বিদেশী নাগরিকদের কর ফাঁকি রোধ

সরকারি নজরদারি ও সংশ্লিষ্ট টাস্কফোর্সের সক্রিয়তা বাড়াতে হবে

বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রীয় রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমান্তরাল দুটো চিত্র বিদ্যমান। একদিকে চলতি অর্থবছরের সাত মাস পার হলেও রাজস্ব আদায় পরিস্থিতির এখনো উন্নতি হয়নি। প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না বলে ঘাটতি বেড়েই চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থবছর শেষে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য থেকে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। আরেকটি চিত্র হলো, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীদের কর ফাঁকি। বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত ২৩ হাজার ৮৫৪ জন বিদেশীর ওয়ার্ক পারমিট থাকলেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয়কর দিয়েছে মাত্র সাড়ে নয় হাজার বিদেশী নাগরিক। তার মানে অর্ধেকের বেশি বিদেশীই আয়কর দেয়নি। এটি কেবল এক অর্থবছরের হিসাব মাত্র। অন্য বছরগুলোয়ও নিশ্চয়ই কম বেশি এমনটিই হচ্ছে। স্পষ্টত বেড়ে চলা রাজস্ব ঘাটতির সঙ্গে বিদেশীদের এই কর ফাঁকির প্রবণতারও একটি যোগসূত্র রয়েছে। আমাদের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বাজেট এলে বরাবরই করের সীমা নতুন করক্ষেত্র বের করতে গলদ্ঘর্ম হয়। দেশী নাগরিকদের মধ্যে করজাল বাড়াতে ফাঁকি রোধে সক্রিয় থাকে অধিক। কিন্তু বিদেশী নাগরিকদের কর ফাঁকি রোধে এনবিআরের দৃশ্যমান পদক্ষেপের সামান্য ইঙ্গিতও আমাদের মনে পড়ে না। নিষ্ক্রিয়তার অবসান জরুরি।

লক্ষণীয়, দেশে কর্মরত বিদেশীদের বেতনের প্রকৃত অংক গোপন করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অপেক্ষাকৃত কম বেতন দেখানোর ফলে লাভবান হচ্ছে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তি, যা রীতিমতো বেআইনি। তাই দেশে বিদেশীদের অবস্থান, সংখ্যা, তারা কোথায় কী কাজ করছে ইত্যাদিসহ সামগ্রিক বিষয় নজরদারির মধ্যে আনা জরুরি। কোথায় কতজন বিদেশী কর্মী কাজ করছে, তাদের বিস্তারিত তথ্য না থাকার বিষয়টি আশঙ্কার। বিদেশীদের বিভিন্ন অপরাধকর্মে জড়িত থাকার বিষয়টিও অস্বীকার করা যায় না। কিছুদিন আগে এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এছাড়া মানব পাচার, মাদক অস্ত্র ব্যবসা, চোরাচালান, হুন্ডি কারবার ইত্যাদি অপরাধে বিদেশীদের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা মোটেই নতুন নয়। সন্ত্রাস নাশকতামূলক ঘটনার সঙ্গে তাদের কারো কারো সংশ্লিষ্টতা থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। বর্তমান নিয়মে দেশে কোনো বিদেশী নাগরিক তিন মাস অবস্থান করলে তার কর ফাইল খুলতে হয়। অনেক বিদেশী নাগরিক কর ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে তিন মাসের ঠিক আগে বাংলাদেশ ত্যাগ করে আবার ফেরত আসে। অনেকে বছরের পর বছর পার করলেও প্রক্রিয়ায় কর এড়িয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এনবিআরের উচিত সক্রিয়ভাবে তত্পরতা চালিয়ে কর আদায়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া। রাজস্ব প্রদান ছাড়া দেশের অর্থ বিদেশে নিয়ে যাওয়া মানে অর্থ পাচার। অবস্থা থেকে উত্তরণে দরকার বাস্তবানুগ সময়োপযোগী উদ্যোগ।

এক রক্ষণশীল হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দেশ থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে দশমিক ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স অবৈধভাবে পাচার হয়। সে কারণে কর ফাঁকির যে ঘটনা ঘটে, তাতে বছরে ন্যূনতম প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। বিদেশীদের যথাযথভাবে করের আওতায় আনা গেলে রাজস্ব ঘাটতি কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে বৈকি। কাজেই বিষয়টিকে হেলায় নেয়ার সুযোগ নেই। এদিকে বিদেশীদের আয়করের আওতায় আনতে না পারার জন্য সরকারের দুর্বল নজরদারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের ওপর সরকারের নজরদারি খুবই দুর্বল। এছাড়া বিদেশী কর্মীদের কাজের অনুমতি দেয়া এবং তাদের কাছ থেকে কর আদায়ে আইন থাকলেও তার খুব একটা প্রয়োগ নেই। বিদেশী নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহে গঠিত টাস্কফোর্সের কার্যক্রমেও গতি নেই। টাস্কফোর্সের অন্তর্ভুক্ত সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতায় গত তিন বছরেও গতি পায়নি সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) ‘ডাটা ব্যাংক’-এর কার্যক্রম। এমনকি বিমানবন্দরগুলোয় বিদেশী কর্মীদের জন্য আয়কর বুথ চালুর কথা থাকলেও সেটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে খুব সহজেই ভ্রমণ ভিসায় এসে নানা কাজে যুক্ত হতে পারছে বিদেশীরা। আর ফাঁকি দিচ্ছে কর। এখন অবস্থা বদলাতে হলে বিদেশীদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়পূর্বক তাদের ওপর সরকারি নজরদারি বাড়াতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট টাস্কফোর্সকে কার্যকর করে তুলতে হবে। তাদের সক্রিয়তা বাড়াতে হবে লক্ষণীয় মাত্রায়।

অস্বীকারের উপায় নেই, বিশ্বায়নের যুগে এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিদেশী কর্মীদের কাজ করা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তদুপরি আমরা বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছি। অভিপ্রায়ের সঙ্গে বিদেশী কর্মীদের অংশগ্রহণ পরিপূরক। প্রতিটি দেশ তার শ্রমবাজার খোলা রাখে নিজের অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক উন্নয়নের স্বার্থে। পরস্পরের জন্যসমান সমানহলে তখনই কেবল বিদেশী কর্মী নিয়োগের অর্থনৈতিক সুফল টেকসই সুখকর হয়। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে চলছে, তাতে আমরা খুব একটা লাভবান হচ্ছি না। কাজেই বাংলাদেশে বিদেশী কর্মী নিয়োগে অবিলম্বে একটি সমন্বিত কার্যকর কৌশলগত নীতিমালা প্রণয়ন এবং তাদের যথাযথভাবে করের আওতায় আনতে ফলপ্রসূ উপায় অন্বেষণ এখন সময়ের দাবি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন