ব্যাংকের কার্যক্রম এখন সরকারি প্রকল্পকে ঘিরে

হাছান আদনান

নগরসহ সড়ক-মহাসড়কের উন্নয়নে বিপুল কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে সরকার। নির্মিত হচ্ছে শতাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভৌত অবকাঠামো। ঠিকাদারদের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন সরকারি প্রকল্পের অর্থ যাচ্ছে ব্যাংক থেকে। সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে স্বল্পমেয়াদে এসব ঋণ দিচ্ছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক। এ ঋণের অর্থকেই দেখানো হচ্ছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ হিসেবে।

গত কয়েক বছরে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের বড় অংশ গিয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুতের একমাত্র ক্রেতাও সরকার। সে হিসাবে এ খাতের বেসরকারি বিনিয়োগও পরোক্ষভাবে সরকারি।

দেশে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশে। গত এক দশকের বেশি সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে এতটা খরা আর দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় অর্থায়ন বাদ দিলে দেশের বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোটায় নামবে।

তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ বাড়ছে। অনাদায়ী সুদ প্রতিনিয়ত ঋণের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এ ঋণের সুদকেই ঋণ প্রবৃদ্ধি হিসেবে দেখাচ্ছে অনেক ব্যাংক। তারল্য সংকট ও সুদহারে অস্থিরতার কারণে ব্যাংকগুলো এখন নিরাপদ বিনিয়োগ খুঁজছে। এজন্য সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে ঋণ দেয়াকেই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ভাবছেন ব্যাংকাররা।

পরিস্থিতির কারণেই ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের বড় অংশ সরকারি প্রকল্পকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, সরকার সারা দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছে। সেতু, রাস্তাসহ ভৌত অবকাঠামো নির্মাণেও বিপুল বিনিয়োগ করছে। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নেও বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেসব ঠিকাদারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হচ্ছে, ব্যাংকগুলো তাদের অর্থায়ন করছে। এসব বিনিয়োগ বেসরকারি খাতের মাধ্যমে হলেও পরোক্ষভাবে তা সরকারি খাতেই যাচ্ছে।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের মতে, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর হাতে নতুন প্রকল্প ঋণের প্রস্তাব নেই বললেই চলে। যেসব বিনিয়োগ প্রস্তাব আসছে, সেগুলোর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। এছাড়া সুদহার ও তারল্যের চলমান সংকট তো আছেই।

বেসরকারি খাতের অর্জিত ঋণ প্রবৃদ্ধির গন্তব্য কোথায়তা অনুসন্ধান করেছে বণিক বার্তা। এজন্য দেশের প্রথম সারির এক ডজনের বেশি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের নতুন ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। কথা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত এক বছরে দেশের ব্যাংকগুলোয় নতুন উদ্যোক্তাদের প্রকল্প ঋণ নেই বললেই চলে। বড় শিল্প গ্রুপগুলোকে কিছু চলতি মূলধন দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এর বাইরে আমদানি-রফতানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। কিছু ঋণ দেয়া হয়েছে কৃষি, রিটেইল ও এসএমই খাতে।

এ সময়ে ব্যাংকগুলোর মূল ব্যবসা ছিল সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে ঋণ অনুমোদন। দেশের প্রায় সব ব্যাংকই এ খাতে বিনিয়োগকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে করছে। তিন মাস থেকে এক বছর মেয়াদে এসব ঋণের অনুমোদন দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। যদিও সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে দেয়া ঋণও অনিয়মিত হয়ে পড়ছে। দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ালেও আদায় হচ্ছে না ঋণের অর্থ।

ব্যাংকাররা বলছেন, ঠিকাদারদের দুর্বলতা বা দুর্নীতির কারণে যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে না। আবার সরকারের রাজস্ব ঘাটতির কারণে কাজ শেষ করেও অনেক ঠিকাদার টাকা পাচ্ছে না। এ দুই মিলিয়ে সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে বিনিয়োগও এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে ব্যালান্সশিটের ১৮ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে এনসিসি ব্যাংক লিমিটেডের। টাকার অংকে এ বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। স্বল্প সময়ে বিনিয়োগের অর্থ মুনাফাসহ উঠে আসবে, এমন প্রত্যাশা থেকেই এ খাতে বড় বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকটি। যদিও ঠিকাদাররা যথাসময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় বিনিয়োগের বড় অংশই

আটকা পড়েছে। কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও সরকার টাকা ছাড় না করায় বিপদ বাড়ছে ব্যাংকটির।

এ বিষয়ে এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ জানান, যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ উপকরণ আমদানিসহ সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছি। যদিও কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো টাকা পরিশোধ করছে না। সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে দেয়া ঋণ বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হিসেবেই দেখানো হয়। খাতটি যতটা বড় হয়েছে, তাতে সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে ঋণকে পৃথক খাত হিসেবে দেখানো দরকার।

ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে ঠিক কী পরিমাণ ঋণ দেয়া হয়েছে, তার পরিসংখ্যান নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। এ ধরনের ঋণকে আমদানি, নির্মাণ, যোগাযোগসহ বিভিন্ন সেবা খাতে দেখায় ব্যাংকগুলো। ফলে এ খাতে বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ জানাও সম্ভব হয়নি। তবে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে এ খাতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ধারণা পাওয়া যায়। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার এডিপিতে বরাদ্দ করেছে ২ লাখ ১৫ হাজার ১১৩ কোটি টাকা। মোট ১ হাজার ৬১৬টি প্রকল্পে এ অর্থ ব্যয় করা হবে। সরকারের যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পই ঠিকাদারদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়। এ হিসেবে উন্নয়ন প্রকল্পের এ অর্থ ঠিকাদারদের অনুকূলে প্রাথমিকভাবে ব্যাংক থেকেই বিনিয়োগ করতে হবে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকার এডিপি বাবদ ব্যয় করেছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও এডিপি বাবদ ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। এডিপি খাতের এ ব্যয় প্রাথমিকভাবে ব্যাংকই ঠিকাদারদের জোগান দিয়েছে। পরে রাজস্ব থেকে সে অর্থ ঠিকাদারদের পরিশোধ করেছে সরকার।

সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে ৩৪০ কোটি টাকার ঋণ আছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের। এসব ঋণ বর্তমানে নিয়মিত থাকলেও বিভিন্ন সময় মেয়াদ বাড়াতে হয়েছে। পুনঃতফসিলও করতে হয়েছে কয়েকটি ঋণ। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে ঋণ দিলে তা স্বল্প সময়ের মধ্যে ফেরত আসে। তবে এক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও হচ্ছে। ঠিকাদাররা যথাসময়ে কাজ শেষ করতে পারছে না। আবার কাজ শেষ হলেও ঠিকাদারদের টাকা দিতে সরকার দেরি করছে। এ দুটি মিলিয়ে আমাদের বিনিয়োগ প্রত্যাশা অনুযায়ী ফেরত আসছে না।

সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে বড় ধরনের বিনিয়োগ আছে সাউথইস্ট ব্যাংকেরও। এ খাতে বিনিয়োগ নিয়ে খুব বেশি স্বস্তিতে নেই ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে ঋণ দেয়ার প্রস্তাব সারা বছরই থাকে। তবে এ মুহূর্তে চাহিদা বেশি। এ খাতের বিনিয়োগের সমস্যা হলো, যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়া। সরকার থেকে অর্থ ছাড় পেতেও বিলম্ব হচ্ছে। এজন্য সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রেও আমাদের ভাবতে হচ্ছে। ঠিকাদার ও কাজের ধরন দেখে তারপর বিনিয়োগ করছি।

সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে বিনিয়োগ বেশি না থাকলেও বিদ্যুৎ খাতে বড় বিনিয়োগ আছে সিটি ব্যাংক লিমিটেডের। বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকটির ব্যালান্সশিটের প্রায় ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ খাতে। বিনিয়োগের এ অর্থও পরোক্ষভাবে সরকারি কার্যক্রমকে ঘিরে। এ প্রসঙ্গে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, আমাদের ব্যাংকের মূল ব্যবসা বিদ্যুৎ, তৈরি পোশাক, কার্ড, রিটেইল, ব্লু-চিপের মতো ব্যবসায়। তবে খুলনা শিপইয়ার্ড ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দুটি কার্যাদেশের বিপরীতে আমাদের বিনিয়োগ আছে। এটি ঠিক, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ পরিস্থিতি মন্দা। আমরা চেষ্টা করছি, মানসম্পন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে।

প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের ভালো বিনিয়োগ আছে সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে। এ খাতে বিনিয়োগের দিক থেকে ব্যাংকটির অবস্থানও সামনের সারিতে। তবে শুধু সরকারি অর্থায়নের কার্যাদেশে বিনিয়োগ থেকে বেরিয়ে এসেছে ব্যাংকটি। এ প্রসঙ্গে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাহেল আহমেদ বলেন, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকার মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়ন আছে, এমন কার্যাদেশের বিপরীতে আমরা ঋণ দিচ্ছি। শুধু বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে নেয়া প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা সতর্ক। সরকারি প্রকল্পগুলোর পেমেন্ট দেরি হচ্ছে। রাজস্ব ঘাটতি থাকলে সরকার ঠিকাদারদের টাকা দেয় না। এজন্য আমরা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট প্রকল্পে বেশি বিনিয়োগ করছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন