২ কোটি শব্দের কারিগর

আজিমভ যেভাবে ৫০০ বই লিখেছেন

জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আরিফ

পাঠকের কাছে আইজাক আজিমভের (১৯২০-১৯৯২) মতো বহুপ্রজ লেখক বা তার লেখাকে নতুন করে চেনানোর কিছু নেই। ১৯৫০ থেকে শুরু করে ১৯৯৬ পর্যন্ত তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এছাড়া তিনি কয়েকশ ছোটগল্প, ১ হাজার ৬০০টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং ৯০ হাজারের বেশি পত্র লিখেছেন। গণিত, জীববিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞান, রসায়ন, ইতিহাস, পুরাণ, আত্মজীবনী, শব্দতত্ত্ব, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, বাইবেল ইত্যাদি বিষয়ে তার একাধিক বই আছে। আজিমভের প্রকাশনার বিচিত্রতা যেমন পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তেমনি আকর্ষণ করে তার প্রকাশনার সংখ্যা। ১৯৫০ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত তার মোট প্রকাশনাকাল ধরলে দেখা যায়, গড়ে প্রতি চার সপ্তাহে তার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে এ বিপুল পরিমাণ লেখা কীভাবে সম্ভব হয়েছে? এর উত্তর খোদ আজিমভ দিয়েছেন তার বিভিন্ন সাক্ষাত্কারে আর আরো কিছু বিষয় জানা যায় আজিমভের স্ত্রী জ্যানেট সম্পাদিত It’s Been a Good Life (২০০২) গ্রন্থ থেকে। বইটিতে গ্রন্থিত হয়েছে আজিমভের ডায়েরি, ব্যক্তিগত চিঠি, এবং আত্মজীবনীমূলক তিনটি গ্রন্থের সারাংশ।
আজিমভ প্রতিদিন ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে নাশতার পর ঠিক ৮টার মধ্যে স্থানীয় ডাকঘরে গিয়ে চিঠিপত্র নিয়ে আসতেন। সকাল ১০টার মধ্যে সেগুলো পড়া শেষে নিজের লেখালেখি শুরু করতেন। বিকাল ৫টা পর্যন্ত প্রায় একটানা মিনিটে ৯০টি শব্দ টাইপ করে যেতেন। মাঝে মাঝে কফি বিরতি নিতেন এবং মধ্যাহ্নভোজে অল্প খেতেন। নৈশভোজের পর আবার শুরু করে রাত ১০টা পর্যন্ত লিখতেন। তার ছুটির দিনের রুটিনও এমনই ছিল, এমনকি ছুটি কাটাতে কোথাও গেলেও রুটিনের হেরফের হতো না।
শেখার শেষ নেই
আজিমভ নিছক নানা বিষয়ে লেখালেখি করা একজন লেখক নন। তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন, বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবরসায়ন বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষালাভ বা অধ্যাপনার সঙ্গে জড়িত থেকেও তিনি কখনো শেখা থেকে বিরত থাকেননি। তিনি বলতেন শুধু বিদ্যায়তনে অর্জিত জ্ঞান শেষ কথা নয় এবং তা দিয়ে এতসব বিচিত্র বিষয়ে লেখা সম্ভব নয়। তিনি সব কিছু পড়তেন। কোনো বিষয়ে ভুল বোঝার ভীতি তাকে তাড়িত করত, তাই ক্রমাগত জানতে চাইতেন। ভালো আইডিয়া আবিষ্কার করতে গেলে অন্যের আবিষ্কৃত ভালো আইডিয়া সম্পর্কে জানতে হবে। তাই ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ বাড়তে দিতে অনেক বিষয়ে পড়তেন এবং নিজের ভেতরে অনুসন্ধান অব্যাহত রাখতেন।
একসঙ্গে অনেক কিছু করা
আজিমভ এত বিপুল পরিমাণে লিখলেও বৈজ্ঞানিক কল্প-উপন্যাস লিখতে গিয়ে প্রায়ই এমনভাবে আটকে যেতেন যে তার মনে হতো আর একটি শব্দও লিখতে পারবেন না। কারণ প্রতি দফায় নতুন ভাবনা খুঁজে বের করা অসম্ভব কঠিন। তিনি বলতেন, লিখতে গেলে আটকে যাওয়াটা স্বাভাবিক। আটকে গেলে সাদা কাগজের দিকে তাকিয়ে না থেকে বা দেয়ালে মাথা না ঠুকে ওই উপন্যাসটা বাদ দিয়ে অন্য কিছু লিখতে হবে—একটা সম্পাদকীয় অথবা প্রবন্ধ কিংবা ছোটগল্প অথবা নন-ফিকশন। এসব করতে গিয়ে ক্লান্ত হলে মগজ আবার সৃষ্টিশীলভাবে চিন্তা করতে সক্ষম হয়ে যায়। তখন উপন্যাসে ফিরে গেলে অনায়াসে লেখা যায়। মানুষের মস্তিষ্ক এক বিচিত্র কায়দায় কাজ করে। একটা বিষয়কে ইচ্ছাকৃতভাবে সরিয়ে রেখে অন্য অনেক বিষয়ে মেতে থাকলে অবচেতনে ওই বিষয়ে আইডিয়া তৈরি হতে থাকে।
‘প্রতিরোধ’ নিয়ে সতর্কতা
যেকোনো সৃষ্টিশীল মানুষ, তা তিনি উদ্যোক্তা হন বা লেখক বা শিল্পী, সবসময় নিজের আইডিয়াটিকে মূর্ত করে তোলার ব্যাপারে আশঙ্কায় থাকেন। যখনই একটা বিষয় মূর্ত হয়ে যায়, তখনই সেটা লক্ষজনের প্রত্যাখ্যান অথবা সমালোচনার মুখোমুখি হয়। আজিমভ পর্যন্ত একটা লেখা প্রকাশিত হলে সব ধরনের মন্তব্য আর ই-মেইল থেকে দূরে থাকতেন। সমালোচনার আতঙ্ক সৃষ্টিশীল মানুষের বড় শত্রু। মার্কিন লেখক স্টিভেন প্রেসফিল্ড এ আতঙ্ককে বলেছেন ‘প্রতিরোধ’। আজিমভ প্রতিরোধের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। তিনি বলতেন, একজন সাধারণ লেখক এ ভাবনায় জর্জরিত হন যে লিখিত বাক্যটি যথেষ্ট বিচক্ষণ কিছু হলো কিনা। তার অর্থ স্পষ্ট হলো কিনা। অন্যভাবে লিখলে তা আরো সুন্দরভাবে ফুটে উঠত কিনা। এ কারণে তারা ক্রমাগত লেখা সংশোধন করে যান, বদলান, নিজের ভাবনাকে ভিন্ন ভিন্নভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। ফলে তারা কখনই নিজের লেখা নিয়ে পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট হতে পারেন না। এভাবে তারা কখনো বহুপ্রজ লেখক হতে পারবেন না। আত্মসন্দেহ একজন লেখকের চিন্তা ধ্বংস করে। প্রত্যাখ্যানের ভয় আমাদেরকে শুদ্ধতার প্রতিরূপে পরিণত করে, যা কঠিন সময়ে আশ্রয় নেয়ার একটা খোলস মাত্র। এটা মিথ্যার নিরাপত্তা দেয়। অথচ সত্য হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভাবনা আছে। সৃষ্টিশীলতার ক্ষুদ্র বীজ মনের জানালা দিয়ে ভেতরে ভেসে আসে। একটা ভাবনাকে সুযোগ দেয়ার আগেই বাতিল করতে হয় না। যদি ভাবনাই না থাকে, তাহলে ব্যর্থ হওয়ারও কোনো ব্যাপার থাকে না।
নিজের লেখাকে উপভোগ করা
আজিমভ পূর্ণ শুদ্ধতার চরম বিরোধী ছিলেন। তিনি বলতেন, প্রথমেই সবকিছু ঠিকঠাক পেতে চাওয়া ভুল। প্রথমে মূল বিষয়গুলো ঠিক করে ফেলতে হয়। একজন চিত্রকর যা আঁকতে চান, প্রথমে তা মনে মনে পরিষ্কার ঠিক করে নেন। রঙের সারি, রঙ আর রেখার ভারসাম্য আর যা কিছু, সবই তার কাছে পরিষ্কার। এইটুকু ঠিক হয়ে গেলে তিনি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে ভাবেন। প্রথম দফাতেই তিনি ‘মোনালিসা’ এঁকে ফেলার চেষ্টা করেন না। এ কারণে প্রথমে নিজের অবস্থান নামিয়ে একটা পরীক্ষামূলক কিছু বানাতে হয়। আজিমভ আত্মবিশ্বাসের ওপর জোর দিতেন। তিনি বলতেন, ‘একজন লেখক তার লেখার মান নিয়ে সন্দেহ পোষণ না করে বরং নিজের লেখাকে ভালোবাসবেন। বহুপ্রজ লেখকরা নিজের লেখার মান নিয়ে সন্দেহে ভোগেন না। তারা নিজেদের লেখা উপভোগ করেন। আমি আমার যেকোনো একটি বই তুলে নিয়ে যেকোনো দিক থেকে পড়া শুরু করলে তার গভীরে হারিয়ে যাই যতক্ষণ পর্যন্ত না বাইরের কোনো কিছু আমার মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। আমি যদি আমার লেখাই উপভোগ না করি, তাহলে এর পক্ষে দাঁড়াব কী করে? সৃষ্টিতে বিশ্বাস করুন।’ আজিমভের কথায়, প্রতি চেষ্টায় দুনিয়ার সেরা লেখাটা লিখতে হবে না। প্রকৃত আত্মবিশ্বাস হচ্ছে সীমাবদ্ধতার মাত্রাকে দূরে ঠেলা, শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হওয়া এবং ঘুরে দাঁড়ানোর সামর্থ্য অর্জন করা। ব্যর্থতার পরে সংগ্রাম করলে সাফল্য লাভ করা যায়।
বেশি বেশি লেখা
আজিমভ বলতেন, যেকোনো সময় লেখা শুরু করার সক্ষমতা অর্জন করাটা গুরুত্বপূর্ণ। হাতে ১৫ মিনিট সময় থাকলে সেটাও এক পৃষ্ঠা লেখার জন্য যথেষ্ট। সুতরাং নিরবচ্ছিন্ন লম্বা সময়ের আশায় বসে না থেকে লেখা শুরু করে দিন। লেখার সাবলীল প্রবাহে বা গভীর চিন্তায় ডোবার জন্য দরকার লেখা শুরু করে দেয়া। তিনি কোনো লেখা শুরু করার আগে বিশেষ কোনো চিন্তা-কাঠামোয় প্রবেশের জন্য অপেক্ষা না করে ইলেকট্রিক টাইপরাইটারের সুইচ অন করে লিখতে বসে পড়তেন। যখন তিনি লিখতেন না তখন লেখা নিয়ে ভাবতেন। খাওয়া-দাওয়া, নিত্যক্রিয়াদির মধ্যে কখনো কোনো সংলাপ, কখনো একটা অনুচ্ছেদ নিয়ে তার ভাবনা খেলা করত। ফলে তিনি দ্রুত নতুন লেখা শুরু করতে বা অবিরত লিখে যেতে পারতেন। তিনি বলতেন, যতক্ষণে একজন লেখকের একটা বই প্রকাশিত হতে থাকে, ততক্ষণে পাঠকেরা এটা কীভাবে নেবেন বা এর বিক্রি কেমন হবে—এসব আর তার চিন্তায় থাকে না। কারণ ততক্ষণে তার আরো অনেক বই বিক্রি হচ্ছে এবং তিনি আরো অনেকগুলো বই লিখতে ব্যস্ত থাকেন, যা তার জীবনের শান্তি আর স্থৈর্যকে বাড়িয়ে তোলে। প্রতি সপ্তাহে বাজারে কারো নতুন প্রকাশনা আসতে থাকলে তার আগেরগুলোর ব্যর্থতা নিয়ে সময় নষ্ট করার উপায় থাকে না। এ কারণে তিনি একটা নিখুঁত রচনায় মনঃসংযোগ করার চেয়ে সপ্তাহভরে অনেকগুলো রচনা লেখার পক্ষপাতী ছিলেন। ফলে কোনো একটা ব্যর্থ হলেও সেটা কম বেদনার কারণ হয়। বৈচিত্র্য হচ্ছে মনের বীমা।
গোপন টিপস
এক লেখক বন্ধু আজিমভকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি লেখার আইডিয়াগুলো কোথা থেকে পাও? উত্তরে তিনি বলেন, ‘অবিরাম চিন্তা করতে করতে। যতক্ষণ না আমি নিজেকে মেরে ফেলতে প্রস্তুত হই, ততক্ষণ পর্যন্ত চিন্তা করতে থাকি। তুমি কি ভেবেছ আইডিয়া পাওয়া খুব সোজা ব্যাপার? বহু রাত আমাকে একা একা ভেবে কাটাতে হয়েছে। গতকাল সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি, ফলে একটা বিষয়ে লেখার জন্য সারা রাত আমি ভেবেছি, এর দুঃখজনক অংশগুলোয় আমি চিত্কার করেছি। আমার মনে হয় গতকাল আমি একটা চমত্কার রাত কাটিয়েছি। কেউ কখনো বলবে না যে আইডিয়া পাওয়া খুব সহজ ব্যাপার। যে আইডিয়া খুব সহজে মেলে, সেটা নিয়ে কাজ করার কিছু নেই।’

জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আরিফ: লেখক ও প্রকৌশলী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন