বিল ময়ার্সের মুখোমুখি আইজাক আজিমভ

‘ফিউচারিজম আজ ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি রাজনীতি, সমরবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ অংশ’

মার্কিন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিল ময়ার্স আইজাক আজিমভের এ সাক্ষাত্কারটি নিয়েছিলেন ১৯৮৮ সালে, আমেরিকার পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস বা পিবিএসের জন্য নির্মিত ‘আ ওয়ার্ল্ড অব আইডিয়াস’ শীর্ষক আলাপচারিতাভিত্তিক সিরিজ অনুষ্ঠানের একটি পর্বে। এ সাক্ষাত্কারের প্রায় পুরো সময়ে আজিমভ ফিউচারিজম, বিজ্ঞানের নৈতিকতা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর গুরুত্ব, ভবিষ্যতের পৃথিবীর সংকট, জনসংখ্যার বিড়ম্বনাসহ নানা বিষয় নিয়ে ময়ার্সের যুগপৎ তীক্ষ ও লাগসই সব প্রশ্নের সবিস্তার-সরস জবাব দিয়েছিলেন। বিল ময়ার্সের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে সাক্ষাত্কারটির শ্রুতলিপি পাওয়া গেছে। এখানে সাক্ষাত্কারটির চৌম্বক অংশের অনুবাদ উপস্থাপিত হলো। অনুবাদ করেছেন দিগন্ত চৌধুরী

বিল ময়ার্স:
আচ্ছা, বিজ্ঞানের মধ্যে কি কোনো নৈতিকতা আছে?

আইজাক আজিমভ: অবশ্যই। বিজ্ঞানের মধ্যে অন্য কোনো কিছুর তুলনায় অধিকতর উন্নত এক নৈতিকতার দেখা মেলে। আপনি যদি বিজ্ঞানজগতে এমন কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পান—এবং এমনটা ঘটেই থাকে, বিজ্ঞানীরাও শুধুই মানুষ—যে কিনা তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল নিয়ে জালিয়াতি করেছে, নিজের গবেষণার ফলাফল নিয়ে মিথ্যা বলেছে,  যে অন্যের কাজ চুরি করার চেষ্টা করেছে, যে কিনা এমন কিছু করেছে, যা বিজ্ঞানীদের কাছে অনৈতিক বলে বিবেচিত হয়, তাহলে বিজ্ঞানজগতে ওই ব্যক্তির সুনাম নষ্ট হবে, তার বৈজ্ঞানিক জীবন শেষ হয়ে যাবে। এখানে ক্ষমার কোনো জায়গা নেই।

ময়ার্স:  নৈতিকতাটা এখানে আসলে কী?

আজিমভ: এখানে নৈতিকতাটা হলো, আপনি সত্যকে তুলে ধরবেন এবং আপনি নিজের আবিষ্কারকে খণ্ডন করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। আপনি অন্যের আবিষ্কারকে ব্যবহারের চেষ্টা করবেন না এবং সেগুলো নিজের বলে চালানোর চেষ্টা করবেন না। মানবজাতির চর্চার অন্য সব শাখায়—রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন-চর্চা—প্রায় সব ক্ষেত্রেই লোকজন অপরাধ করেও নায়ক হিসেবে গণ্য হতে পারে। যেমন আমার মনে হয় কর্নেল নর্থ (ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মার্কিন সমর-কর্মকর্তা) খুব ভয়ংকর সব কাজ করেছেন। তবুও তিনি কিছু লোকের কাছে বীর ও দেশপ্রেমিক বলে বিবেচিত হন। এমনটা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই হয়। শুধু বিজ্ঞান এর ব্যতিক্রম। আপনি বিজ্ঞানের বেলায় একটি ভুল পদক্ষেপ নেবেন, তো আপনি ব্যর্থ হবেন, নির্ঘাত হবেনই।

ময়ার্স: আপনি বিজ্ঞান ভালোবাসেন, তাই না?

আজিমভ:
আহা, আমি বিজ্ঞান খুব খুব পছন্দ করি। আমি ভেবে বিস্মিত হই, বিজ্ঞানীদের মধ্যে কতজন সন্তই না রয়েছেন। আমি আপনাকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯০০ সালে ওলন্দাজ উদ্ভিদবিজ্ঞানী হুগো দ্য ভ্রিস জিন মিউটেশন নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি নানা ধরনের ইভেনিং প্রিমরোজ ফুল আছে, এমন একটি জমি খুঁজে পেয়েছিলেন এবং কীভাবে ফুলগুলো নিজেদের বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়ে থাকে, তা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। সঙ্গে তিনি জিনবিদ্যার সূত্রগুলো নির্ণয়ের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আরো দুজন ব্যক্তি জিনবিদ্যার সূত্রগুলো নির্ণয়ের চেষ্টা করছিলেন। তাদের একজন কার্ল করেন্স, যিনি ছিলেন জার্মান—দ্য ভ্রিস ছিলেন ওলন্দাজ—আর তৃতীয়জন এরিক ভন চেমার্ক ছিলেন অস্ট্রিয়ান। ১৯০০-এর দিকে তিনজন একসঙ্গে জিনবিদ্যার সূত্র নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আগের গবেষণাগুলো যাচাই করছিলেন, নিছক আগে কী কী ধরনের কাজ হয়েছিল, তা দেখার জন্য। তিনজনই আবিষ্কার করলেন, সেই ১৮৬৭ সালেই গ্রেগর মেন্ডেল জিনবিদ্যার সূত্র নিয়ে কাজ করেছিলেন এবং লোকজন তখন সেটার দিকে কোনো রকমের মনোযোগ দেয়নি। এই ত্রিমূর্তি তখন জানালেন, তাদের আবিষ্কার আদতে মেন্ডেলের অনুসন্ধানে বের হওয়া সূত্রগুলোকেই সত্য বলে প্রমাণ করেছে। মেন্ডেলের কাজ সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর তিনজনের একজনও ওই আবিষ্কারকে নিজের মৌলিক কীর্তি বলে চালাতে যাননি। এবং এটা হচ্ছে সেই ধরনের ঘটনা, যা কিনা আপনি বিজ্ঞানের বাইরে খুঁজেই পাবেন না।

ময়ার্স:
সত্যকে তুলে ধরা... এটা সেই সত্য, যা কিনা আপনাকে উদ্দীপিত করে। তাহলে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর কী দরকার, যার জন্য অত্যন্ত সংগতভাবেই আপনি মহাবিশ্বজুড়ে পরিচিত?

আজিমভ: ঠিক আছে, তাহলে সাহিত্যের দিকে সামগ্রিকভাবেই চোখ ফেরানো যাক। কথাসাহিত্য, যেকোনো ধরনের কথাসাহিত্য। আমি মনে করি সিরিয়াস কথাসাহিত্যে, যেখানে লেখক মনে করেন পাঠককে নিছক আমোদ দেয়া ছাড়াও অন্য কিছু তিনি তুলে আনছেন—পাঠকদের নিছক আমোদ দেয়ার মধ্যে কোনো দোষ নেই যদিও—তাও যদি লেখক ভাবেন যে তিনি আমোদ প্রদানের বাইরে গিয়ে বেশি কিছু করতে চাইছেন, তাহলে তিনি যে কাজটা করছেন, তা হলো মানব জাতির সামনে একটা আয়না তুলে ধরা। একটা উপন্যাস বা গল্প পড়ার কারণে আপনার জন্য মানুষজনকে আরো ভালোভাবে বোঝাটা সম্ভব হয়ে উঠছে। কিংবা নিজের সত্তাকে আরো গভীরভাবে বোঝাটা সম্ভবপর হচ্ছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার।

তো, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এ কাজটা করার জন্য একটা ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে। সাই-ফাই ঘরানার ফিকশন একটা কৃত্রিম সমাজ তৈরি করে, যার এখন কোনো অস্তিত্ব নেই, ভবিষ্যতে থাকলেও থাকতে পারে, তবে মোটেও নিশ্চিত নয়। ওই সমাজের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে ঘটনাগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়। এটা যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনি আকর্ষণীয়ও। তবে আমি আশা করি, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মানুষকে ও নিজেকে পর্যবেক্ষণের একটা নতুন পথ করে দেবে, যেখানে আপনি নিজেকে ওই রহস্যময় সমাজের প্রেক্ষাপটে ফেলে নতুন নতুন রূপে দেখার সুযোগ পাবেন, বর্তমান সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে রেখে যা দেখার সুযোগ সম্ভবত নেই।

আমি এই কাজে সফল হয়েছি, এমন দাবি করব না। আমার কী মনে হয় জানেন, এই কাজটা সঠিকভাবে করার জন্য একজন মহান মানুষের দরকার হয়। ওই পর্যায়ে যেতে গেলে কাউকে অন্তত শেক্সপিয়ারের আধখানার সমান হতে হয়। আমি ওই জায়গায় পৌঁছাইনি। তবে চেষ্টা করছি এবং কে-ই বা জানে, হয়তো কোনো মুহূর্তে আমি একটুখানি সফলও হয়েছিলাম। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ফিকশন রচনার একটা অন্য রকম স্টাইল আর এখানে আমি এমন সব বিষয় নিয়ে আসতে পারি, যা কিনা অন্য ঘরানায় আনা সম্ভব হতো না; ঠিক এসব কারণেই আমি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লিখি।

ময়ার্স:
কে যেন বলেছিলেন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বড় একটা সুফল হলো পাঠকদের সামনে পরিবর্তনের ধারণাকে তুলে ধরা। যেসব পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু পাঠকের কাছে তা অনুমেয় হয়ে ওঠে না।

আজিমভ: দেখুন, এ কথা আমি নানা সময়ে বলে এসেছি। প্রকৃতপক্ষে সমাজ সবসময়ই পরিবর্তিত হচ্ছে। তবে পরিবর্তনের পরিমাণ ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। এবং সেটা বিভিন্ন কারণে। পরিবর্তন হলো ক্রমবর্ধিষ্ণু। যে পরিবর্তনগুলো আপনি ঘটান, তা এর পরের পরিবর্তনগুলোর আগমন আরো সহজ করে তোলে। শিল্প বিপ্লবের আবির্ভাব ঘটার পর পরিবর্তনের হার এত দ্রুত বাড়তে থাকল যে ওই প্রথমবারের মতো কোনো মানুষের জীবদ্দশাতেই অসংখ্য পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। এতে মানুষ হঠাৎ করেই বুঝতে পারল, বস্তুজগৎ শুধু এখন পাল্টাচ্ছে এমনটি নয়, তাদের মৃত্যুর পরও তা পাল্টাতে থাকবে। তখনই রূপকথা আর অ্যাডভেঞ্চার গল্পের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী অবয়ব পেতে শুরু করল। কারণ মানুষ তখন জেনে গিয়েছিল যে সামনের শতাব্দীতে যা হবে, সেই পরিবর্তনগুলো দেখার আগেই সম্ভবত তারা মারা যাবে। কাজেই কী হতে পারে, তা কল্পনা করাটাই উত্তম।

তাই আজ ফিউচারিজম ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমরবিদ্যার চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। যেকোনো দিক থেকেই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটা লোকজনের ‘সবকিছুই অনড়’ গোছের সহজাত ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই ছুড়ে দেয়।

ময়ার্স: আচ্ছা, আপনার কল্পনাকে ব্যবহার করে বলুন তো, যা আপনি প্রায়ই করে থাকেন, আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট যদি আপনাকে তার প্রারম্ভিক ভাষণের খসড়া করতে দিয়ে বলেন, ‘‘মিস্টার আজিমভ, এমন একটা প্রসঙ্গ এখানে তুলে আনবেন, যার দিকে আমেরিকার জনগণকে ‘অবশ্যই মনোযোগ দিতে হবে’ এমনটা আমার তাদের বুঝিয়ে দেয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন।” তাহলে সেটা কী হবে?

আজিমভ:
আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি এখন হচ্ছি, তার সবগুলোই বৈশ্বিক সমস্যা এবং বাঁচা-মরার প্রশ্নে সত্যিকার অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো আমাদের সবার ওপরেই প্রভাব ফেলবে। যদি বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর উধাও হয়ে যায়, আমরাও হাওয়া হয়ে যাব। সমুদ্রে, আকাশে-বাতাসে, ভূগর্ভস্থ জলরাশিতে যেখানেই দূষণ ঘটছে, সব আমাদের জন্যই হচ্ছে। একমাত্র বৈশ্বিক সমাধানের মারফতই আমরা এ সমস্যাগুলোকে কমিয়ে আনা, সমাধান করা বা ঠেকিয়ে দিতে পারি। আমেরিকা একা যেসব উদ্যোগ নেবে, তা বিশ্বজুড়ে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলতে পারবে—আমরা এমনটা আশা করতে পারি না। এজন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রের জোট বাঁধা দরকার।

ময়ার্স: পৃথিবী এখন ঠিক কতজন লোকের ভার বহন করতে সক্ষম বলে আপনি মনে করেন?

আজিমভ: আমি মনে করি না পৃথিবী পাঁচ বিলিয়ন লোকের ভার বহন করে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারবে। এজন্য আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ ভীষণ সংকটপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে। এবং আমরা সম্ভবত সবার অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারবও না। পুরো পৃথিবীর জীবনযাত্রার মান আমেরিকার জীবনযাত্রার গড় মানের সমান করে তোলা যাবে না। কারণ আমি মনে করি না যে এর জন্য পর্যাপ্ত রসদ ও সমপরিমাণ বণ্টনের ক্ষমতা আমাদের আছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ অংশই চরম অনাহারে ভুগছে এবং জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন