বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য চায় ইউজিসি

সাইফ সুজন

আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এনে ২০১৭ সালে এক শিক্ষিকাকে চাকরিচ্যুত করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর নিজের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে মিথ্যা দাবি করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি লেখেন চাকরিচ্যুত ওই শিক্ষিকা। এতে তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন, কোনো ধরনের আর্থিক অনিয়ম নয়; বরং ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যানের (তত্কালীন) ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়েছেন তিনি। পরে ইউজিসির করা তদন্তেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতার কথা উঠে আসে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে ট্রাস্টি সদস্যদের আক্রোশের শিকার হয়ে পদ ছাড়তে হয়েছে খোদ উপাচার্যকে। একই ধরনের ঘটনা ঘটছে অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। ট্রাস্টি বোর্ড, উপাচার্য, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য না থাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে ইউজিসির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ক্ষমতার ভারসাম্য চায় ইউজিসি।

ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ট্রাস্টি বোর্ড, একাডেমিক কাউন্সিল, উপাচার্য ও সিন্ডিকেটের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের বিষয়ে বিশদভাবে উল্লেখ নেই। এ কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ট্রাস্টি বোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে থাকে। ফলে মেধাবী শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রায়ই অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বিওটি মেম্বার, ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারারের কাজের পরিধি উল্লেখ রয়েছে। যদিও বাস্তবে সেটি অনুসরণ করা হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ আসে, বিওটি সদস্যরা সব বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করতে আসেন। তারা দাতা নন; বরং নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক মনে করেন। তাই আমি বলব, বিওটি সদস্যরা যেন ভিসির সব কাজে নাক গলাতে না আসেন। কারণ সেটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। একজন উপাচার্যকে মুক্তভাবে কাজ করতে দিতে হবে। উপউপাচার্যকে তার কাজ করতে দিতে হবে। ট্রেজারারকে তার কাজ করতে দিতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠির আলোকে ২০১৮ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারিতা বিষয়ে তদন্ত করতে ইউজিসিকে চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগমের নেতৃত্বে তদন্ত শেষে গত বছর শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হবে জনকল্যাণকামী ব্যক্তি, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, দাতব্য ট্রাস্ট ও প্রতিষ্ঠান। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির মতো কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের মধ্যে এসব গুণাবলি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

সিটিং অ্যালাউন্স বিষয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিভিন্ন মিটিংয়ের সিটিং অ্যালাউন্স ও অন্যান্য ভাতাসংক্রান্ত ব্যয়ের সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দেয়া উচিত।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ক্ষমতার ভারসাম্য নেই উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়,  ‘এখানে ক্ষমতার ভারসাম্য নেই। কোনো বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে চাকরিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেয় অথবা চাকরিচ্যুত হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন উপাচার্য বলেন, নর্থ সাউথে জয়েন করেছিলাম রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে নিয়োগ পেয়ে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম, বিওটি সদস্যরা উপাচার্যকে টাকায় নিযুক্ত গোলাম মনে করে। অফিসের দৈনন্দিন কাজের সব বিষয়ে তারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। বিওটি সদস্যদের কোনো অনিয়ম নিয়ে বলতে গেলেই তাদের রোষানলে পড়তে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তাদের স্বেচ্ছাচারিতা চরমে।

বেসরকারি শান্তা-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মিজানুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ দেয়া হলেও বিওটি সদস্যদের বাধায় তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। একই ঘটনা ঘটে সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়েও। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ পেয়েও বেশিদিন সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য পদে থাকতে পারেননি অধ্যাপক ড. মফিজুল ইসলাম। দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যেই তাকে উপাচার্য পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বিভিন্ন পদ ও কমিটির ক্ষমতা বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই। নিয়ম না মেনে ভারপ্রাপ্ত উপচার্য, উপউপাচার্য ও ট্রেজারার দিয়ে কার্যক্রম চলছে বছরের পর বছর। সিন্ডিকেট, অর্থ কমিটি ও একাডেমিক কাউন্সিলের সভা না করেই চলছে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম। বছর শেষে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে নিয়মমাফিক করা হচ্ছে অডিট। এর ফলেই ক্ষমতার ভারসাম্য থাকছে না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এ প্রসঙ্গে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক ড. ফখরুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ক্ষমতার ভারসাম্য খুবই জরুরি। একজন শিক্ষক বা কর্মকর্তা স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান এগোতে পারে না। শিক্ষক ও উপাচার্যরা অনেক সময় কাজ করতে না পারার হতাশা প্রকাশ করেন। সবার পদমর্যাদা অনুযায়ী কাজ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার তো আইনেই দেয়া হয়েছে। সেটি ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক প্রভাবিত হওয়াটা দুঃখজনক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন