দিবস

দেশের উন্নয়নে কৃষিবিদদের অবদান

মো. বশিরুল ইসলাম

আমাদের দেশে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ রকম অনেক পেশাজীবী রয়েছেন। পেশাজীবীরা দেশের উন্নয়ন, কৃষি, যোগাযোগ, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, জনকল্যাণ, প্রশাসন খাতে কাজ করেন; যার সুফল সাধারণ জনগণ ভোগ করে। ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদ দিবস। দিবসে অন্যান্য পেশার সঙ্গে কৃষিবিদদের দেশ উন্নয়নের অবদানের কথা তুলে ধরতে আমার প্রয়াস।  

আমরা জানি, ডাক্তারি অনেক বড় মাপের মহৎ পেশা। সামান্য মাথাব্যথা থেকে শুরু করে যেকোনো অসুখ-বিসুখে আমরা ডাক্তারের কাছে ছুটে যাই। ডাক্তারের মুখের কথার ওপর ভরসা করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। ডাক্তাররা সমাজের সেবক, মানুষের সেবক। অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ করে তোলেন। তেমনি ভেটেরিনারি চিকিৎসকও অসুস্থ পশুকে সুস্থ করে তোলেন। একজন কৃষিবিজ্ঞানী কৃষির উত্কর্ষের জন্য গবেষণা করেন, গবেষণা করে উদ্ভাবন করেন নতুন প্রযুক্তি। আর সে প্রযুক্তি মাঠে সম্প্রসারণও করেন কৃষিবিদরা।

বিগত দিনে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বেশকিছু সাফল্য রয়েছে। প্রসূতি নবজাতকের উন্নত চিকিৎসা প্রদানের ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারের ফলে মাতৃ শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া ভিটামিনের সঠিক প্রয়োগে প্রসূতি নবজাতকের ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ উল্লেখযোগ্য হারে নেমে এসেছে। এখন প্রতি বছর ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট তারিখে শিশুদের হেপাটাইটিস বি, হাম, কৃমি, পোলিওসহ নানা রোগের প্রতিষেধক ওষুধ খাওয়ানো হয়। কিন্তু চিকিৎসা পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গবেষণা, আবিষ্কার আমাদের দেশে খুবই নগণ্য।

আমাদের সমাজের একেবারে উচ্চশ্রেণীর পেশাগুলোর মধ্যে একটি হলো প্রকৌশলী পেশা। পেশার যেমন সম্মান রয়েছে, তেমনি রয়েছে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা। পেশার মানুষজন একটি সমাজের নির্মাতা হিসেবে কাজ করেন। আর কারণেই পেশাটি অনেক বেশি জনপ্রিয়। জনপ্রিয় হলেও পেশাজীবীদের আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য গবেষণা হাতেগোনা। আমরা যদি অন্যান্য পেশার সঙ্গে কৃষি পেশাকে তুলনা করি, তাহলে দেখব কৃষিবিদদের গবেষণা সরাসরি দেশ উন্নয়নে কাজ করছে বলে আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি।

আমি কেন, আজ সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে বর্তমান সময়ে দেশের উন্নতির জন্য বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত কৃষিবিদরাই বেশি অবদান রেখেছেন এবং রেখে চলছেন। কৃষিবিদদের হাতেই সৃষ্টি হচ্ছে ফসলের নতুন জাত কিংবা ফসল উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি। শুধু ফসল কেন, পাশাপাশি গবাদিপশুর উন্নয়ন, দুধের মান পরিমাণ বাড়ানো, মাংসের জন্য উন্নত জাতের পশুপালন প্রযুক্তি, বিভিন্ন ধরনের মাছের জাত প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষি খামারের বিভিন্ন প্রকার যান্ত্রিকীকরণ কিংবা কৃষির সব ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণএসবই কৃষিবিদদের হাতের স্পর্শে প্রাণ পায়। উজ্জীবিত হয় সংশ্লিষ্ট সবাই। এভাবেই ঘুরে দাঁড়ায় দেশের মেরুদণ্ডখ্যাত কৃষকের অর্থনৈতিক অবকাঠামো। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার সুবাদে কৃষিবিদরা দেশে আজ এক মর্যাদাবান পেশাজীবী হিসেবে স্বীকৃত। কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণা ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ফলে দেশ আজ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির বিভিন্ন সূচকে বিশ্বের জন্য পথিকৃৎ।

ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ অবস্থানে। সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। কেবল সবজি আর ধানেই নয়; মাছ, ছাগল উৎপাদনেও বিশ্বে আয়তনের দিক থেকে অনেক পেছনে থাকা বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ, আমে সপ্তম, আলুতে অষ্টম এবং ফলে দশম। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, বিশ্বে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন হয়, তার ৮৬ শতাংশই হয় আমাদের দেশে। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম। আম উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অবস্থানে। আর আলু উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০ দেশের কাতারে এসেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে আলু, সবজি আর আম রফতানি হচ্ছে বিদেশে। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ।

এসব সম্ভব হয়েছে আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণার মাধ্যমে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ৮৮টি ইনব্রিড ছয়টি উচ্চফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। পরমাণু শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ১৮টি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের মোট ১০৮টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে এবং দেশের কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলছে। এছাড়া বিনা সাফল্যের সঙ্গে উদ্ভাবন করেছে শিম, ডাল তেলজাতীয় আটটি ফসলের জন্য জীবাণু সার, যা মাটির গুণাগুণ রক্ষাসহ ডাল তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেন সারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

দেশের জলবায়ু কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পর্যন্ত বিভিন্ন ফসলের ৫৪৫টি উচ্চফলনশীল জাত এবং ৫০৫টি ফসল উৎপাদনের প্রযুক্তিসহ মোট হাজার ৫০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ডাল, তৈলবীজ, সবজি, ফলের ১০ হাজারের অধিক কৌলি সম্পদ (জার্মপ্লাজম) জিন ব্যাংকের মাধ্যমে সংরক্ষণ করছে। পাটজাতীয় ফসলের ৪৫টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যার মধ্যে দেশী পাট ২৪টি, তোষা পাট ১৫টি, কেনাফ চারটি মেস্তা দুটি। ওই ৪৫টি জাতের মধ্যে বর্তমানে নয়টি দেশী, ছয়টি তোষা, তিনটি কেনাফ এবং দুটি মেস্তা জাতের বীজ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত আবাদ হচ্ছে। এছাড়া সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট পর্যন্ত ৪৬টি জাত অবমুক্ত করেছে। এর বাইরে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো গবেষণা করে বিভিন্ন জাত উদ্ভাবন করেছে।

সরকারের ডিমওয়ালা ইলিশ সংরক্ষণ জাটকা নিধন নিষিদ্ধকরণের নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এখন ইলিশ উৎপাদন বহুল পরিমাণে বেড়েছে। চিংড়ি রফতানি থেকে প্রতি বছর আমাদের আয় ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া পুষ্টির অন্যান্য উৎপাদন ডিম, দুধ মাংসের উৎপাদনও বহুল পরিমাণে বেড়েছে। তাতে বেড়েছে এসব পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জনপ্রতি প্রাপ্যতা।

বর্তমান সরকারের সুপ্রসারিত কৃষিনীতি, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাণিজ্যিক কৃষি উন্নয়ন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং উন্নয়নসহ কৃষির আধুনিকীকরণ, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন সম্প্রসারণে গবেষণা সুবিধা বৃদ্ধিসহ নানামুখী পদক্ষেপের কারণে কৃষিতে ঘটছে নীরব বিপ্লব। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। আরো কত নিত্যনতুন সফলতার হাতছানি আমাদের ডাকছে শুভ সুন্দর আগামীতে। সবই কৃষিবিদদের ঐকান্তিক চেষ্টায় সফলতা পেয়েছে।

একসময় কৃষক যেমন শোষণ আর বঞ্চনার শিকার হতেন, তেমনি কৃষকের অকৃত্রিম বন্ধু কৃষিবিদরাও সামাজিক অবহেলা তথা অমর্যাদার শিকার হতেন। স্বাধীনতার আগে স্নাতক শেষ করে চাকরিতে যোগদানের সময় কৃষিবিদদের দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হতো। ফলে স্বাধীনতার আগে থেকেই চিকিৎসক প্রকৌশলীদের মতো কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার মর্যাদা দেয়ার দাবি ওঠে। সময় দাবি আদায়ে আন্দোলন করতে গিয়ে মারা যান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মলয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব ভালো করেই জানতেন, কৃষিপ্রধান দেশে কৃষির সম্পূর্ণ বিকাশ উত্কর্ষ ব্যতিরেকে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। অবশেষে সেই আন্দোলনের সফল সমাপ্তি হয়েছে জাতির জনকের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে, ঐতিহাসিক ঘোষণার মাধ্যমে। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে আখ্যায়িত করে পে-স্কেল সংশোধনের ব্যবস্থা করেন। এর পর থেকে প্রথম শ্রেণীর সুবিধাগুলো পে-স্কেলের মাধ্যমেও স্বীকৃত হয়। ফলে কৃষিবিদরা যেমন সম্মানিত হয়েছেন, তেমনি দেশে কৃষিরও ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাতে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

দেশের অঞ্চলভিত্তিক আরো নতুন জাত উদ্ভাবন, কৃষককে ফসলি উৎপাদনে আগ্রহীকরণ, অঞ্চলভিত্তিক কৃষিসেবা প্রদান, বিভিন্ন কৃষি সংস্থার যথাযথ সহযোগিতা এবং কৃষিবিদদের নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষিতে আরো উন্নয়ন সম্ভব। এছাড়া কৃষি ইপিজেড কৃষির যান্ত্রিকীকরণই হবে আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের হাতিয়ার। এর ফলে সব কৃষিসেবা পৌঁছে যাবে কৃষকের দোরগোড়ায়। আশা করি, বর্তমান সরকারের ডেলটা প্ল্যান বাস্তবায়ন হলে দেশের সর্বত্র বিশেষ করে উপকূলীয় কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন হবে এবং ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে কয়েক গুণ হারে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে বার্ষিক খাদ্যশস্য উৎপাদন হতো দেড় কোটি টন। অথচ বর্তমানে বার্ষিক খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে তিন কোটি টনের বেশি। আর উৎপাদন চার কোটি টনে পৌঁছতে চলছে নানা পরিকল্পনা। এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে স্বাধীনতার পর থেকে পর্যন্ত নানা কারণে দেশের কৃষিজমি কমেছে অর্ধেকের বেশি। তার পরেও কৃষিতে সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে সাধারণ কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং কৃষিবিদ কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণার ফলে। কৃষিবিদরা নিজেদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্যই নিজ নিজ দায়িত্বে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। ধারা অব্যাহত থাকুক, এগিয়ে যাক আমাদের কৃষি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বাংলাদেশ খাদ্যশস্য রফতানিকারক দেশে পরিণত হোক, কৃষিবিদ দিবসে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

 

মো. বশিরুল ইসলাম: জনসংযোগ কর্মকর্তা

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন