বিএসএফআইসির কারণেই চিনির বাজারে অস্থিরতা

সুজিত সাহা চট্টগ্রাম ব্যুরো

উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখাই বাংলাদেশ চিনি খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) অন্যতম কাজ, যাতে পণ্যটির বাজার স্থিতিশীল থাকে। কিন্তু তা না করে উল্টো চিনির দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি আরেক দফা ডিলার পর্যায়ে চিনির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বিএসএফআইসি। এতে পাইকারি বাজারে অস্থির হয়ে উঠেছে পণ্যটির দাম। এই সুযোগে কম দামে চিনি আমদানি করেও অতিরিক্ত মুনাফা করছেন আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা।

দেশে প্রতি বছর প্রায় লাখ ২৫ হাজার টন চিনি উৎপাদন হয়। যদিও পণ্যটির বাজারের ৯০ শতাংশই এখনো আমদানিনির্ভর। আর আমদানীকৃত চিনির পুরোটাই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে ১০ শতাংশ বাজারের নিয়ন্ত্রক বিএসএফআইসি পণ্যটির দাম বাড়ালে তার সুবিধা নেয় বাজারের ৯০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণকারক আমদানিকারীরা।

ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি কেজি চিনির বুকিং মূল্য ছিল ২৯ সেন্ট। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেও চিনির দাম ছিল ৩০ সেন্ট। আগামী মার্চে সরবরাহযোগ্য চিনির বুকিং দাম হচ্ছে প্রতি পাউন্ড ১৫ দশমিক ৭৮ সেন্ট। অর্থাৎ প্রায় এক বছরের তুলনায় বিশ্ববাজারে চিনির দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়েনি। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বিএসএফআইসির দাম বৃদ্ধির কারণে অস্থির হয়ে পড়েছে চিনির বাজার।

দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই সপ্তাহ ধরেই বাড়ছে চিনির পাইকারি দাম। সময়ের মধ্যে নিত্যপণ্যটির মণপ্রতি দাম বেড়েছে প্রায় ২৫০ টাকা। সর্বশেষ এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে প্রায় ১৬০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারি চিনির দাম কেজিপ্রতি টাকা বাড়ানোর ফলে মিল মালিকরাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া আসন্ন গ্রীষ্মকালীন মৌসুম রোজায় চিনির চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সুযোগ নিতে মিল পর্যায়ে চিনির দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।

খাতুনগঞ্জের ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার প্রতি মণ চিনির ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) লেনদেন হয়েছিল হাজার ১৫০ টাকায়। এরপর মঙ্গলবার দাম প্রায় ৫৫ টাকা বেড়ে লেনদেন হয় হাজার ২০৫ টাকায়। বুধবার একই মানের চিনি লেনদেন হয় হাজার ২৫০ টাকায়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার চিনির দাম আরো এক দফা বেড়ে লেনদেন হয়েছে হাজার ৩২০ টাকায়। অর্থাৎ কয়েক দিনের ব্যবধানে চিনির দাম বেড়েছে মণে প্রায় ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। ডিও দাম কিছুটা কম থাকলেও প্রস্তুত চিনি (সরাসরি মিলগেট থেকে সংগ্রহযোগ্য) হাজার ৩৭০ থেকে হাজার ৩৮০ টাকা দরে লেনদেন হচ্ছে।

বিএসএফআইসি সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন করপোরেশনের চিনির কেজিপ্রতি ডিলার মূল্য ছিল ৫০ টাকা। এরপর কয়েক মাস আগে ডিলারদের চিনির দাম কেজিপ্রতি টাকা বাড়িয়ে ৫৫ টাকা করা হয়। তবে সর্বশেষ জানুয়ারির শেষ দিকে চিনির কেজিপ্রতি মূল্য আরো টাকা বাড়িয়ে ৬০ করা হয়। এর পর থেকেই দেশে বেসরকারি খাতের চিনির দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে শুরু করে। আসন্ন গ্রীষ্ম রোজার কারণে চিনি আমদানি বিক্রিতে অতি মুনাফা করছেন বলে মনে করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিশ্ববাজারে চিনির দাম সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমানে যে দামে চিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে একই দামে আমদানির পর রিফাইন্ড বা পরিশোধন করে বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়েও কম দামে বিক্রি করা সম্ভব। কিন্তু করপোরেশনের চিনির দাম বাড়ানোর সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরাও বেসরকারি খাতের চিনির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

জানা গেছে, বর্তমানে দেশে মাড়াই মৌসুম চলছে। এই মৌসুমে দেশের চিনিকলগুলোতে লাখ ২৫ হাজার টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে চাহিদা বৃদ্ধি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে করপোরেশন বিভিন্ন সময় চিনির ডিলার পর্যায়ে মূল্য সংশোধন করে। তাছাড়া মজুদ ফুরিয়ে এলে আপত্কালে চিনি ধরে রাখতেও দাম বাড়াতে পারে করপোরেশন। কিন্তু বাজার পর্যালোচনা না করে হুটহাট দাম বৃদ্ধি বা কমানো হলে বাজারও অস্থির হয়ে যায়।

জানতে চাইলে বিএসএফআইসির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা এএসএম মুতিউল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, করপোরেশন দেশের চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। উৎপাদন খরচ দেশীয় বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণ করা হয়। আসন্ন চাহিদা মৌসুম সামনে রেখে দাম কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। বেসরকারি কোম্পানিগুলো দাম বাড়িয়েছে কিনা, সে বিষয়ে আমাদের জানা নেই।

দেশে প্রতি বছর ১৫ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। তবে গ্রীষ্ম রোজার মাসেই সবচেয়ে বেশি চিনি বিক্রি হয়। এসব কারণে চাহিদা মৌসুমে দেশে অস্থির হয়ে যায় পণ্যটির দাম। অনেক সময় বিশ্ববাজারে দাম কম থাকলেও মুষ্টিমেয় কয়েকটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কৃত্রিম সরবরাহ সংকটে চিনির বাজার লাগামহীন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় চাহিদা মৌসুমের আগে করপোরেশন দাম বাড়ানোর ফলে দেশের চিনির বাজার ফের অস্থির হচ্ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

খাতুনগঞ্জের ডিও ব্যবসায়ী মো. রাজ্জাক বণিক বার্তাকে জানান, গত বাজেটের আগে চিনির পাইকারি মূল্য ছিল প্রায় হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে। কিন্তু বাজেটের পর থেকেই চিনির দাম বেড়ে হয়ে যায় হাজার টাকায়। সম্প্রতি করপোরেশনের ডিলার পর্যায়ে চিনির দাম বৃদ্ধির অজুহাতে আসন্ন গ্রীষ্ম রোজাকে সামনে রেখে বেসরকারি মিল ডিও ব্যবসায়ীরা চিনির দাম প্রতিদিনই বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এতে রোজায় কেজিপ্রতি চিনির দাম কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন