বায়োডিজেল তৈরি করছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া

এশিয়ায় পাম অয়েলের দামে অস্থিরতা, বাড়ছে দেশেও

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিভিন্ন খাদ্য ও প্রসাধনীতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে পাম অয়েল। আইসক্রিম, চকোলেট, টুথপেস্ট ও লিপস্টিকের অন্যতম উপাদান এটি। বায়োডিজেলের উপাদান হিসেবেও সামান্য পরিচিতি রয়েছে পাম অয়েলের। তবে সম্প্রতি বায়োডিজেল তৈরিতে পাম অয়েলের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে প্রধান দুই উত্পাদনকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। এতে বিশ্ববাজারে ক্রমেই বেড়ে চলেছে পণ্যটির দাম। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের ভোজ্যতেলের বাজারেও। পাম অয়েলের মূল্যবৃদ্ধিতে বাড়তির দিকে সয়াবিন তেলের দামও।

বায়োডিজেলের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্বেগের মধ্যেই জ্বালানিটি তৈরিতে পাম অয়েলের ব্যবহার বৃদ্ধিসংক্রান্ত নীতিমালা করেছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সরকার। প্রচলিত ডিজেলের সঙ্গে পাম থেকে তৈরি বায়োডিজেল মিশিয়ে ব্যবহারের বিষয়ে একটি নীতি ২০১৮ সালে অনুমোদন দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া, যার ফলে দেশটিতে এখন ডিজেলের সঙ্গে ২০-৩০ শতাংশ বায়োডিজেল মিশ্রিত জ্বালানি ব্যবহার বাধ্যতামূলক। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বি৩০ নামে জ্বালানির প্রচলন করেছে ইন্দোনেশিয়া, যাতে ৩০ শতাংশ বায়োডিজেল থাকছে। আর বছর শেষে ৫০ শতাংশ বায়োডিজেলযুক্ত বি৫০ জ্বালানি আনছে দেশটি। পাম অয়েলের ব্যবহার বাড়াতে বায়োডিজেলের বাধ্যতামূলক ব্যবহার প্রকল্প বাড়াতে যাচ্ছে দ্বিতীয় শীর্ষ উত্পাদক দেশ মালয়েশিয়াও। চলতি বছর থেকে পরিবহন জ্বালানিতে ২০ শতাংশ পাম অয়েলজাত উত্পাদিত বায়োডিজেল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে দেশটি, যা আগে ছিল ১০ শতাংশ। পাম অয়েলের শীর্ষ দুই উত্পাদন ও রফতানিকারক দেশে পণ্যটির উল্লেখযোগ্য অংশ এখন ব্যবহার হয় বায়োডিজেল উত্পাদনে।

বায়োডিজেলে ব্যবহার বৃদ্ধি পাম অয়েলের চাহিদায় নতুন মাত্রা যোগ করলেও সে অনুপাতে বাড়ছে না পণ্যটির উত্পাদন। উল্টো মাত্রাতিরিক্ত দাবদাহের কারণে শীর্ষ উত্পাদনকারী দেশগুলোয় পামের ফলন কমেছে। একই সঙ্গে বাড়ছে অপরিপক্ব পামের সংখ্যাও। ফলে পাম অয়েল উত্পাদন সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। এসব কারণে চলতি বছরের প্রথমদিকে অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন বিশ্লেষকরা।

উত্পাদিত পাম অয়েলের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রফতানি করে ইন্দোনেশিয়া। প্রধান আমদানিকারক আটটি দেশসহ অন্য কিছু দেশে পণ্যটি রফতানি করে ইন্দোনেশিয়া, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল এগ্রিকালচারাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্কের তথ্যমতে, বাংলাদেশে আমদানি করা পাম অয়েলের সিংহভাগই আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। ২০১৬-১৭ উত্পাদন বর্ষে আমদানি করা পাম অয়েলের ৭৮ শতাংশ সরবরাহ করছে ইন্দোনেশিয়া। এছাড়া বাকি ২২ শতাংশ পাম অয়েল আমদানি করা হয় মালয়েশিয়া থেকে।

বায়োডিজেলের কারণে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাজারে পাম অয়েলের চাহিদা বেড়ে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দামে।

ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য বলছে, বিশ্ববাজারে গত বছরের জুলাইয়ে প্রতি টন অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম ছিল ৫৪৩ দশমিক ৮৮ ডলার। পরের মাসে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮৬ দশমিক ১২ ডলার। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে প্রতি টন পাম অয়েলের দাম ছিল ৫৮০ দশমিক ৩০ ডলার, অক্টোবরে ৫৯১ দশমিক ৩৫ ও নভেম্বরে ছিল ৬৮৩ দশমিক ৩৮ ডলার। বছরের শেষ মাসে অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম টনপ্রতি বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬৯ দশমিক ৯৩ ডলারে। সে হিসাবে ছয় মাসের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম বেড়েছে ৪১ শতাংশের বেশি। এদিকে পাম অয়েলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দামও বাড়ছে। গত বছরের জুলাইয়ে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭৪৮ দশমিক ১৭ ডলার। এটি বছর শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২০ দশমিক ৫৯ ডলারে।

আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েক মাস ধরে সব ধরনের ভোজ্যতেলের বুকিং বৃদ্ধির প্রভাবে দেশে ভোজ্যতেলের বাজার দীর্ঘদিন ধরেই ঊর্ধ্বমুখী ছিল। সম্প্রতি ভোজ্যতেলের পাইকারি বাজারে দাম কিছুটা নিম্নমুখী হলেও এ প্রবণতা বেশিদিন স্থায়ী হবে না বলেই মনে করছেন তেল আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম বেড়েই চলেছে। বর্তমানেও দেশের বাজারের তুলনায় আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেশি।

ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিত্ সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে টানা বাড়ছে ভোজ্যতেলের দাম। সেই তুলনায় দেশীয় বাজারে দাম আন্তর্জাতিক বাজারের বুকিং দরের চেয়েও কম। কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে আগামীতে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ এরই মধ্যে বিশ্বের অন্যতম ভোজ্যতেল রফতানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল থেকে তৈরি বায়োডিজেল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবার করোনাভাইরাসসহ বিভিন্ন প্রভাবক যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক ভোগ্যপণ্যের বাজারে।

দেশের বৃহত্ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে পাইকারিতে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) সয়াবিন তেল ৩ হাজার ১০০ টাকা, পাম অয়েল ২ হাজার ৭৭০ এবং সুপার পাম অয়েল ২ হাজার ৯৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কয়েক মাস টানা দাম বাড়ার কারণে গত জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে বাজারে প্রতি মণ সয়াবিনের দাম ৩ হাজার ৪০০ টাকায় ঠেকেছিল। ওই সময় প্রতি মণ পাম অয়েলের দাম ছিল ৩ হাজার ২০০ টাকা ও সুপার পাম বিক্রি হতো ৩ হাজার ৩০০ টাকার মধ্যে।

খাতুনগঞ্জের মেসার্স আরএম স্টোরের স্বত্বাধিকারী শেখ সেলিম উদ্দিনসহ খাতুনগঞ্জের আরো কয়েকজন ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েক মাস ধরে সব ধরনের ভোজ্যতেলের বুকিং বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশীয় বাজারেও আমদানিনির্ভর পণ্যটির দাম ঊর্ধ্বমুখী ছিল। পাইকারি বাজারে তেলের এ ঊর্ধ্বমুখী দাম গত কয়েক বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ সময় লোকাল ট্রেডের কারণে বাজার অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। তবে দুই সপ্তাহ ধরে দেশীয় বাজারে পণ্যটির দাম কিছুটা নিম্নমুখী হয়েছে। কিন্তু এ নিম্নমুখী ভাব বেশিদিন থাকবে না। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম দিন দিন বাড়ছে। এমনকি দেশীয় বাজারের বর্তমান দামের চেয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের বুকিং দর এখনো বেশি বলে দাবি করেন এ ব্যবসায়ী।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন