বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার

পুঁজিবাজারে ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সুযোগ পেল ব্যাংকগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য সম্মিলিতভাবে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের সুযোগ পেয়েছে দেশের ৫৯টি তফসিলি ব্যাংক। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ বিনিয়োগকে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সীমার আওতার বাইরে রাখা হবে। এ নিয়ে গতকালই একটি সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের জারি করা সার্কুলারে বলা হয়েছে, প্রতিটি তফসিলি ব্যাংক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠন করতে পারবে। দেশে বর্তমানে ৫৯টি তফসিলি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সে হিসাবে সবগুলো তফসিলি ব্যাংকের পুঁজিবাজারে বিদ্যমান বিনিয়োগের বাইরেও আরো সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা নতুন করে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

পুঁজিবাজারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তারল্য সংকট দূর করতে সরকারের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল চেয়েছিল বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার জারির বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, এর ফলে পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদে তারল্য সরবরাহ বাড়বে। তাছাড়া এতে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাও ফিরে আসবে।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, নিজস্ব উৎস বা ধারণকৃত ট্রেজারি বিল অথবা বন্ড রেপোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে সংগ্রহের মাধ্যমে এ বিশেষ তহবিল গঠন করা যাবে। এছাড়া নিজস্ব উৎস থেকে তহবিল গঠনের পর ট্রেজারি বিল বা বন্ড রেপোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ সংগ্রহ করেও এ বিশেষ তহবিল গঠন করা যাবে।

এ বিশেষ তহবিলে বিনিয়োগকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একক ও সমন্বিত দুই ধরনের হিসাবেই ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজার বিনিয়োগ সীমার আওতার বাইরে রাখা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত যেকোনো অংকের তহবিল সংগ্রহের সুযোগ রাখা হয়েছে একই বছরের ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত। এক্ষেত্রে রেপোর সুদহার হবে ৫ শতাংশ এবং কোনো অকশনের প্রয়োজন হবে না।

ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য থেকে ট্রেজারি বন্ড বা বিল রেপোর মাধ্যমে এ তারল্য সুবিধা নিতে হবে। সেক্ষেত্রে মার্জিন ধরা হবে ট্রেজারি বন্ড বা বিলের রেপো মূল্যের ৫ শতাংশ। নগদে রেপোর অর্থ পরিশোধে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষের দিন যদি সংশ্লিষ্ট সিকিউরিটিজের বাজারমূল্য আদায়যোগ্য অর্থের চেয়ে কম হয়, তাহলে তা মার্জিন থেকে সমন্বয় করা হবে। সমন্বয়ের জন্য যদি অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হয়, তাহলে ব্যাংক তা দিতে বাধ্য থাকবে।

সার্কুলারের তথ্য অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের চাহিদার ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ৯০ দিন মেয়াদি রেপো দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে ব্যবহারকৃত সিকিউরিটিজের মেয়াদ বা কুপন পেমেন্টের সময়সীমা ৯০ দিনের বেশি হতে হবে। এ রেপোর সময়সীমা ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে পুনঃনবায়ন করা যাবে।

তারল্য সুবিধা নিতে হলে ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করতে হবে এবং এক্ষেত্রে প্রচলিত আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলার মেনে চলতে হবে। নিজস্ব বিবেচনা ও সুবিধামতো এ তহবিলের অর্থ ব্যবহার করতে পারবে ব্যাংকগুলো। তবে তহবিলের ন্যূনতম ১০ শতাংশ অর্থ মেয়াদি বা বেমেয়াদি অথবা উভয় ধরনের মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করতে হবে। তাছাড়া এ তহবিলের ১০ শতাংশ অর্থ নিজস্ব পোর্টফোলিওর মাধ্যমে স্পেশাল পারপাস ফান্ড ও সম্পদভিত্তিক সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুসারে, তহবিলের অর্থের ৪০ শতাংশ ব্যাংকের নিজস্ব, ২০ শতাংশ অর্থ সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের, ৩০ শতাংশ অর্থ অন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজের এবং ১০ শতাংশ অর্থ অন্যান্য মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজের নিজস্ব নতুন পোর্টফোলিও গঠনের ঋণ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে ২০২৫-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট পোর্টফোলিওগুলোর বাজারভিত্তিক পুনর্মূল্যায়ন স্থগিত থাকবে। ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে বিনিয়োগের তথ্য আর্থিক বিবরণীতে প্রকাশ করতে হবে।

এক্ষেত্রে ব্যাংকের নিজস্ব পোর্টফোলিও গঠনের জন্য আলাদা বিও হিসাব খুলতে হবে। অন্যদিকে সাবসিডিয়ারি কোম্পানির নিজস্ব পোর্টফোলিও গঠনের ক্ষেত্রে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৭ শতাংশ, যার মেয়াদ ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এক্ষেত্রে আলাদা ব্যাংক ও বিও হিসাব থাকতে হবে। এছাড়া অন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি যেমন মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউজ এবং অন্যান্য মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজের নিজস্ব পোর্টফোলিও গঠনে ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৭ শতাংশ। এর মেয়াদও ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের করপোরেট গ্যারান্টি নিতে হবে। ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের আলাদা বিও হিসাব থাকতে হবে এবং এটি চলমান ঋণ হিসাবের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে। এ ঋণ হিসাব থেকে শুধু শেয়ার কেনাবেচা বাবদ অর্থ লেনদেন করা যাবে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে বিও হিসাবে থাকা সব সিকিউরিটিজ ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।

বিনিয়োগ নীতিমালা প্রসঙ্গে সার্কুলারে বলা হয়, বিশেষ তহবিলের অর্থ শুধু পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ক্রয়, তালিকাভুক্ত ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটিজ (সরকারি ট্রেজারি বন্ডসহ), অনুমোদিত স্পেশাল পারপাস ফান্ড, মেয়াদি ও বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা যাবে। ব্যাংক বা ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ডিলার লাইসেন্সধারী ব্রোকারেজ হাউজগুলো নিজ ব্যাংকের কোনো শেয়ার কিনতে পারবে না। অন্য তফসিলি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মোট ইস্যুকৃত শেয়ারের ২ শতাংশের বেশি কেনা যাবে না। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভিন্ন অন্য কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা ধরা হয়েছে মোট ইস্যুকৃত শেয়ারের ১০ শতাংশ।

ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি নয়, এমন মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউজগুলো কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট ইস্যুকৃত শেয়ারের ২ শতাংশের বেশি কিনতে পারবে না। মেয়াদি ও বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে এ সর্বোচ্চ ক্রয়সীমা যথাক্রমে ১০ ও ১৫ শতাংশ।

আগের তিন বছরে কমপক্ষে ১০ শতাংশ (স্টক বা নগদ বা উভয় প্রকার) লভ্যাংশ দিয়েছে এবং বাজারে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ফ্রি ফ্লোট শেয়ার এমন কোম্পানির শেয়ারে তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে। যেসব মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড ধারাবাহিকভাবে তিন বছরে কমপক্ষে ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে সেগুলোতেও বিনিয়োগ করা যাবে। বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে অভিহিত মূল্যের বেশি নিট অ্যাসেট ভ্যালু সংবলিত এবং তিন বছরে কমপক্ষে ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়া কোম্পানিতেও বিনিয়োগ করা যাবে। অন্যদিকে নতুন মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে যেগুলোর তালিকাভুক্ত ইকুইটি কমপক্ষে ৭০ শতাংশ এবং বাকিটুকু ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটিজ বা এফডিআর হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে, শুধু সেগুলোতেই বিনিয়োগ করা যাবে।

বন্ড বা ডিবেঞ্চারের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১০ শতাংশ কুপন বা সুদবাহী তালিকাভুক্ত করপোরেট বন্ড বা ডিবেঞ্চার এবং যেকোনো মেয়াদের এবং কুপনবাহী সরকারি বন্ড বা বিল হতে হবে।

এছাড়া স্পেশাল পারপাস ফান্ডের ক্ষেত্রে কোনো পাবলিক সেক্টর এনটিটির ইস্যু করা তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে মোট বিশেষ তহবিলের ১০ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে। তফসিলি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি রেটিং গ্রেড ১ থেকে ৩ এবং এসএমই রেটিং গ্রেড ১ থেকে ৩ মানসম্পন্ন সম্পদের বিপরীতে প্রথম মেয়াদে ৪০ শতাংশ, দ্বিতীয়বার ৩০ শতাংশ ও তৃতীয় মেয়াদে ২০ শতাংশ বিশেষ তহবিল থেকে বিনিয়োগ করতে পারবে।

এছাড়া বিএসইসি স্বীকৃত সম্পদের বিপরীতে কোনো একক বেসরকারি কোম্পানির ইস্যু করা সিকিউরিটিজে বিশেষ তহবিলের সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ বিনিয়োগ করা যাবে। সেক্ষেত্রে এর সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত। একই সঙ্গে প্রথম সাবস্ক্রিপশনের দিন থেকে এক বছরের মধ্যে তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদনের বিষয়েও কোম্পানির নিশ্চয়তা থাকতে হবে। তালিকাভুক্ত হতে না পারলে কোম্পানি সব সিকিউরিটিজ পুনঃক্রয়ে বাধ্য থাকবে। এজন্য আদালতে উপস্থাপনযোগ্য ত্রিপক্ষীয় লিখিত চুক্তিনামা থাকতে হবে এবং বিনিয়োগকৃত অর্থকে মেয়াদি ঋণ হিসেবে বিবেচনা করে সিআইবিতে প্রতিবেদন দিতে হবে।

সাবসিডিয়ারি কোম্পানি এবং অন্য মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউজকে দেয়া ঋণ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের এডিআর হিসাবের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত হবে না। এ ধরনের ঋণ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হবে। যদিও সিআইবিতে প্রতিবেদন দিতে হবে চলমান ঋণ হিসেবে বিবেচনা করে। ঋণের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বহন করতে হবে শতভাগ। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে একক গ্রাহক ঋণসীমাসহ সব ধরনের ঋণ নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।

তফসিলি ব্যাংকের একক গ্রাহক ঋণসীমা অনুযায়ী মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউজকে সার্কুলারের নির্দেশনার আওতায় ঋণ দেয়া যাবে। সেক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ ওই প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধনের ১০০ শতাংশের বেশি হবে না। অন্যদিকে কোনো মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউজ একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সেক্ষেত্রেও মোট পরিমাণ ওই প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধনের ১০০ শতাংশের বেশি হবে না। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার আগেই নিশ্চিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন