঙ্গাপুর আইটি শো,
ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ফেয়ার
এবং বিল্ডটেক এশিয়া নামে অনুষ্ঠেয় মেগা শো তিনটি পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া
পর্যন্ত স্থগিত থাকবে বলে জানানো হয়েছে। গণমাধ্যমে দেয়া এক সংবাদ বিবৃতিতে
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির
বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ অনুষ্ঠানগুলো স্থগিত করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে
পরবর্তী সময়ে নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
স্থগিত হওয়া
আইটি শো সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় শোগুলোর অন্যতম, যেটি মার্চের
১২-১৫ তারিখে সানটেক কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সিঙ্গাপুর
প্রজাতন্ত্রে হওয়া বছরের সবচেয়ে বড় ইলেকট্রনিকস মেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এটি।
অন্যদিকে ১৯-২২ মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ফেয়ার নামের
মেলাটি। স্থগিত হওয়া এই অনুষ্ঠান এশীয় খাদ্য ও পানীয়জাত পণ্যের বৃহৎ একটি মেলা। এ
আয়োজনে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ২০০-এর অধিক পণ্য ও সরবরাহকারী অংশগ্রহণ করার কথা
ছিল। স্থগিত হওয়া নির্মাণ এবং ইমারত শিল্পের মেগা শো ‘বিল্ডটেক এশিয়া’ ১১-১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
এর আগে গত ১১
ফেব্রুয়ারি থেকে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুরু হয়েছে পাঁচদিনের ‘সিঙ্গাপুর এয়ার শো ২০২০’। করোনাভাইরাস
ছড়িয়ে পড়ার উদ্বেগে এভিয়েশন খাতের অন্যতম আয়োজন সিঙ্গাপুর এয়ার শোর পঞ্চম আসরে অংশ
নেয়নি অনেক প্রতিষ্ঠানই। এই ইভেন্টে চীনা এয়ারলাইনস সংস্থাগুলোর জন্য স্থান বরাদ্দ
থাকলেও সেসব এখন ফাঁকা। অন্যদিকে শেষ মুহূর্তে অংশ নেয়নি আরো বেশ কয়েকটি
প্রতিষ্ঠান। ফলে শুরু থেকেই আকর্ষণ হারিয়েছে অনুষ্ঠানটি।
নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়েছে কঠোর সতর্কতা। ব্যবসা ও চিকিৎসার প্রয়োজনে যারা দেশটিতে আছেন, তাদের প্রতিবার হোটেলে প্রবেশের সময় শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে। একই অবস্থা হাসপাতাল ও ওষুধ কিনতে ফার্মেসিতে প্রবেশের ক্ষেত্রেও। আর দেশটিতে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে যারা অবস্থান করছেন, তাদেরও ডরমিটরি থেকে বের হওয়ার সময় এবং কাজ শেষে ডরমিটরিতে ফেরার পর শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে। আবার কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়ও তাপমাত্রা পরিমাপ করা হচ্ছে। কারো শরীরের তাপমাত্রা সাড়ে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেই তাকে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পাঠানো হচ্ছে। একই সঙ্গে নেয়া হচ্ছে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারান্টাইনে।
জানা গেছে, সিঙ্গাপুর সরকার করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে তিনটি রিস্ক লেভেল
নির্ধারণ করেছে—ইয়েলো,
অরেঞ্জ ও রেড। ইয়েলো মানে
আক্রান্ত রোগীরা চীনা নাগরিক কিংবা সর্বশেষ চীন ভ্রমণ করে এসেছে। দ্বিতীয় রিস্ক
লেভেল অরেঞ্জ মানে কিছু স্থানীয় লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, যাদের কেউ চীন ভ্রমণ করেনি কিংবা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত
কোনো রোগীর সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই। সর্বশেষ রিস্ক লেভেল রেড মানে সারা দেশে
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি হলে তখন সব অফিস, স্কুল বন্ধ ঘোষণা করে দেয়া হবে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি
রিস্ক লেভেল অরেঞ্জ ঘোষণা করেছে সিঙ্গাপুর সরকার। এর পর থেকেই দেশটির স্থানীয়
এমনকি প্রবাসীরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। দোকানগুলোয় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার হিড়িক
পড়ে যায়। মাস্কশূন্য হয়ে যায় প্রায় সব স্টোর।
দেশটির সবচেয়ে
বড় চেইন শপ ‘মাদারশিপ’ এক প্রতিবেদনে জানায়, রিস্ক লেভেল অরেঞ্জ ঘোষণার পর থেকেই দুর্যোগ মোকাবেলায়
অতিরিক্ত খাবার সংগ্রহ করতে অসংখ্য মানুষ স্থানীয় সুপারমার্কেটগুলোতে ভিড় জমাতে
শুরু করে। ফলে বেশির ভাগ দোকানেই শুকনো খাবারের সংকট দেখা যায়। সেখানে ইনস্ট্যান্ট
নুডলস এবং পাস্তাজাতীয় শুকনো খাবারগুলো দ্রুত শেষ হয়ে যেতে দেখা যায়। অন্যান্য
প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন টয়লেট পেপারও কিছু জায়গায় শেষ হয়ে যেতে দেখা যায়।
দোকানগুলোতে অনেক রাতেও মানুষের ভিড় জমতে দেখা যায়।
সিঙ্গাপুর
কর্তৃপক্ষ বলছে, সিঙ্গাপুরের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন মূলত তিনটি
বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। প্রথমত,
আর কতদিন এই মহামারী থাকবে
এবং এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে এর প্রভাব কেমন হবে। দ্বিতীয়ত, সিঙ্গাপুরসহ এ অঞ্চলের বাকি দেশগুলোতে কতদিন এ অবস্থা
থাকবে। তৃতীয়ত, পর্যটকের সংখ্যা স্বাভাবিক হতে কতটা সময় লাগতে
পারে।
উল্লেখ্য, অবকাঠামো খাতই সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রেখেছে।
আর এজন্য দেশটিকে প্রচুর বিদেশী শ্রমিকের ওপর নির্ভর করতে হয়। দেশটির জনশক্তি
মন্ত্রণালয়ের ২০১৯ সালের জুনের এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশ, ভারত,
মিয়ানমার ও চীন থেকে ৩ লাখ
৭০০ শ্রমিক দেশটির নির্মাণশিল্পে নিয়োজিত। যদিও সিঙ্গাপুরে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে
নির্মাণ ও মেরিন সেক্টরসহ অনেক কোম্পানি থেকে অভিবাসী শ্রমিকরা চাকরি হারিয়েছেন।
এর মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ, ভারত,
মিয়ানমার ও চীনের
শ্রমিকরাও। করোনা আতঙ্কে যাদের অনেকেই এখন দেশে ফিরতে শুরু করেছেন।
ভাইরাসের কারণে
আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দিন পার করছেন দেশটিতে অবস্থানরত প্রায় ৪ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক।
সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক তৈরি হয়েছে সিঙ্গাপুর প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে
পরিচিত মোস্তফা সেন্টার ও আশপাশ এলাকায়। স্থানটি বাংলাদেশী প্রবাসীদের কাছে
মোস্তফা প্লাজা নামে পরিচিত। মোস্তফা সেন্টারের আশপাশের এলাকাগুলোর মধ্যে রবার্টস
লেন, সৈয়দ আলাওয়ি রোড,
রয়েল রোড, কেজি কাপুর রোড,
সিরাংগংসহ কয়েকটি এলাকায়
বাংলাদেশী প্রবাসীদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি। তবে নভেল করোনাভাইরাস আতঙ্কে প্রবাসী
বাংলাদেশীরা এখন ওই সব এলাকা এড়িয়ে চলছেন।
সিঙ্গাপুরে শ্রম
ভিসায় যাওয়া চুয়াডাঙ্গার ছেলে মতিয়ার রহমান এ প্রসঙ্গে জানান, প্রতিদিনই বাংলাদেশী শ্রমিকরা দেশে ফেরার সুযোগ খুঁজছেন।
এরই মধ্যে অনেক বাংলাদেশী ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে দেশে ফিরেছেন। অন্যান্য দেশ
থেকে আসা কর্মীরাও দেশে ফিরছেন। তিনি বলেন,
পর্যটন এলাকাগুলোতে
বিদেশীদের সমাগম নেই বললেই চলে। এমনকি জমজমাট ক্যাসিনোগুলোও এখন প্রায় শূন্য।
ক্যাসিনোগুলোতে যারা কাজ করতেন তারাও কাজে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। বিখ্যাত
সান্তোসা আইল্যান্ডের পর্যটন আকর্ষণগুলো এখন জৌলুসহীন।
জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত নতুন পাঁচ রোগীসহ সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাসে
আক্রান্তের সর্বমোট সংখ্যা ৭২ জন। নতুনভাবে আক্রান্ত হওয়া এই পাঁচজনের তিনজন
স্থানীয় চার্চে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য অনুষ্ঠিত হওয়া সমাবেশ থেকে আক্রান্ত হয়েছেন
বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই পাঁচজনের কারোরই সাম্প্রতিক সময়ে চীনে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
নেই। এ পর্যন্ত ১৮ জন রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এছাড়া আক্রান্ত
রোগীদের মধ্যে ৫৪ জন এখনো হাসপাতালে অবস্থান করছেন, যাদের অধিকাংশই
সুস্থ হওয়ার পথে। তবে ছয়জনের অবস্থা একটু খারাপ হওয়ায় আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
তবে সিঙ্গাপুর
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে,
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না
হলেও এমন ২ হাজার ৯৩ জন ব্যক্তির তথ্য পাওয়া গেছে যারা আক্রান্তের সংস্পর্শে
এসেছিলেন। যাদের মধ্যে ১ হাজার ৯৬৯ জন সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। ১ হাজার ৬৯৭ জনকে
পৃথকভাবে কোয়ারান্টাইন করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ২৬২ জন সংক্রমিত রোগীর সঙ্গে
যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে।