অভিনয়ের জাদুকরের চলে যাওয়ার আট বছর

সাবলিল অভিনয়ের জন্য রূপালি জগতে তুমুল জনপ্রিয় মুখ হুমায়ুন ফরিদী। মঞ্চ, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র- সর্বত্রই ছিল তার অবাধ বিচরণ। অভিনয়ের এই জাদুকর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর মতো এতো স্নিগ্ধ, এতো গভীর সুন্দর আর কিছু নেই’। তিনি সেই ‘গভীর সুন্দর’-কে আলিঙ্গন করে পরপারে পারি জমিয়েছেন আটবছর হয়ে গেল।

কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীর ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও ভক্তরা অনেকেই আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন তাদের প্রিয় এই অভিনেতাকে।

হুমায়ুন ফরিদী ১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম এটিএম নূরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ছেলেবেলা থেকেই বেশ দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন তিনি। শিক্ষকরা তার নাম দিয়েছিল ‘ বাদর’। তিনি ১৯৬৫ সালে পিতার চাকরির সুবাদে মাদারীপুরের ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এ সময় মাদারীপুর থেকেই নাট্য জগতে প্রবেশ করেন। তার নাট্যঙ্গনের গুরু বাশার মাহমুদ। তখন নাট্যকার বাশার মাহমুদের ‘শিল্পী নাট্যগোষ্ঠী’ নামের একটি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে কল্যাণ মিত্রের 'ত্রিরত্ন' নাটকে 'রত্ন'  চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয় তিনি সর্বপ্রথম দর্শকদের সামনে আসেন। এরপর এই সংগঠনের সদস্য হয় 'টাকা আনা পাই', 'দায়ী কে', 'সমাপ্তি', 'অবিচার'সহ ৬টি মঞ্চ নাটকে অংশ নেয়।

অবশেষে ১৯৬৮ সালে মাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণের পর পিতার চাকরির সুবাদে চাঁদপুর সরকারি কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। আল-বেরুনী হলের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল-দীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।

১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নাট্য উৎসবের তিনি অন্যতম সংগঠক ছিলেন। মূলত এ উৎসবের মাধ্যমেই তিনি নাট্যাঙ্গনে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ঢাকা থিয়েটারের সদস্যপদ লাভ করেন।

এরপর তিনি গণমাধ্যমে অনেক নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৯০-এর দশকে হুমায়ুন ফরীদি চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। সেখানেও তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বাংলাদেশের নাট্য ও সিনেমা জগতে তিনি অসাধারণ ও অবিসংবাদিত চরিত্রে অভিনয়ের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।

হুমায়ুন ফরিদী বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত বিখ্যাত সংশপ্তক নাটকে 'কানকাটা রমজান' চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন। 

যে সব নাটকে অভিনয়ের জন্য খ্যাতি লাভ করেন তন্মধ্যে রয়েছে- 
মঞ্চ : ত্রিরত্ন (প্রথম অভিনয়), কিত্তনখোলা, মুন্তাসির ফ্যান্টাসি, কিরামত মঙ্গল(১৯৯০) ও ধূর্ত উই
টিভি: নিখোঁজ সংবাদ, হঠাৎ একদিন, পাথর সময়, সংশপ্তক, সমূদ্রে গাংচিল, কাছের মানুষ, মোহনা, কোথাও কেউ নেই, ভবের হাট প্রভৃতি।

তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো- ‘সন্ত্রাস’, ‘দহন’, ‘লড়াকু’, ‘দিনমজুর’, ‘বীর পুরুষ’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘আজকের হিটলার’, ‘দুর্জয়’, ‘শাসন’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘আসামী বধূ’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘ভণ্ড’, ‘অধিকার চাই’, ‘মিথ্যার মৃত্যু’, ‘ব্যাচেলর’, ‘শ্যামল ছায়া’ ও ‘মেহেরজান’ প্রভৃতি।

সৃজনশীল কর্মযজ্ঞের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘মাতৃত্ব’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতা শাখায় ২০০৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন হুমায়ুন ফরীদি। নাট্যাঙ্গনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাকে সম্মাননা প্রদান করে। বেঁচে থাকতে তিনি তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের স্বীকৃতি নিজের হাতে না পেলেও, ২০১৮ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন।

ব্যক্তিগত জীবনে হুমায়ুন ফরিদী দুবার বিয়ে করেন। প্রথম বিয়ে করেন ১৯৮০'র দশকে। দেবযানী নামের তার এক মেয়ে রয়েছে এ সংসারে। পরবর্তীতে অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফাকে বিয়ে করলেও ২০০৮ সালে তাদের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদের পর নিঃসঙ্গই ছিলেন তিনি। তিনি ৫৯ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন