আগের যুগে শীর্ষ অর্থনৈতিক
নীতিনির্ধারকরা সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির প্রধান বিষয়গুলো থেকে অসমতাকে অনেক
দূরবর্তী বিষয় হিসেবে বিবেচনা করতেন। শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে গড়পড়তা একটা সাধারণ
ধারণা ছিল যে মানুষ অধিক আয় ও বিপুলসংখ্যক ভালো চাকরি (মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান) চায় এবং এ লক্ষ্য
অর্জনের সর্বোত্তম উপায় হলো,
দ্রুত জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। অতএব, কীভাবে মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতিগুলো প্রণয়ন করতে হয়—এ প্রশ্নে নীতিনির্ধারকদের অনেকটা চিন্তা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়াটা মোটেই
বিস্ময়ের নয়। তাদের ধারণা সুষ্ঠু ও পরিকল্পিতভাবে প্রণীত মুদ্রা ও আর্থিক নীতি
উচ্চতর সামষ্টিক প্রবৃদ্ধি হার বজায় রাখতে সহায়তা জোগাতে পারে।
অনেক দিন ধরে অসমতাকে নীতি
কাঠামোয় একটি স্বতন্ত্র ইস্যু হিসেবে মনে করা হয়েছিল। মোট কর-রাজস্ব কম বা বেশি প্রগতিশীল করার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত যা মোকাবেলা করা সম্ভব
বলে অনেকের বিশ্বাস। সেক্ষেত্রে তাদের প্রধান বিবেচনা ছিল রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ধনীরা
মধ্যবিত্তদের তুলনায় নিজেদের মোট আয়ের একটি বেশি অংশ প্রদান করবে।
অব্যাহতভাবে মনে হচ্ছে, বিশ্বের এ ধারণার সঙ্গে তিনটি প্রধান সমস্যা অন্তর্ভুক্ত, অন্তত যেমনভাবে এটি আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হয় সেদিক থেকে। উল্লিখিত তিন সমস্যা হেথার বৌশের প্রশংসনীয় নতুন বই ‘আনবাউন্ড: হাউ ইনইকুয়ালিটি কনস্ট্রিক্টস আওয়ার ইকোনমি অ্যান্ড হোয়াট উই ক্যান ডু অ্যাবাউট ইট’-এ পুরোপুরিভাবে স্পষ্ট করে তুলেছেন।
প্রথম সমস্যা হলো, কর ব্যবস্থা এখনো প্রগতিশীল করা যায়নি। ২০১১ সালে ওয়ারেন
বাফেট একটি বিখ্যাত মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তার নিজের করহার তার সহকারীর চেয়ে কম এবং এটি কোনো
বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।’ ১৯৭০-এর দশক থেকে মূলধন (বাফেটের) থেকে সৃষ্ট আয়ের ওপর আরোপিত কার্যকর কর নাটকীয়ভাবে কমেছে।
অন্যদিকে সহকারীদের মতো মজুরিভিত্তিক কর্মীদের আয়ের ওপর কর অনেকটা স্থিতিশীল
থেকেছে। আমরা যদি স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করি—বীমা পরিকল্পনা, ডিডাক্টিবলস ও স্বাস্থ্যে ব্যক্তিগত খরচ—তাহলে দেখা যাবে সাম্প্রতিক দশকগুলোয় গড় জীবনযাত্রা ব্যয় (স্বাস্থ্যসেবা খরচ বাদে থাকা অন্য সব খরচ) খুব কমই ওঠানামা করেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী দশকগুলোয় আয় বা সম্পদের যতটা পুনর্বণ্টন হয়েছে, পরবর্তী সময়ে কোথাও তেমনটি হয়নি (জন গ্রুবারের সঙ্গে লিখিত আমার যৌথ বই ‘জাম্প-স্টার্টিং আমেরিকা’ গ্রন্থে আমরা পরিসংখ্যান ও ইতিহাস আরো বিস্তারিতভাবে
নিরীক্ষা করেছি)।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো, অংশত বাজার প্রবেশে
(মার্কেট এন্ট্রি) প্রতিবন্ধকতার কারণে
অসমতার পরিধি বেড়েছে, যেটিও পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ করতে ভূমিকা
রেখেছে। এটি বোঝা সহজ যে কেন বাফেট বীমা,
রেলওয়ে এবং অন্য খাতের মতো খাতভিত্তিক
কোম্পানিগুলোয় বিনিয়োগ করতে পছন্দ করেন। অন্যদের জন্য চ্যালেঞ্জ করা কঠিন এমন
ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা নিশ্চিত সন্দেহাতীতভাবে তার মুনাফার জন্য ভালো।
কিন্তু একগুচ্ছ বিনিয়োগকারী বাদে কেবল এক খাতের মুনাফা সর্বোচ্চ করা অর্থনৈতিক
নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। পুরো অর্থনীতিজুড়ে অধিকসংখ্যক নতুন নতুন
উদ্যোগ-প্রতিষ্ঠানের বাজার প্রবেশ বিদ্যমান উদ্যোক্তা-শিল্পপতিদের মুনাফা কমাবে এবং এভাবে অসমতা হ্রাস পাবে। কারণ একটি শিল্পে নতুন
প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবেশ অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি এবং নতুন
পণ্য প্রবর্তন ও ভালো সেবা কিংবা উভয়ই নিশ্চিত করতে পারে।
তৃতীয় সমস্যা হলো, একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বোধের দিক
থেকে অসমতা একটি সুফলবিনাশী চালকে পরিণত হয়েছে। যখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রভাবিত
করতে ধনীরা নিজেদের অর্থ ব্যয় করে,
তখন তারা সাধারণত চায় না নিজেদের জন্য বিপুল
সম্পদ সৃষ্টি করা খাতগুলোয় অন্যরা প্রবেশ করুক। কারণ তারা মনে করে, এতে তাদের মুনাফা কমে যাবে। আবার বাজারে থাকা শক্তিশালী
উদ্যোক্তারা অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী প্রতিযোগিতা থেকে আরো সুরক্ষা চায়। তারা আরো
ভর্তুকিও চায়, হোক সেটি কর অব্যাহতি বা অন্যভাবে এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত
লক্ষ্য হলো, ব্যবসায় ব্যর্থ হওয়ার জন্য নিজেদের অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ
করে তোলা, যাতে সমস্যা-বিপদের সময়ে বেইলআউটে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার
সহায়তা পেতে পারে।
হেথার বৌশে এসব সমস্যা-অসংগতিকে একটি তাত্পর্যপূর্ণ ও প্রাণবন্ত প্রক্রিয়ায় সংযোগ স্থাপন করেছে।
এমনকি এ ইস্যু নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন বা করছেন, তাদের জন্য তিনি
যেসব সংযোগ ও সুনির্দিষ্ট নীতি ইস্যু আলোকপাত করেছেন, তা বেশ আলোকসঞ্চারী। এটি বাজার বা ব্যক্তি উদ্যোগবিরোধী
যুক্তি নয়, বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতামূলক গল্প। আর তা হলো, আমরা সেই অসমতাই পাই,
যা আমরা পছন্দ করি, যতই আমরা সতর্ক থাকি যে আমরা একটি পছন্দ তৈরি করছি।
‘আনবাউন্ড’ বিশদভাবে একটি পক্ষপাতমূলক বই নয়। তবে এ থেকে বিদ্যমান
রাজনৈতিক অবস্থার আভাস পাওয়া সহজ। বিদ্যমান ব্যবস্থা যদি ভেঙে যায় তাহলে
স্টার্টারদের জন্য এটিকে ধরে রাখার সহজ ও ন্যায্য উপায় হলো একটি পরিমিত সম্পদ কর।
সুনির্দিষ্ট হার আরোপ (স্পেসিফিকস)
নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তবে ৫০ মিলিয়ন ডলারের অধিক মূল্যের সম্পদের ওপর করারোপ
আমেরিকানদের মধ্যে কেবল শূন্য দশমিক ১ শতাংশ
(০.১ %) ধনীর ওপর প্রভাব ফেলবে।
অধিকন্তু বাজার প্রবেশে
প্রতিবন্ধকতা যদি একটি সমস্যা হয়,
তাহলে ওইসব প্রতিবন্ধকতা যৌক্তিক ও
সময়োপযোগীভাবে কমাতে প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে (অ্যান্টিট্রাস্ট
অ্যাক্টিভিটি) ফোকাস পরিবর্তন করা উচিত। যদি প্রাক-ইন্টারনেট যুগে উন্নয়নকৃত গতানুগতিক মানদণ্ড অসুবিধাজনক বা অকার্যকর প্রমাণ হয়, তাহলে আমাদের সেগুলো হালনাগাদ করা উচিত।
অধিকন্তু অর্থের বিনিময়ে
সম্পদশালী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক অভিগম্যতার ফলে যেহেতু অর্থনীতি অধিক বিকৃত হচ্ছে
এবং কম ন্যায্যমূলক হচ্ছে, সেহেতু আমাদের উচিত ক্যাম্পেইন-ফিন্যান্স ও লবিং নীতিগুলো পরিবর্তন করা। যুক্তরাষ্ট্রে ১ বিলিয়ন মার্কিন
ডলারের অধিক সমমূল্যের সম্পদের ওপর উচ্চতর হার শুধু আনুমানিক ৬০০ মানুষকে
ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তবে এটি একটি শক্তিশালী সংকেত দেবে যে তাদের বেড়ে চলা
প্রভাব খর্ব করা হবে।
আধুনিক পর্যায়ের অসমতা কোনো
দুর্ঘটনা নয়; এটি নীতি পছন্দের ফল,
যেটি তুলনামূলকভাবে ধনীদের দ্বারা প্রভাবিত
হয়েছিল (আবার
‘আনবাউন্ড’ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে)। পেন্ডুলাম কিন্তু অন্যদিকেও
ফিরে আসতে পারে বা আসা উচিত।
কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ানো
থেকে অসমতাকে একটি স্বতন্ত্র ইস্যু হিসেবে দেখার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক
নীতিনির্ধারকদের আর কোনো প্রচেষ্টা বাকি নেই। কার্যকর প্রতিযোগিতাবিরোধী নীতি ও
প্রয়োগের সমন্বয়ে একটি সম্পদ কর প্রবর্তনপূর্বক এটিকে উপস্থাপন করে নতুন ব্যবসা
সৃষ্টি ও নতুন ব্যবসার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]
সাইমন জনসন: আইএমএফের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ; ‘জাম্প-স্টার্টিং আমেরিকা:
হাউ ব্রেকথ্রো সায়েন্স ক্যান রিভাইভ ইকোনমিক
গ্রোথ অ্যান্ড দি আমেরিকান ড্রিম’ গ্রন্থের সহলেখক
ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির