শতবর্ষে আইজাক আজিমভ

যুক্তি আর আশাবাদে ভবিষ্যতের সমীকরণ

কাজী মাহবুব হাসান

আসিমভ নয়, আজিমভ। আজিমভ পরিবার ১৯২৩ সালে যখন সোভিয়েত রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিল, তাদের পদবি ইংরেজি হরফে লিখতে গিয়ে আইজাকের পিতা জুডা আজিমভ ‘এস’ ব্যবহার করেছিলেন এই বিশ্বাসে যে এই ‘এস’-এর উচ্চারণ জার্মান ‘এস’ অর্থাৎ ‘জি’-এর মতোই হবে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর স্বর্ণযুগের ‘বিগ থ্রি’ লেখকদের একজন আইজাক আজিমভ তার কাহিনীতে বৈজ্ঞানিক তথ্যের নির্ভুলতা আর যুক্তিকে (‘হার্ড’ সায়েন্স ফিকশন) মূলত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। প্রথম স্ত্রী গারট্রুড একবার আজিমভকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘জীবনের শেষে কী বলবে, যদি তুমি ১০০ বই লেখো আর জীবনকে উপভোগ করতেই ব্যর্থ হও?’ ‘শুধু ১০০টি?’—তিনি উত্তর দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘ওপাস ১০০’—তার শততম বইটিতে তিনি এ ঘটনার কথা লিখেছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি পাঁচ শতাধিক বই লিখেছিলেন অথবা সম্পাদনা করেছিলেন।
প্রায় ২ কোটি প্রকাশিত শব্দে অশ্রান্ত কৌতূহলী এ রসায়নবিদ ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর কিংবদন্তি লেখক মানবতার সাধারণ কল্যাণের জন্য যুক্তিবাদের সমর্থন করেছিলেন। বিজ্ঞান ও সৃজনশীল শিল্পকলার অভিনব মিশ্রণে তিনি আশাবাদী কল্পনার অসংখ্য জানালা উন্মুক্ত করে অনাগত ভবিষ্যতের একটি রূপরেখা আমাদের মনে এঁকে দিয়েছিলেন। আজিমভের সব কাহিনীর ভিত্তিতে ছিল একটি পূর্বধারণা, মানবতা এর সমস্যাগুলো ঠাণ্ডা মাথায় যুক্তির সঙ্গে সমাধান করবে। তবে তার অন্য গদ্যে তিনি প্রায়ই মানব চরিত্রে বিশৃঙ্খল বাস্তবতাগুলো সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই যে তিনি আসলেই কতজনের মন পরিবর্তন করতে পেরেছিলেন, কিন্তু কঠিন বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো সংযোগের ক্ষেত্রে সাধারণ ভাষার ব্যবহারে এখনো কেউ তার সমকক্ষ হতে পারেননি।
বিস্ময়কর সাবলীলতায় তার লেখা কিংবা সম্পাদিত পাঁচ শতাধিক বই, অসংখ্য গল্প, প্রবন্ধ কৌতূহলের প্রায় সব বিষয়কে স্পর্শ করেছিল। ১৯৭৮ সালে ‘আর্ট অ্যান্ড সায়েন্স’ শিরোনামে একটি অসাধারণ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘শিল্পীর কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদি জ্ঞানের ঘাটতি থাকে আর বিজ্ঞানীর কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদি স্বজ্ঞার সেই দীর্ঘ ঝাঁপ দেয়ার সুযোগটি উপেক্ষা করা হয়; প্রায়ই যা যুক্তির ভারী স্বাভাবিক পদক্ষেপকে অতিক্রম করে যায়।’ আজিমভ মনে করতেন, উদ্ভাবনকুশলতার লালন ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রাপ্ত অন্তর্জ্ঞান অর্জন, শিক্ষা ও সংযোগ হচ্ছে একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা এবং মানব প্রগতির জন্য যা অপরিহার্য। এ মূল্যবোধকে তিনি সমর্থন করে গিয়েছেন তার প্রকাশিত প্রতিটি শব্দে।
সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেট্রোভিচিতে ১৯২০ সালে জন্ম নেয়া আজিমভের বয়স যখন তিন, তখন তার পরিবার এলিস দ্বীপে পা রেখেছিল এবং নিউইয়র্কে বেঁচে থাকার দীর্ঘ সংগ্রামটি সূচনা করেছিল (তার জন্ম ২ ফেব্রুয়ারি ১৯২০, মূলত পারিবারিকভাবেই ঠিক করা হয়েছিল)। পরিবারটি ব্রুকলিনে স্থায়ী হয়েছিল। তিন বছর পরে তার বাবা পারিবারিক একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করার মতো যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ সঞ্চিত করতে পেরেছিলে। আজিমভের বাবা ক্যান্ডি বানানোর দোকান খোলেন, এছাড়া তিনি সংবাদপত্র আর ম্যাগাজিনও বিক্রি করতেন। এ ব্যবসায় পরিবারের সব সদস্যই অংশগ্রহণ করেছিলেন। হয়তো বিস্ময়কর নয় যে আইজাক ম্যাগাজিনের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করতেন, বিশেষ করে বর্ণিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর প্রকাশনাগুলোর প্রতি। ছোট আইজাক দিনের দীর্ঘ সময় কাটাতেন খবরের কাগজ বিলি করে, ভারী বাক্স আর ম্যাগাজিন টেনে এবং অবশ্যই গোগ্রাসে বই পড়ে। রাস্তার নানা সাইনবোর্ড দেখে পাঁচ বছর বয়স নাগাদ তিনি নিজেই পড়তে শিখেছিলেন, ছয় বছর বয়সে ব্রুকলিন পাবলিক লাইব্রেরি থেকে তিনি তার প্রথম লাইব্রেরি কার্ড পান, পরে তিনি আরো একটি লাইব্রেরি কার্ড জোগাড় করেছিলেন পাশের কুইন্স এলাকার লাইব্রেরি থেকে, যা তার সাপ্তাহিক বই নেয়ার পরিমাণ দ্বিগুণ করেছিল। কৈশোরে তিনি প্রতিবেশীদের আতঙ্কে ফেলে দিতেন, যখন অন্ধের মতো বইয়ের মধ্যে নাক গুঁজে ও আরেকটি বই বগলের নিচে রেখে ব্যস্ত রাস্তা ধরে হাঁটতেন।
নয় বছর বয়সে তিনি কল্পবিজ্ঞানের বইগুলো পড়তে শুরু করেছিলেন। ঠিক সে সময়টাতে এ বিশেষ জনরার বইগুলো লাগামছাড়া অসংযত কল্পনা পরিত্যাগ করে ক্রমেই বিজ্ঞানমুখী যুগের উপযোগী হয়ে উঠছিল। তিনি তার বাবাকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন যে হুগো গার্নজবাকের ম্যাগাজিন সায়েন্স ওয়ান্ডার স্টোরিজে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আলোচনা আছে, যদিও এর প্রচ্ছদ নভোযান আর ভিনগ্রহবাসীদের বহুবিচিত্র ছবি দিয়ে পূর্ণ থাকত। নিয়মিতভাবে পারিবারিক দোকানের স্টোর রুমে আত্মগোপন করতেন বইয়ের জগতে নিজেকে নিমজ্জিত করতে। এভাবেই আবদ্ধ, বৈদ্যুতিক-আলোয় আলোকিত পরিসরে সম্ভাবনার উন্মুক্ত সীমানাগুলো অনুসন্ধানে আজিমভের জীবনব্যাপী অভ্যাসটির সূচনা হয়েছিল। আজিমভের জীবনের এ ব্যাপারটি সেই সময়-পরিভ্রমণ করা অ্যান্ড্রিউ হারলানের চেয়ে খুব একটা ভিন্ন নয় (১৯৫৫ সালে প্রকাশিত তার উপন্যাস দি এন্ড অব এটারনিটির একটি চরিত্র) যিনি, বহু সহস্র শতাব্দী পাড়ি দিয়েছিলেন গুনগুন করে শব্দ করা একটি কেটলিতে চড়ে।
অসাধারণ প্রতিভাবান আজিমভ ১৫ বছর বয়সেই হাইস্কুল শেষ করেছিলেন। আইজাকের স্মরণশক্তি ছিল বিস্ময়কর। হাইস্কুলের গণ্ডি পার হতে তাকে তেমন কোনো কষ্টই করতে হয়নি। তার আত্মজীবনীর প্রথমটিতে (তিনি আরো দুটি খণ্ড প্রকাশ করেছিলেন পরে, তারপর আরো দুটি বাড়তি সংকলন) বর্ণনা করেছিলেন তিনি সেমিস্টারের জন্য তার পাঠ্যপুস্তকগুলো পাওয়ার পর বাসায় হেঁটে আসার পথেই সেগুলো পড়ে ফেলতেন, আর তাকে সেই বই খুলতে হতো না। তবে তাকে ম্যানহাটনের কলাম্বিয়া কলেজ প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং ব্রুকলিনের সেথ লো জুনিয়র কলেজে তাকে ভর্তি হতে হয়েছিল। এখানে ইহুদিবিদ্বেষ কাজ করেছিল। দমে না গিয়ে তিনি তার পড়াশোনা চালিয়ে যান, পরে অবশ্য ১৯৩৯ সালে স্নাতক হয়েছিলেন কলাম্বিয়া থেকে (কারণ সেথ লো কলেজটি বন্ধ হয়ে যায়)। তার অধ্যয়নের প্রধান বিষয় ছিল রসায়ন, কারণ প্রথম বর্ষে প্রাণিবিজ্ঞান নেয়ার পর জেনেছিলেন সেখানে তাকে বিড়াল ব্যবচ্ছেদ করতে হবে।
এরই মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের সাহিত্য হিসেবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নিয়ে একটি স্বাতন্ত্র্যসূচক দৃষ্টিভঙ্গি তার মনের ভেতর গড়ে উঠেছিল। ১৯৩৮ সালে তিনি একটি উল্লেখযোগ্য ‘সাই-ফাই’ ফ্যান ক্লাবের সদস্য হয়েছিলেন—দ্য ফিউচারিয়ানস; সঙ্গে ছিল ফ্রেডেরিখ পল, সিরিল কর্নব্লুথ ও ডোনাল্ড ভোলহাইম। এ গ্রুপটি ছিল প্রগতিশীল ও রাজনৈতিক, যারা দুটি বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী পর্যায়ে বর্বরতা আর সামরিক আদর্শের উত্থানের বিরোধিতা করেছিল।
আজিমভের নক্ষত্রটি বিস্ময়কর উত্থান শুরু হয়েছিল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী থাকাকালীন। ১৯৩৯ সালে তার প্রথম কল্পবিজ্ঞানের গল্প মেরুনড অব ভেস্টা প্রকাশিত হয়েছিল অ্যামেজিং স্টোরিজ ম্যাগাজিনে। যদিও এটি ছিল তার লেখা তৃতীয় গল্প, গল্পটি সেই সময়ে অবশ্য বিখ্যাত অ্যাস্টাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিনটি প্রত্যাখ্যান করেছিল। কেবলই দাড়ি কামাতে শুরু করেছেন, আঠারো বছরের আজিমভ আত্মবিশ্বাস নিয়ে অ্যাস্টাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিনের কিংবদন্তি সম্পাদক জন ডব্লিউ ক্যাম্পবেলের অফিসে হাজির হয়েছিলেন পাণ্ডুলিপি নিয়ে। যদিও ক্যাম্পবেল ভদ্রভাবেই সেই গল্পটি প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছিলেন, তবে তিনি আজিমভের জীবনে সবচেয়ে বড় সাহিত্যবিষয়ক শিক্ষকে পরিণত হয়েছিলেন। তাদের সম্পর্ক একটি পর্যায়ে বেশ জটিল হয়ে উঠেছিল যদিও, বিশেষ করে আজিমভ যখন স্পষ্টভাবেই ক্যাম্পবেল ফ্যাসিবাদী রাজনীতি আর বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
এর পরে ধারাবাহিকভাবে তিনি প্রচুর গল্প লিখেছিলেন, তার গল্প থেকে প্রাপ্ত অর্থ তার কলেজের খরচে কাজে এসেছিল, এমনকি তার মাস্টার ডিগ্রি পর্যন্ত, যা তিনি কেমিস্ট্রিতে করেছিলেন (মেডিকেল স্কুল থেকে তাকে দুবার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল, কিন্তু পরে রসায়নে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন)। ১৯৪২ সালে আজিমভ ফিলাডেলফিয়া নেভি ইয়ার্ডে কেমিস্ট হিসেবে গবেষণা শুরু করেন। একই সঙ্গে তিনি তার গল্পগুলো বিক্রি করা অব্যাহত রেখেছিলেন। আজিমভের বিস্ময়কর বছরটি ছিল ১৯৪১/৪২। তিনি নাইটফল প্রকাশ করেছিলেন অ্যাস্টাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিনে—মানবজাতির মহাজাগতিক গুরুত্বহীনতা নিয়ে বিধ্বংসী মনোজাগতিক সংঘর্ষের একটি রূপক। ১৯৬৮ সালে ‘সায়েন্স ফিকশনস রাইটার অব আমেরিকা’ এটি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কল্পবিজ্ঞানের গল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। নিজেকে তিনি তৃতীয় শ্রেণীর একজন লেখক হিসেবেই ভাবতেন, নাইটফল যতদিন না অ্যাস্টাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশনের কভার স্টোরি হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল।
এছাড়া রোবট নিয়ে কিছু বিখ্যাত গল্প তিনি এ সময়ে প্রকাশ করেছিলেন, যেমন রিজন, লায়ার ও রানঅ্যারাউন্ড, যেখানে তিনি ‘রোবটিকস’ শব্দটি উদ্ভাবন করেছিলেন এবং এক্ষেত্রে বিখ্যাত তিনটি নৈতিক সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। প্রতি বছরের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল রোবোটিক উইকে যে অর্জনকে সম্মাননা জানানো হয়। তিনি তার রোবট গল্পগুলো একসঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন ১৯৫০ সালে ‘আই, রোবট’ শিরোনামে।
১৯৪২ সালে তিনি ফাউন্ডেশন প্রকাশ করেছিলেন। আজিমভের ফাউন্ডেশন সিরিজের প্রথম খণ্ড, ভবিষ্যৎ ইতিহাসের একটি অসাধারণ সৃষ্টি, যার মডেল ছিল এডওয়ার্ড গিবনের অষ্টাদশ শতাব্দীর ধ্রুপদী সৃষ্টি, ‘দ্য হিস্ট্রি অব ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার’। এই ধারাবাহিকে মানবতা যুদ্ধ করে একটি ৩০ হাজার বছরের বর্বরতা আর একটি মহাজাগতিক অধোগতির বিরুদ্ধে, যার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল সাইকো-হিস্ট্রির পরিসংখ্যানমূলক বিজ্ঞান। এ সুবিশাল মহাকাব্যটি মানবক্ষমতার সঙ্গে সামাজিক অবশ্যম্ভাবিতার মৃত হাতের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পূর্ণ ছিল। যে মূল ভাবনাটি এখনো অস্বস্তিকরভাবেই প্রাসঙ্গিক আজকে অ্যালগরিদমচালিত বিগ ডাটা সমাজে। ১৯৬৬ সালে ফাউন্ডেশন ট্রিলজি সেরা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জন্য হুগো অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল।
ফাউন্ডেশন সিরিজটি এমনকি আরো বেশি সাহসী প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে তিনি লিখেছিলেন, যা প্রস্তাব করেছিল, ভবিষ্যৎ নিজেই আসলে একটি সমাধানযোগ্য সমীকরণ। মূল ট্রিলজিটি আটটি পরস্পর সংযুক্ত গল্প আর নভেলায় তিনি লিখেছিলেন চল্লিশের দশকে, এটি সাইকো-হিস্ট্রির ধারণার সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল— বৈপ্লবিক একটি বিজ্ঞান, যা ব্যবহার করে জনগণের আচরণ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে। তার সাইকো-হিস্ট্রি প্রস্তাব করেছিল, পরিসংখ্যানের মাধ্যমে আগে থেকেই মানুষের বড় গ্রুপগুলোর আচরণ নির্ভুলভাবে পূর্ব ধারণা করা সম্ভব হবে, আর কেউ চাইলে হাজার বছরের সভ্যতার গতিপথও সেই অনুযায়ী অনুসরণ করতে পারবেন। হারি সেলডন সাইকো-হিস্ট্রির কাল্পনিক জনক, ছায়াপথের দুই প্রান্তে দুটি গ্রহ-উপনিবেশ বা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, একটি নতুন আর সভ্য আর কম সহিংস গ্যালাক্টিক সাম্রাজ্য, যা ধ্বংস হতে থাকা একটি সাম্রাজ্যকে প্রতিস্থাপিত করবে। যেহেতু সাইকো-হিস্ট্রি পূর্বধারণা করেছিল যে তথাকথিত ‘শেলডন প্ল্যান’ ব্যর্থ হবে না, আজিমভের চরিত্ররা সেই পরিকল্পনাই আঁকড়ে ধরে ছিল একটি বিশ্বাসের সঙ্গে, যা প্রায় ধর্মের মতো মনে হতে পারে।
হোবার ম্যালোর শব্দে, যিনি একটি ফাউন্ডেশনের মেয়র ছিলেন: ‘ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কী চিন্তা? কোনো সন্দেহ নেই শেলডন আগেই এসব ভেবেছেন এবং এর জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছেন।’ সাইকো-হিস্ট্রি হয়তো বিজ্ঞানের চেয়ে বেশি মনে পারে জাদু, তবে ফাউন্ডেশনে নিহিত আছে একটি মানবকেন্দ্রিকতা, যা বর্তমানে মেনে নেয়া কঠিন মনে হতে পারে। এই ধারাবাহিক অনুযায়ী, মানুষ একদিন ছায়াপথ শাসন করবে, মানুষ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্ব ধারণা করতে পারে। পলায়নপর দ্বিতীয় ফাউন্ডেশনের মানুষ অন্যদের মন নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। এমনকি শেলডনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুমান করেছিল যে বীরদের জন্ম হবে সঠিক জায়গায় এবং সঠিক সময়ে, যা প্রতিটি নতুন সংকট থেকে ফাউন্ডেশনকে উদ্ধার করবে। মানবতার ওপর এমন সাহসী আত্মবিশ্বাস যে তারা ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সেটি আজিমভের বহু কাজের মূল ভাবনা ছিল।
১৯৪৫ সালে আজিমভ যুক্তরাষ্ট্রে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং ছয় মাস তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন। এরপর কলম্বিয়ায় ফিরে ১৯৪৮ সালে তার ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তার প্রথম (এবং একমাত্র) একাডেমিক পদে যোগদানের আগে। বোস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনে প্রাণরসায়ন পড়িয়েছিলেন। এমনকি যখন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক হিসেবে তার পরিচিত ক্রমেই বাড়ছিল, শিক্ষক হিসেবে তার দায়িত্ব বিজ্ঞান লেখার প্রতি তার মনোযোগ খানিকটা সরিয়ে দিয়েছিল। এক্ষেত্রে আজিমভ শুরু করেছিলেন একটি পাঠ্যপুস্তক দিয়ে ১৯৫৩ সালে, যা তিনি তার দুই সহকর্মীর সঙ্গে লিখেছিলেন। প্রায় ৮০০ পাতার একটি প্রাণরসায়ন এবং মানব বিপাক-প্রক্রিয়া-সংক্রান্ত বইয়ের সহলেখক ছিলেন। রসায়ন নিয়ে এরপর আরো ছয়টি বই প্রকাশিত হয়েছিল, এছাড়া চমকে দেয়ার মতো জনপ্রিয় বিজ্ঞানের প্রবন্ধ একই সঙ্গে প্রকাশ করেছেন, যাদের শিরোনামই ছিল অভিভূত করার মতো, যেমন ‘দি এক্সপ্লোশন উইথ ইন আস’ এবং ‘দি অ্যাবনরমালিটি অব বিইং নরমাল’। এই বইটি ছিল আরো ধারাবাহিক কিছু বইয়ের প্রথমটি, যার জন্য তার আয়—কল্পবিজ্ঞান ও অন্য লেখাসহ—দ্রুত তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনকে অতিক্রম করে গিয়েছিল। যখন আজিমভকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল কোনো গবেষণা না করার জন্য, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন তিনি তার লেখাকেই গবেষণা বিবেচনা করেন। এর কিছুদিন পর তিনি অবশ্যই সেই চাকরিটি হারান। তিনি তার লেখায় মনোনিবেশ করেছিলেন (যদিও আদালতের রায় তাকে তার পদে পুনর্বহাল করার নির্দেশ দিয়েছিল)।
বিজ্ঞান ও সমাজের মাঝে সমস্যাজনক দূরত্ব পৃথিবীর জন্য আশঙ্কাজনক পরিণতি সৃষ্টি করতে পারে, এটি আজিমভ শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। ১৯৭১ সালে তার অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ প্রবন্ধ দ্য গুড আর্থ ইজ ডাইং-এ তিনি উল্লেখ করেছিলেন, দ্রুতহারে বাড়তে থাকা প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সমাজ আর পরিবেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাবটি এরই মধ্যেই বৈশ্বিক মাত্রা স্পর্শ করেছে। একই সঙ্গে সেই দৃষ্টিভঙ্গিগুলো, যেমন প্রবৃদ্ধির প্রতি সীমাহীন শ্রদ্ধা এবং গোত্রবাদিতায় আত্মসমর্পণ ইত্যাদি টিকে আছে। এ দৃষ্টিভঙ্গিগুলো প্রাচীন সংকীর্ণ বিশ্বাস ও স্থানীয় নিয়মকানুন দ্বারা নির্ধারিত, অথচ আধুনিক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সেগুলোর পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল।  আজিমভ লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর সাধারণ জ্ঞান যার অস্তিত্ব ছিল একসময়, সেটি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জগতের পুরাণে পরিণত হয়েছে আর সেটি আত্মহননকারী পুরাণ।’ ‘দ্য সিক্সথ এক্সটিংশন’ অথবা ‘অ্যানথ্রোপোসিন ইপোকের’ মতো শব্দ আর উত্কণ্ঠিত সামাজিক-প্রযুক্তিগত ভাবনাগুলো আবির্ভূত হওয়ার বহু দশক আগেই আজিমভ লিখেছিলেন কীভাবে মানবসৃষ্ট বা অ্যানথ্রোপোজেনিক প্রক্রিয়াগুলো এ গ্রহকে বিষাক্ত করে তুলছে। ১৯৭০-এর দশক থেকে তিনি পরিবেশ দূষণ নিয়ে লিখেছিলেন, যা আমাদের ওজোন স্তরটিকে ধ্বংস করছে, সাগরকে অম্লীকরণ করছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মাত্রা বর্ধিত করছে। তিনি মানব-পরিচালিত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কথা বলেছিলেন এবং জীবজগতের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়েও আলোচনা করেছিলেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন কীভাবে জনসংখ্যার অতিবৃদ্ধি ও বেপরোয়া মানব কর্মকাণ্ড অভূতপূর্ব হারে বহু প্রজাতির বিলুপ্তির সূচনা করেছে।
আজিমভের জন্মের ১০০ বছর পর অস্ট্রেলিয়া থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় আজ দাবানলে বনাঞ্চল পুড়ছে, ক্রমেই বাড়তে থাকা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা গ্রাস করছে বহু উপকূলীয় এলাকা, অপার্থিব ঝড়ে বিধ্বস্ত হচ্ছে শহর। মানুষের চিরঅতৃপ্ত ক্ষুধা জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করা অব্যাহত রেখেছে আর সংঘর্ষ আমাদের আরো বেশি সহিংস একটি পরিণতি দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর এমন একটি সময়ের ক্রান্তিলগ্নে আমাদের জন্য হয়তো ভালো হবে আজিমভের লেখা পড়ে তার সঙ্গে মহাশূন্যে সেই যাত্রায় সঙ্গী হওয়া। হয়তো তখন আমরা একসঙ্গে আমাদের ম্লান নীল বর্ণের পৃথিবীর দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পারব, যা শূন্যে ভেসে আছে এবং আরো সুস্থ, আরো মানবিক এবং আরো যৌক্তিক একটি দৃষ্টিভঙ্গিও অর্জন করতে পারব।
আজিমভ একবার তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন, যদি তার কোনো অকারণ উত্কণ্ঠা থাকে, সেটি হচ্ছে লেখার জন্য তার তীব্র ইচ্ছা, বলেছিলেন তিনি মরতে চান টাইপরাইটারের দুই বোতামের মধ্যে নাক আটকে, তার মৃত্যু অবশ্য সেভাবে হয়নি। ১৯৯২ সালে তিনি মারা যান, তার ভাই এই মৃত্যুর কারণ হিসেবে হূদযন্ত্র আর কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া কথা উল্লেখ করেছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রী এবং বিধবা জ্যানেট আজিমভের মৃত্যুর পর নিশ্চিত করেছিলেন ১৯৮৩ সালে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওপেন হার্ট সার্জারির সময় নেয়া রক্ত পরিসঞ্চালনের সময় তিনি এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছিলেন। তার চিকিত্সকরা তাকে এ তথ্য গোপন রাখতে রাজি করাতে পেরেছিলেন, কারণ এটি অন্য রোগীদের প্রয়োজনীয় সার্জারি না করাতে প্ররোচিত করতে পারে। ১০ বছর পরে আজিমভের মৃত্যু, যখন তার সেই সব ডাক্তারও অনেকে মৃত, জ্যানেট ও রবিন আজিমভ তার এইচআইভির কাহিনীটি প্রকাশ করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জ্যানেট তার আত্মজীবনীর নিজের সংস্করণ ইটস বিন এ গুড লাইফ-এ এটি প্রকাশ করেন। আজিমভ এ অসুখের জটিলতায় ১৯৯২ সালে ৭২ বছর বয়সে মারা যান। কিন্তু তার উত্তরাধিকার, তার বইগুলো রয়ে গেছে আমাদের কাছে।

মূল সূত্র:

1.   J. E. Gunn, ‘Asimov at 100’, Science 367 (6473), 20-21.

2.   J. E. Gunn, Isaac Asimov: The Foundations of Science Fiction (Oxford Univ. Press, 1982).

3.   J. E. Gunn, Alternate Worlds: The Illustrated History of Science Fiction (A & W Visual Library, 1975).

4.   I. Asimov, ‘The story behind the ‘Foundation’,‘ Isaac Asimov’s Science Fiction Magazine, December 1982.

5.   I. Asimov, Foundation’s Edge (Doubleday, 1982)

 

কাজী মাহবুব হাসান: অনুবাদক। বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ইতিহাসে আগ্রহী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন