করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন কতোদূর

বণিক বার্তা অনলাইন

ধারণার চেয়েও মারাত্মক রূপ নিয়েছে চীনের নতুন করোনাভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর নতুন নাম দিয়েছে ‘কভিড-১৯’। এ ভাইরাস প্রতিরোধে এরই মধ্যে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিষেধক তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি কার্যকর ও নিরাপদ প্রতিষেধক তৈরি করতে কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তাছাড়া এ প্রক্রিয়া বেশ ব্যয়বহুল।

বিশ্বের অন্তত ২৮টিরও বেশি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। গতকাল মঙ্গলবার চীনে আরো ৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চীনের ১ হাজার ১১৩ জনসহ সবমিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১১৫ জনে। প্রাণহানির দিক থেকে এরই মধ্যে এটি সার্স মহামারীকে ছাড়িয়ে গেছে। 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। কারণ ভবিষ্যতে আরো সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। মায়ো ক্লিনিকের ভ্যাকসিন রিসার্চ গ্রুডের পরিচালক ডা. গ্রেগরি পোল্যান্ড বলেন, এটা ধারণা করা ভুল হবে যে, এমনটি আর ঘটবে না। এরকম অবশ্যই আবার ঘটবে। ইতিহাস বলে, এমনটি হয়।

এদিকে সার্স, মার্স ইত্যাদি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে উদ্যোগ থাকলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। কারণ প্রাথমিক গবেষণাগুলোতে নিরাপত্তাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এখন আশা করা হচ্ছে, কোনো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এদিকটাতে এগিয়ে আসবে। তারপরও এটি জনস্বাস্থ্যের ব্যাপার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বিপর্যয় সামলাতে ৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার অনুদানের আহ্বান জানিয়েছে। এরই মধ্যে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ১০ কোটি ডলার অনুদান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তবে ডা. গ্রেগরি বলছেন, কেউ যদি বলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আমরা প্রতিষেধক বানিয়ে ফেলবো। তাহলে তারা মানুষকে ভুল তথ্য দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত এমনটা হচ্ছে না!

ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণার সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে যুক্ত আছেন ডা. গ্রেগরি। তিনি বলছেন, প্রতিষেধক তৈরি ও যুক্তরাষ্ট্রে সেটির অনুমোদন পেতে অন্তত একশ কোটি ডলার ব্যয় হবে। করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরিতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। কারণ প্রতিষেধকের নিরাপত্তা ও কার্যকরিতা যাচাই করার জন্য মানুষের দেহে কয়েকটি ধাপে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে হয়।

অবশ্য গবেষকরা এ ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির পেছনে গবেষণা ও উন্নয়ন বাবদ ব্যয় সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে ধারণা দিতে পারছেন না। তারা ২০ কোটি ১৫০ কোটি ডলার পর্যন্ত বাজেট দিচ্ছেন। তবে এ ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি যে বেশ সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হবে তাতে তারা সবাই একমত।

জনসন অ্যান্ড জনসন, মডার্না এবং ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো ওষুধ প্রস্তুতকারক ও জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছ্নে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির অনেক মূল্য রয়েছে। এতে পরবর্তী মহামারী হয়তো ঠেকানো যাবে। কিছু ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এইচআইভি অথবা হেপাটাইটিস ভাইরাস প্রতিরোধের ওষুধ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার শুরু করার অনুমোদন দেয়ার কথা চিন্তা করছে।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ভ্যাকসিন গবেষণার ফল পাওয়া যায় কয়েক বছর পর। বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসার ক্ষেত্রে এটি একটি চ্যালেঞ্জ। ভ্যাকসিন তৈরিতে ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। কিন্তু ততোদিনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থাকবে না। তখন তাদের বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসার সুযোগ হারিয়ে যাবে। এ কারণে এ বিনিয়োগটি করতে হবে সরকার অথবা এক বা একাধিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে। সরকারি তহবিলের সঙ্কট হলে দাতাদেরই হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আগের অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের তহবিলের স্রোত খুব দ্রুতই মরে যায়। মানুষের নজর সরে গেলে অনুদানও বন্ধ হয়ে যায়।

এর আগের দুই করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও কিন্তু সেটিই ঘটেছে। ২০০২-০৩ সালে সার্স এবং ২০১২ সালে মার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় অনেকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে আর এগোয়নি। ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগ থাকলেও জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তাতেই তা আটকে আছে। যদিও মার্স নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। 

এক্ষেত্রে ইবোলা অবশ্য ব্যতিক্রম। ২০১৪ সালে নতুন করে প্রাদুর্ভাব ঘটে। এখনো এটি চলছে। ২০১৮ সালে আফ্রিকায় ব্যাপকভাবে দেখা দেয়। বারবার রোগটি ফিরে আসার কারণে জরুরি ভিত্তিতে ২০১৯ সালেই প্রথম ভ্যাকসিন অনুমোদন করা হয়। যদিও এ অবস্থায় পৌঁছাতে কয়েক বছর ধরে কয়েক হাজার মানুষের শরীরে এ ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালাতে হয়েছে। ভ্যাকসিনটি তৈরি করেছে ওষুধপ্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান মার্ক।

ফলে অন্যান্য ভ্যাকসনি তৈরিতেও এমন সময় লাগবে এটাই স্বাভাবিক। ১৯৬০ এর দশকে রুবেলা ভ্যাকসিন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ডা. স্ট্যানলি প্লটকিন। ১৯৫৮ সাল থেকে এ উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন তিনি। তিনি বলছেন, একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়া আগের চেয়ে আরো সহজ ও দ্রুত হয়েছে। কিন্তু এরপরও পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কয়েক বছর লেগে যাবে বলে মনে করেন ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার এ এমেরিটাস অধ্যাপক। 

প্লটকিন বলেন, বিপুল জনসংখ্যার ওপর প্রয়োগযোগ্য নতুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি কমপক্ষে দুই বছরের ব্যাপার।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা অবশ্য আরো কম সময়ের কথা বলছেন। কিন্তু এটি ওষুধ তৈরির প্রথম ধাপ মাত্র। ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউটের সংক্রামক রোগ বিভাগের পরিচালক ডা. অ্যান্থনি ফুসি বলেন, তারা মডার্নার একটি ভ্যাকসিন আগামী দুয়েক মাসের মধ্যে পরীক্ষা শুরু করবেন। প্রথম পরীক্ষায় ভলান্টিয়ারদের ওপর এ ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা, বিভিন্ন ডোজ যাচাই করা হবে। 

টেক্সাস চিলড্রেনস হসপিটাল সেন্টার ফর ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্টের সহকারী পরিচালক এলেনা বোটাজি বলেন, তারা আশা করছেন, এক বছরের কম সময়ের মধ্যে তারা একটি সমাধানসূত্র পাবেন। এরপর দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় কয়েকশ লোকের ওপর ওষুধের ডোজ পরীক্ষা করা শুরু হবে। 

শেষ ধাপের পরীক্ষাটি সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের। মায়ো ক্লিনিকের পোল্যান্ড বলেন, এ ধাপে কমপক্ষে হাজারদশেক রোগী এবং কয়েকশ কোটি ডলার খরচ হয়। এ ধাপে ভ্যাকসিন ঠিকমতো কাজ করছে কি না বা কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না যাচাই করা হয়। 

সেই যাই হোক, ২০ বছরের মধ্যে বড় ধরনের সংক্রমণগুলোর মধ্যে সার্স, মার্সের সঙ্গে তৃতীয় সর্বোচ্চ মারাত্মক ভাইরাস হিসেবে এলো ‘কভিড-১৯’। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আরেকটি আসা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র! ফলে এটি এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন