১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর সড়ক
দুর্ঘটনায় মারা যান অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। স্ত্রীর অকাল
মৃত্যুর পর সড়ককে নিরাপদ করার লক্ষ্যে আন্দোলনে নামেন ইলিয়াস কাঞ্চন; গড়ে তোলেন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) শিরোনামের এক সামাজিক আন্দোলন। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে এ আন্দোলনে
নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনি। এ আন্দোলন সড়ককে নিরাপদ করতে এবং সবাইকে সচেতন হতে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ইলিয়াস কাঞ্চনের ভাষায়, এ আন্দোলনের সফলতার
মধ্য দিয়েই স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস
উপলক্ষে তাই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে প্রিয়তম স্ত্রীর উদ্দেশে একটি চিঠি
লিখেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। টকিজের পাঠকদের জন্য তা প্রকাশ করা হলো।
প্রিয়তমা,
তোমাকে হয়তো কখনো ওভাবে আনুষ্ঠানিক বলা হয়নি। আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে সেই কথাটি তোমায় নিবেদন করতে চাই, তুমি মনোযোগ দিয়ে শুনবে কিন্তু! তরুণ বয়সে আমি খুব উপন্যাস পড়তাম, বিশেষ করে শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস। মূলত এসব পড়তে পড়তেই আমার মনে তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল, বিয়ের আগে তোমার সঙ্গে অন্তত দুই বছর প্রেম করব।
প্রিয়তমা, তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের দুজনার বিয়ের বিষয়টি শৈশব থেকেই নির্ধারিত ছিল। তার পরও বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা স্বপ্নকে সত্যি করতে বিয়ের আগে আমরা দুজন বছর দুয়েক প্রেম করেছিলাম। আমার সে প্রেমের উদ্দেশ্য ছিল একে অন্যকে আরো কাছ থেকে জানা, ভালোবাসা, তার পরই বিয়ের পিঁড়ি
তে বসা। আমার সৌভাগ্য, আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল, আমি তোমার সঙ্গে
প্রেম করতে পেরেছিলাম।
প্রিয়তমা, তোমার সঙ্গে কখনো কোনো কিছু লুকোইনি, আজও লুকাতে চাই না, আসলে ওই সময়ের প্রেমের মুহূর্তগুলো অন্য আট-দশজন তরুণ-তরুণীর প্রেমের মতোই স্বাভাবিক ছিল। সত্যি কথা বলতে, বিয়ের পরই সত্যিকার অর্থে তোমার প্রতি আমার কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার জন্ম হয়েছিল। তুমি হয়তো জেনে খুশি হবে যে আমার সেই ভালোবাসার গভীরতাটা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তোমাকে ভালো না বেসে আমার কোনো উপায় ছিল না। কারণ বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি আমাকে সত্যিই কতটা ভালোবাসো। তোমার ভালোবাসা আমার হূদয়কে প্রতি মুহূর্ত আলোড়িত করত, আমি তোমার ভালোবাসা অনুভব করতাম। জানি, তুমি আমাকে তোমার ভালোবাসার স্পর্শ দিয়েই ঘিরে রাখতে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি এখনো আমাকে সেভাবেই তোমার ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছ।
প্রিয়তমা, তোমার হয়তো মনে আছে,
আমাদের দুজনার মধুর সম্পর্ক ভেঙে দেয়ার জন্য
কতজনই না কত চেষ্টা করেছে! এতদিন পর এ কথা শুনে তুমি হয়তো হাসবে, কিন্তু তার পরও আজ এ কারণে এ প্রসঙ্গ তুললাম যে, তোমাকে যারা আমার সম্পর্কে ভুল ধারণা দিতে চেয়েছিল, তাদেরই তুমি ভুল হিসেবে প্রমাণ করেছিলে, বিপরীতে আমাকে তুমি নিঃসংকোচে বিশ্বাস করতে। আমার খুব গৌরব
যে, তুমি আমাকে সমুদ্রের বিশালতার মতোই বিশ্বাস করতে, সমুদ্রের গভীরতার মতোই ছিল আমার প্রতি তোমার বিশ্বাসের
গভীরতা। আমি জানি, তুমি জ্ঞাত। তবুও বলছি, আমার প্রতি তোমার ওই
ভালোবাসা, বিশ্বাস আমাকে তোমাকে আরো নিগূঢ়ভাবে ভালোবাসতে শিখিয়েছে।
প্রিয়তমা, ভাবছ সবই তো তুমি জানো, তার পরও কেন আবার আজ
এ প্রসঙ্গ তুলছি। আসলে তোমাকে আজ কেন জানি আবারো বলতে ইচ্ছা করছে, আমাকে তুমি এতটাই ভালোবেসেছ যে, একটা সময় আমার এই উপলব্ধিও হয়েছিল, আমি সেদিনই পরিপূর্ণ মানুষ হব, যেদিন থেকে আমি তোমাকে তোমার মতো করে ভালোবাসতে পারব।
প্রিয়তমা, বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে,
তোমার প্রতি আমার সেই ভালোবাসাটা যখন
পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলছিল,
ঠিক তখনই তুমি আমার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে
গেলে। এ কারণে আমি হয়তো তোমাকে পরিপূর্ণভাবে ভালোবাসতে পারিনি।
প্রিয়তমা, তোমার ভালোবাসাকে পরিপূর্ণতা দিতে আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি সারা দেশের মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করছি এবং তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা সারা দেশের মানুষের ভেতর প্রথিত করার লক্ষ্যেই মাঠে নেমেছি এবং এত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’ চালিয়ে যাচ্ছি।
প্রিয়তমা, শরীরীভাবে তুমি ২৭টি বছর ধরে আমার পাশে নেই। আমি এই শূন্যতা প্রতি মুহূর্ত অনুভব করি। তুমি বিশ্বাস করো, তোমার ওইভাবে চলে যাওয়ার ভয়ংকর মুহুর্তের কথা মনে পড়লে আমি এখনো প্রতিক্ষণ আঁতকে উঠি। আমি সত্যিই চাই না, আর কোনো মানুষ যেন তার প্রিয়জনকে ওভাবে হারায়।
প্রিয়তমা, সড়কপথে এখনো প্রতিদিন যেভাবে তোমার মতোই হাজারো মানুষকে
মৃত্যুর মুখোমুখি হতে দেখি,
তখন আমার আরো বেশি কষ্ট হয়। আমার কেন জানি মনে
হয়, আমি যদি সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে পারি, আমার কোনো তত্পরতার কারণে যদি প্রতিটি মানুষ হাসিমুখে
প্রিয়জনদের কাছে নিরাপদে পৌঁছে যেতে পারে,
তাহলে তুমিও ভীষণ খুশি হবে। সেই সঙ্গে তোমার
প্রতি আমার ভালোবাসাও পরিপূর্ণতা পাবে।
শ্রুতলিখন: রুবেল পারভেজ