সুন্দরবন দিবস আজ

ঝুঁকি জেনেও সুন্দরবনে বাড়ছে পর্যটন কেন্দ্র

হেদায়েৎ হোসেন খুলনা

সুন্দরবনের ভেতরে থাকা সাতটি পর্যটন কেন্দ্র প্রতি বছর দুই লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন। বনের ভেতর দিয়ে পর্যটকদের যাতায়াতের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সার্বিক পরিবেশ। ঝুঁকির কথা জেনেও বনের ভেতর নতুন আরো চারটি পর্যটন কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। অর্থ বরাদ্দসাপেক্ষে আগামী জুলাই থেকে এসব পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটনক কেন্দ্র বাড়ানো হলে সুন্দরবনের জন্য ঝুঁকি আরো বাড়বে। এমনিতেই আগের স্পটে পর্যটকদের যাতায়াতের কারণে বনের পশু-পাখির জীবন হুমকির মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় আরো চারটি কেন্দ্র বাড়ানো হলে সুন্দরবনে পর্যটকদের চাপ আরো বাড়বে। এতে ক্ষতির পরিমাণও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন অন্য কথা। তাদের দাবি, বর্তমানে থাকা সাতটি স্পটে পর্যটকদের চাপ কমানোর লক্ষ্যেই আরো চারটি কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এতে সুন্দরবনের সার্বিক পরিবেশের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন তারা।

সুন্দরবন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে করমজল, হাড়বাড়িয়া, কটকা, কচিখালী, দুবলা, কলাগাছিয়া ও হিরণ পয়েন্ট-নীলকমলে রয়েছে পর্যটন স্পট। নতুন করে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্ধা ও চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক আর পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগে খুলনার শেখেরটেক ও কৈলাসগঞ্জে হবে আরো চারটি পর্যটন স্পট। এজন্য বন বিভাগের ব্যয় হবে ২৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বণিক বার্তাকে বলেন, সুন্দরবনকে ঘিরে বর্তমানে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন কেন্দ্র বন, পরিবেশ ও প্রাণীর জন্য সুখকর নয়। এ প্রক্রিয়া সুন্দরবন সুরক্ষার জন্য সন্তোষজনকও নয়। পুরো সুন্দরবন নিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল তৈরি ও নিয়ন্ত্রিত পর্যটনের বিষয়টি মাথায় নিয়ে কাজ করতে হবে। বন থেকে মত্স্য, কাঁকড়াসহ সব ধরনের সম্পদ আহরণ বন্ধ করা প্রয়োজন। কাঁকড়া আহরণের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

কয়রার মদিনাবাদ এলাকায় পর্যটক আলী কদম বলেন, ট্রলার নিয়ে বনের ভেতর ভ্রমণের সময় ট্রলারের ইঞ্জিনের প্রচণ্ড শব্দে বানরসহ অন্য পশু-পাখি ছোটাছুটি শুরু করে। ট্রলার নিয়ে সুন্দরবনের গহিনে প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখতে ভালোই লেগেছে। কিন্তু ট্রলারের শব্দের কারণে প্রাণিকুলের ছোটাছুটি দেখে মনে হয়েছে, ওদের স্বাভাবিক বিচরণে বিঘ্ন সৃষ্টি করলাম।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দিন খান বলেন, সুন্দরবনে মানুষের অবাধ যাতায়াতের ফলে শব্দদূষণসহ নানা কারণে বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ কারণে আগের সাতটি পর্যটন স্পটের ওপর চাপ কমাতে নতুন আরো চারটি কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় পর্যটকদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কোন স্পটে কী পরিমাণ পর্যটক যেতে পারবে তা নির্ধারণ করা হচ্ছে। পর্যটকদের ক্রমবর্ধমান চাপ সামাল দিতে ইকো-ট্যুরিজমকে বিকশিত করা হচ্ছে। এজন্য বন বিভাগের ব্যয় হবে ২৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্ধা ও চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক আর পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগে খুলনার শেখেরটেক ও কৈলাসগঞ্জে হবে নতুন চারটি স্পট।

সব মিলিয়ে সুন্দরবন সুরক্ষার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। তাই সুন্দরবন সুরক্ষায় সবার আগে বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। সুন্দরবন ঘিরে থাকা এলাকায় ৩৫ লাখ জনগোষ্ঠী রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ছয় লাখ জনগোষ্ঠী সরাসরি সুন্দনবন থেকে মাছ, মধু, কাঁকড়া, গোলপাতাসহ সম্পদ আহরণ করে। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে বিকল্প কর্মসংস্থান করা জরুরি। সে লক্ষ্যে নির্ভরশীলদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৭০ হাজার নির্ভরশীলকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

এ বন কর্মকর্তা বলেন, ‘সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব পর্যটক সুবিধাদি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অনুমোদন হলে আগামী জুলাই থেকেই এর বাস্তবায়ন হতে পারে। এ প্রকল্পের আওতায় পুরনো সাতটি ইকোপার্ক উন্নয়ন, নতুন আরো চারটি ইকোপার্ক স্থাপন, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণসহ সার্বিক উন্নয়ন করা হবে। এজন্য ২৫ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় মেরামত, সংস্কার ও নতুন চারটি ইকোপার্ক স্থাপন হবে।

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশিরুল আল মামুন বলেন, সুন্দরবনে পর্যটকরা যাতে কোনো প্রকার বিড়ম্বনায় না পড়েন, সে বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে। পর্যটকদের জন্য সুনির্দিষ্ট ঘাটের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হচ্ছে। আর পর্যটকদের জন্য থাকা ট্যুর গাইডদের সার্বিকভাবে সতর্ক থাকার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এমপি বলেন, সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প শুরু হয় ২০১১। কিন্তু এ প্রকল্পের আওতায় সুরক্ষার কোনো কাজ হয়নি। সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব নিয়ন্ত্রিত পর্যটক সুবিধা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে সুরক্ষার কিছু কাজ করা হবে। প্রাথমিক অনুমোদন হয়ে গেছে। তবে কিছু ত্রুটি আছে। ত্রুটির মধ্যে রয়েছে গাছের উচ্চতা অনুযায়ী সুন্দরবনে ৭০ ফুট উঁচু ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ ফুট করে দেয়া হয়েছে। সমস্যা হলো, সুন্দরবনে সর্বোচ্চ গাছের উচ্চতা ৬৫-৭০ ফুট। কাজেই ৭০ ফুটের নিচে ওয়াচ টাওয়ার করে সুফল পাওয়া যাবে না। আমরা আবারো এটা বাড়িয়ে আনার চেষ্টা করছি। এছাড়া সুন্দরবনে যে ৬৪টি টহলফাঁড়ি আছে, এগুলোর সবই বাঁশ ও চাটাইয়ের। এসব টহলফাঁড়ি উন্নত করা হবে।

উল্লেখ্য, ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হবে সুন্দরবন দিবস। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ সুন্দরবন সন্নিহিত জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হবে। গতকাল খুলনা প্রেস ক্লাবের হুমায়ুন কবীর বালু মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বশিরুল-আল-মামুন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন