পদ্মা-যমুনার পানিপ্রবাহ

শুষ্ক মৌসুমে ভয়াবহভাবে নামছে পানির স্তর

সাইদ শাহীন সিরাজগঞ্জ থেকে ফিরে

জনপদকে উর্বরা করেছে পদ্মা-যমুনার বয়ে আনা পলিমাটি। নদীর তেজ স্রোত জন্ম দিয়েছে তীরবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকাসহ মানবিক অনেক গল্প মুহূর্তের। কারণে সেই চর্যাপদের আমল থেকেই পদ্মা-যমুনার প্রবহমানতা নিয়ে একের পর এক শব্দগাথা রচনা করে চলেছেন কবিরা।

সময় বদলেছে। অতীতের সেসব কাব্য আর গাথা এখন দীর্ঘশ্বাসে রূপ নেয় শুষ্ক মৌসুম এলে। পানির স্তর নেমে গিয়ে গভীরতা হারিয়ে ফেলে নদী। তেজস্বিনী-স্রোতস্বিনী যমুনার বুকে জেগে ওঠে অসংখ্য চর। উজানি প্রবাহ না থাকায় অনেক স্থানেই নদীর গভীরতা নেমে আসে হাঁটুরও নিচে। এককালের প্রশস্ত-সমৃদ্ধ নদী হয়ে পড়ে নিষ্প্রভ, গতিহীন এবং প্রাণবৈচিত্র্যে দরিদ্র।

জেলা শহর সিরাজগঞ্জ গড়ে উঠেছে যমুনার তীরে। এখানে নদীর পানির প্রবাহ পরিমাপ করা হয় সদর উপজেলার আমলাপাড়া এলাকায়। হার্ড পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত এলাকার বেড়িবাঁধের কয়েক মিটার দূরেই প্রতি বছর স্থাপন করা হয় পানির পরিমাপ নির্দেশক খুঁটি। চলতি বছর এখানে পানির প্রবাহ এতটাই নেমে এসেছে যে, পরিমাপক খুঁটি স্থাপন করতে হয়েছে বেড়িবাঁধ থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। সেখানেও হাঁটুর নিচ দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে পানি।

এখানেই কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা মর্জিনা বেগমের সঙ্গে। প্রায় দেড় কিলোমিটার চর পাড়ি দিয়ে নদীতে গোসল করতে এসেছেন তিনি। যমুনার জরাজীর্ণতার আক্ষেপ তার কণ্ঠে, গত ৫০ বছরেও এত নিচ দিয়ে আমি পানি প্রবাহিত হতে দেখিনি। যমুনা নদীর পানি প্রতি বছরই যেন কমে যাচ্ছে। অল্প একটু জায়গা বাদে হেঁটেই নদীর এপার-ওপারে পাড়ি দেয়া যায়। চর পড়ে নদীর গতিই ঘুরে গেছে। নদী পরিণত হয়েছে নালায়। ১৫-২০ বছর আগেও নদীর পানি থাকত টইটম্বুর। এখন নদী প্রায় মরে গেছে।

মর্জিনা বেগমের আক্ষেপকে উড়িয়ে দেয়া যায় না কোনোভাবেই। অন্য সময়েও স্থান দিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার পর্যন্ত প্রশস্তায় পানি প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। এখন প্রশস্ততা নেমে এসেছে দেড় কিলোমিটারের কাছাকাছি। প্রশস্ততার অর্ধেকের বেশি স্থানে পানির প্রবাহ এক মিটারের নিচে। মাঝের স্বল্প জায়গায় চার মিটারের গভীরতা থাকলেও বাকি পথটা অনায়াসে হেঁটে পার হওয়া যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের নদীগুলোর পানিপ্রবাহের প্রায় ৯০ শতাংশ আসছে সীমান্ত পেরিয়ে। এসব নদীর উজানে বাঁধ দেয়ার কারণে দেশের অভ্যন্তরে নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ আসতে পারছে না। অন্যদিকে বর্ষায় পানিপ্রবাহ বেশি হলে তা ধরে রাখার মতো কার্যকর ব্যবস্থা দেশের নদীগুলোতে নেই। শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। স্বাভাবিক নিয়মে ভূগর্ভস্থ পানির যে স্তর খালি হয়, তা পরবর্তী সময়ে প্রাকৃৃতিকভাবে পূরণ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটিও এখন আর অঞ্চলে হচ্ছে না। উত্তরের এসব নদীর পানির স্তর নেমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে ভাটিতে থাকা দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোকে লবণাক্ত করে তোলে বঙ্গোপসাগরের নোনাপানি। ফলে সেখানেও দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির সংকট। নদীতে পলি পড়লেও সেগুলো ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সরানো হচ্ছে না। ফলে বর্ষার সময় পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাড়ছে নদীভাঙন। ক্ষয়রোধ করা যাচ্ছে না নদীর দুই পাড়ের। গৃহহারা হচ্ছে মানুষ।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ২০১০ সালে বার্ষিক গড় পানির স্তর ছিল ১০ মিটার। সেটি এখন নেমে এসেছে দশমিক ১৩ মিটারে। অন্যদিকে সর্বনিম্ন পানির স্তরও ২০১০ সালে ছিল দশমিক ২২ মিটার। ২০১৯ সালে তা নেমে এসেছে দশমিক ৭৫ মিটারে। 

বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিরাজগঞ্জ পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর নদীতে ১২০ কোটি টন পলি বালি পড়ছে। শুষ্ক মৌসুমে জমা এসব পলি বালি ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সরানো গেলে সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব। নদীর পানির যথাযথ সংরক্ষণেও নজর দিতে হবে। বাড়াতে হবে জলাশয়ের পানির ধারণক্ষমতা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যেও যমুনার পানির স্তর হ্রাস পাওয়ার পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। এতে দেখা যায়, নদীর নুনখাও পয়েন্টে সর্বনিম্ন সর্বোচ্চ পানির স্তর দুটিই ধারাবাহিকভাবে কমছে। পয়েন্টটিতে ২০১৪ সালে সর্বনিম্ন পানির স্তর ছিল ২০ দশমিক ৫৩ মিটার। ২০১৭ সালে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৭৫ মিটারে। অন্যদিকে সর্বোচ্চ পানির স্তর ২০১৪ সালের ২৭ দশমিক ২৫ মিটার থেকে ২০১৭ সালে নেমে এসেছে ২১ দশমিক শূন্য মিটারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানিপ্রবাহের স্তর নিচে নামায় যমুনায় জেগে উঠেছে অসংখ্য বালুচর। পানির স্তর নিচে নেমে একের পর এক চর জেগে ওঠার গতি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে যমুনার বিস্তীর্ণ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া পরিস্থিতি না বদলালে অঞ্চলের কৃষিতে মহাবিপর্যয় দেখা দেয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।

বিষয়ে বুয়েটের পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) সদ্যসাবেক নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর . এম মনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের নদীগুলোর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ এখন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ছোট-বড় সব ধরনের নদীর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার নদীগুলোয় বর্ষা মৌসুমে পানি ধরে রাখার উন্নত কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে ওই সময়ের অবারিত পানি আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে নদীতে চরের সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। এভাবে ভূ-উপরিস্থ পানির প্রবাহ কমে গেলে ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহ আরো নিচে নেমে যাবে। পরিস্থিতি বর্তমানে সংকট থেকে খরা প্রবণতার দিকে চলে যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ভারতের আসাম থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী দিয়ে। ওই নদী পরে যমুনা নাম ধারণ করে আরিচার কাছে এসে মিশছে পদ্মা নদীতে। যমুনা নদীর শাখা উপনদীর দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া, আত্রাই, বারনই, শিব, ছোট যমুনা, তিস্তা, ধরলা, তুলশীগঙ্গা, বাঙ্গালীনগর, যমুনেশ্বরী ইত্যাদি নদীরও উৎস ওই ব্রহ্মপুত্র-যমুনাই। মূল নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে এসব শাখা নদীতে।

যমুনার মতো পানির স্তর কমেছে পদ্মা নদীতেও। নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে ২০১৪ সালে সর্বনিম্ন পানির স্তর ছিল দশমিক ৩৬ মিটার, যা ২০১৭ সালে এসে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৭৬ মিটারে।

নদীসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উজানে ভারতের নদীকেন্দ্রিক পরিকল্পনার কারণে পলি পড়ে পদ্মা নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে উত্তর দক্ষিণাঞ্চলে পদ্মা সংযুক্ত অর্ধশতাধিক নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। নদীতে মাছ পাচ্ছেন না জেলেরা। পানির অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে নদীর প্রাণবৈচিত্র্য।

দেশের বৃহৎ নদী ব্যবস্থা হলেও মত্স্য খাতে এখন যথাযোগ্য অবদান রাখতে পারছে না পদ্মা-যমুনা। মত্স্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, যমুনা পদ্মা উভয় নদী থেকেই মত্স্য আহরণ কমে এসেছে। দেশে মোট উৎপাদিত মাছের মাত্র দশমিক ৮৬ শতাংশ জোগান দিচ্ছে যমুনা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এখান থেকে মত্স্য আহরণ হয়েছে মাত্র হাজার ৯৯৫ টন। এছাড়া পদ্মা নদীর উঁচুতে মাছের উৎপাদন নেমে এসেছে হাজার ৯৩০ টনে, যা মোট আহরিত মত্স্য সম্পদের প্রায় শতাংশ।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী কে এনামুল হক শামীম বণিক বার্তাকে বলেন, নদী রক্ষায় সরকার শত বছরের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ডেল্টা প্ল্যানের আওতায় সব নদীকেই তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা হবে। এর মাধ্যমে দখল-দূষণ যেমন কমিয়ে আনা হবে, তেমনি নদীতে পানির প্রবাহ ঠিক রাখতেও সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেয়ার মাধ্যমে বেশি পরিমাণে খনন পুনর্খনন করা হচ্ছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত নদী ড্রেজিং করা হচ্ছে। ড্রেজিং ব্যবস্থাপনায় উন্নত পদ্ধতি আনা হয়েছে।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি অশোক ব্যানার্জি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন