কানাডার ‘বেগমপাড়া’ বৃত্তান্ত

বণিক বার্তা অনলাইন

উন্নত জীবনের খোঁজে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে অভিবাসী হচ্ছেন বাংলাদেশীরা। অর্থ ও সম্পদ পাচারের দুরভিসন্ধিসহ নানা কারণে আইনের নাগাল এড়ানোর তাগিদ থেকেও ঘটছে অনেক স্থায়ী অভিবাসনের ঘটনা। কানাডা সরকারের তথ্যমতে, পাঁচ বছর ধরে প্রতি বছর তিন হাজারের অধিক বাংলাদেশী কানাডায় স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেয়েছেন। আর ২০০৬ সাল থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত পিআর পেয়েছেন ৪৪ হাজার ১৮৬ জন বাংলাদেশী।

অভিযোগ উঠেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যেসব বাংলাদেশী বিনিয়োগকারী কোটায় কানাডায় পিআর সুযোগ পেয়েছেন তাদের একটা অংশ মূলত অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় এ বিনিয়োগ করেছেন। দেশ থেকে নেয়া দুর্নীতি ও লুটের টাকায় সেখানে বিলাসী জীবনযাপন করছেন তারা। কানাডায় অভিবাসন নিয়ে থাকা বাংলাদেশীরা এসব দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে নেমেছেন ভিন্নধর্মী এক আন্দোলন। তারা দেশ থেকে অর্থ লুট করে এবং অর্থ পাচার করে পারি জমানোদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের রেশ এসে পড়েছে দেশেও।

বলা হয় বাংলাদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া বহু ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিক তাদের স্ত্রী-সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছেন কানাডায়। তাদের নিয়েই গড়ে উঠেছে এই 'বেগমপাড়া'। গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশে ‘বেগমপাড়া’ শব্দটি প্রায়ই উচ্চারিত হচ্ছে। কানাডার এই বিশেষ ‘অঞ্চলের’ সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘অর্থপাচার’ - ‘অর্থ লুট’ শব্দগুলো। আদৌ কি ‘বেগমপাড়া’ নামে কানাডায় কোন জায়গার নাম আছে? এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে বিবিসি বাংলা। 

বেগমপুরা থেকে বেগমপাড়া

টরন্টোর পাশে লেক অন্টারিওর তীরে আরেকটি শহর মিসিসাগা। শহরের একটি বড় কন্ডোমিনিয়াম হঠাৎ করেই কানাডার গণমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয় বছর দশেক আগে। সেই কন্ডোমিনিয়ামে মূলত থাকেন দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা বহু অভিবাসী পরিবার। এসব পরিবারের স্বামীরা কাজ করেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

স্বামীদের অনুপস্থিতিতে স্ত্রীদের নিঃসঙ্গ জীবন এবং কঠিন জীবন সংগ্রাম নিয়ে এক ভারতীয় পরিচালক রশ্মি লাম্বা তৈরি করলেন একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম। নাম ‘বেগমপুরা : দ্য ওয়াইভস কলোনি।’ ভারতীয় পরিচালক রশ্মি লাম্বার ছবি 'বেগমপুরা' থেকেই এসেছে বেগমপাড়া নাম। ‘বেগমপুরা’ ছবি নিয়ে আলোচনা শুরু হলো কানাডার গণমাধ্যমে। আর এই ছবির সূত্র ধরে সেখানকার পত্র-পত্রিকাতেও প্রকাশিত হতে থাকলো অনেক ধরনের প্রতিবেদন।

‘বেগমপুরা : দ্য ওয়াইভস কলোনি’ ডকুমেন্টারি ফিল্মটির ওয়েবসাইটে এসম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেয়া রয়েছে।

বেগমপুরার আসল কাহিনী
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে কাজ করেন ভারত বা পাকিস্তানের যেসব মানুষ, যাদের বেশিরভাগই মূলত প্রকৌশলী, তারা জীবনের একটা সময় সপরিবারে কানাডায় চলে আসেন অভিবাসী হয়ে। কিন্তু এরা কানাডায় তাদের পেশাগত যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ খুঁজে না পেয়ে আবার ফিরে যান মধ্যপ্রাচ্যেই, তবে পরিবার রেখে যান কানাডায়।

মধ্যপ্রাচ্যে তারা ভালোই আয় করেন। সেই অর্থ তারা কানাডায় স্ত্রীদের কাছে পাঠান পরিবারের ভরণপোষণের জন্য। মিসিসাগার কয়েকটি কন্ডোমিনিয়াম (বহুতল ভবন), যেখানে থাকতেন এরকম অনেক পরিবার, সেগুলো পরিচিত হয়ে উঠে বেগমপুরা নামে। যেখানে স্বামীর অনুপস্থিতিতে বেগম বা স্ত্রীরাই পরিবারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন একা হাতে।

কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর জানান, এই বেগমপুরার কাহিনী থেকেই মূলত প্রথম বাংলাদেশী 'বেগমপাড়া'র কথা চালু হয়। তৃতীয় কোন দেশ হয়ে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় অর্থ পাচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ শওগাত আলী সাগরই প্রথম 'বেগমপাড়া' কথাটি ব্যবহার করেছিলেন টরন্টো স্টারে প্রকাশিত বেগমপুরার কাহিনী তার এক লেখায় বর্ণনা করতে গিয়ে। এরপর বাংলাদেশের অনেকেই এই 'বেগমপাড়া' কথাটি ব্যবহার করেছেন বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিকদের কানাডায় পাড়ি জমিয়ে সেখানে দ্বিতীয় নিবাস স্থাপনের প্রতি ইঙ্গিত করে।

শওগাত আলী সাগর বলেন, ‘বেগমপুরার যে বেগমরা, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কথিত বেগমপাড়ার বেগমদের অনেক তফাৎ। বেগমপুরার বেগমদের স্বামীরা পেশাজীবী, মধ্যপ্রাচ্যে কঠোর পরিশ্রম করে সেই অর্থ কানাডায় পাঠাচ্ছেন তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য। অন্যদিকে আমরা যে বেগমপল্লীর কথা বলি, সেটি কিন্তু একেবারেই ভিন্ন অর্থে, যেখানে দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ কানাডায় পাচার করে সেখানে আয়েশি জীবনযাপন করছে তারা সপরিবারে।’

বেগমপাড়া আসলে কোথায়
টরন্টোতে বা কানাডায় সেই অর্থে কী কোন সুনির্দিষ্ট এলাকা আছে, যেটিকে বেগমপাড়া বলা হয়? সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর বলছেন, এই বেগমপাড়া আসলে কানাডায় পাড়ি জমানো দুর্নীতিগ্রস্তদের স্ত্রীদের দ্বিতীয় নিবাস অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাস্তবে এমন কোন সুনির্দিষ্ট এলাকা নেই, যেটিকে 'বেগমপাড়া' বলা হয়।

টরন্টোতে বেশ কয়েকবছর ধরে রিয়েল এস্টেট এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন সাজ্জাদ আলী। তিনি বলেন, এরকম বেগমপাড়া নামে হয়তো কোন এলাকা নেই, কিন্তু এমন জায়গা বাস্তবে রয়েছে, যেখানে এধরনের বহু বাংলাদেশী গিয়ে বসতি গেড়েছেন। বেগমপাড়া যে শুধু কথার কথা, লোকমুখে শোনা ব্যাপার, তা নয়। আমরা দেখি এখানে বাংলাদেশীরা অনেক সংখ্যায়, এমন সব জায়গায় বাড়িঘর কিনেছেন, যেটা একটু অভিজাত এলাকা। কিন্তু তাদের জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে তাদের এই সম্পদ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তারা এখানে তেমন কিছু করেন বলে তো আমরা দেখি না। কীভাবে তারা এক বা দুই মিলিয়ন ডলারের একটি বাড়ি কেনার ক্ষমতা রাখেন!


কানাডার সাধারণ প্রবাসী বাংলাদেশিদের ধারণা, কানাডায় অর্জিত সম্পদ দিয়ে তারা এসব বাড়ি কেনেননি, এই অর্থ এসেছে বাংলাদেশ থেকে।

এরকম বাংলাদেশীর সংখ্যা কতো?
পুরো কানাডায় প্রায় ৮০ হাজার বাংলাদেশী আছেন বলে ধারণা করা হয়। এদের বেশিরভাগ থাকেন টরন্টো বা তার আশেপাশে। গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে বহু উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী কানাডায় গেছেন অভিবাসী হয়ে।

সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর বলেন, ‘২০০৮ হতে ২০১৪ সময়কালে বেশি গেছে ব্যবসায়ীরা। তখন ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরিতে একটি ভিসা দেয়া হতো, তখন কানাডায় একটি নির্দিষ্ট অংক বিনিয়োগ করে বা কানাডার সরকারের কাছে অর্থ জমা রেখে ইমিগ্রেশনের সুযোগ ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে কানাডার সরকার এটি বন্ধ করে দেয়। এর অন্যতম কারণ নাকি ছিল এই ক্যাটাগরিতে আসা অভিবাসীদের কর পরিশোধের রেকর্ড।’

তিনি আরো বলেন, ‘দেখা গেল কানাডার একেবারে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যে পরিমাণ কর দেয়, এদের দেয়া করের পরিমাণ তার চেয়েও কম। বা তারা একেবারেই কর দেয় না। তখন সরকার এই স্কিম বন্ধ করে দেয়’।

ব্যাপকহারে এধরনের লোকজনের কানাডায় অভিবাসন প্রথম শুরু হয় ২০০৭-২০০৮ সালে যখন বাংলাদেশে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হয়।

দীর্ঘদিন ধরে টরন্টোতে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক ব্যবসায়ীর একটি দল কানাডায় যায়। টরন্টোর বেলভিউ এলাকায় কিছু হাই রাইজ কন্ডোমিনিয়াম আছে। বেশ বিলাসবহুল। ডাউনটাউন থেকে বেশি দূরে নয়। প্রথম যে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন, তারা ওখানে উঠেছিলেন। তারপরে ঝাঁক ধরে যারা এসেছেন, তারাও ওখানেই গিয়েছেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘টরন্টোর একেবারে প্রাণকেন্দ্র সিএন টাওয়ারের পাশে আরেকটি কন্ডোমিনিয়াম আছে, সেটি অনেক বেশি বিলাসবহুল। সেখানেও অনেক বাংলাদেশি রয়েছে। অনেকের কনডো সেখানে আছে। কিনে রেখে চলে গেছে। কারোটা হয়তো খালিও পড়ে আছে। তবে এর পরে যারা এভাবে কানাডায় অভিবাসী হয়েছেন, তারা ছড়িয়ে পড়েছেন আরও বিভিন্ন জায়গায়। এদের পছন্দ ছিল এমন জায়গা, যেখানে সাধারণ বাংলাদেশিদের সঙ্গে তাদের মিশতে হবে না। এরা ছয়, সাত বা আট হাজার স্কয়ার ফিটের বড় বড় বাড়ি কিনেছে।’

রিয়েল এস্টেট এজেন্ট সাজ্জাদ আলীর ধারণা, যে কথিত অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে এখন প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, সেরকম খুবই বিত্তশালী বাংলাদেশীর সংখ্যা বৃহত্তর টরন্টো এলাকাতেই দু’শর কম হবে না।

কানাডায় সাধারণ মানুষের পক্ষে বাড়ি কেনা সেরকম কঠিন কোন কিছু নয়। পাঁচ শতাংশ ডিপেজিট দিয়েও বাড়ি কেনা সম্ভব যদি ভালো ক্রেডিট রেকর্ড এবং বাড়ির মর্টগেজ পরিশোধের সাধ্য থাকে।

‘কানাডায় অভিবাসী বাংলাদেশিদের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ হয়তো এখন বাড়ির মালিক। বাকী ৫০ ভাগও হয়তো আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তাদের পরিশ্রমের সঞ্চয় দিয়ে কত তাড়াতাড়ি একটা বাড়ি কিনতে পারেন। কিন্তু যে বাংলাদেশীদের কথা নিয়ে এত শোরগোল, তারা তো আর এই সাধারণ বাংলাদেশিদের কাতারে নন, এরা এমন সব জায়গায় বাড়ি কিনেছেন, যেখানে বাড়ির দাম অনেক বেশি এবং সেই দামে বাড়ি কেনার মতো আয়-উপার্জন তারা কানাডায় করছেন, সেটি আমরা দেখছি না।’

টরন্টো এবং নিকটবর্তী শহর রিচমন্ড হিল, মিসিসাগা এবং মার্কহামের অভিজাত এলাকায় বাংলাদেশীরা এরকম দামি বাড়ি কিনেছেন বলে জানান সাজ্জাদ আলী।

আরো পড়ুন:

>> লুটেরা ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কানাডায় সামাজিক আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা

>> কেউ ভাগ্যান্বেষণে, কেউ যাচ্ছেন লুট করে

>> অর্থপাচারের প্রতিবাদে কানাডায় আন্দোলনের ডাক বাংলাদেশীদের

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন