মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানিতে ধস

কারখানা বন্ধ হয়ে খেলাপি ঋণ বাড়ছে

ওমর ফারুক চট্টগ্রাম ব্যুরো

দেশের মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি খাত এখন নিম্নমুখী। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়াসহ নানাবিধ কারণে প্রতি বছরই কমছে খাতটির রফতানি ও রফতানি আয়। ক্রমাগত লোকসানে পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক কারখানা। এতে বিপাকে পড়ছে খাতটিতে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলোও। খাতটিতে এসব ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত শত শত কোটি টাকার ঋণ এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, দেশের মৎস্য রফতানি খাতে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে থাকেন আশির দশক থেকে। ২০০৪-০৫ পর্যন্ত ভালোই ব্যবসা করেছে খাতটি। একসময় দেশের রফতানি আয়ের শীর্ষস্থানেও উঠে এসেছিল মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি খাত। ওই সময় পর্যন্ত ভালো মুনাফার আকর্ষণে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন নতুন নতুন অনেক উদ্যোক্তা। ব্যবসা না বুঝেই স্রেফ শখের বশে এ ব্যবসায় নাম লিখিয়েছেন অনেকে। অন্যদিকে মৎস্য রফতানিকারী কারখানা বা প্রকল্পের নামে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ভোগবিলাসেরও নজির গড়েছেন কেউ কেউ। এছাড়া অতি মুনাফার লোভে রফতানি পণ্যে অপদ্রব্য পুশ করে বদনাম কুড়িয়েছেন অনেকে। তাদের এ অসুস্থ চর্চায় বিপাকে পড়েছেন প্রকৃত ব্যবসায়ীরা। এক পর্যায়ে দেখা যায়, যে গতিতে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে, সে গতিতে উৎপাদন বা রফতানি বাড়ছে না। অন্যদিকে প্রতিযোগী দেশগুলোও এ সময়ে নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারেও রফতানি পণ্যের কাঙ্ক্ষিত দাম মেলেনি। এর ধারাবাহিকতায় নিয়মিত লোকসান গুনতে হয়েছে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের। একই সঙ্গে ঝুঁকিতে পড়েছে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগও।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করে দেশের মোট আয় হয়েছে ৪ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। যেখানে আগের অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে দেশে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি বাবদ আয় কমেছে ৮১ কোটি টাকা। অন্যদিকে পাঁচ বছর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাতের রফতানি আয় ছিল ৪ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। এরপর পণ্য রফতানি বাবদ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৮২ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা আয় করে খাতটি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএফএফইএর সভাপতি বেলায়েত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, কয়েক বছর ধরে মৎস্য রফতানি খাতের দুরবস্থা চলছে। এ খাতকে চাঙ্গা করে দেশের রফতানি আয় বাড়াতে আমরা বহুবার সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেই। প্রতিষ্ঠানগুলোও কয়েক বছর ধরে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি খেলাপিতেও পরিণত হচ্ছে। অথচ এ মৎস্য রফতানি খাত একসময় দেশের রফতানি আয়ে শীর্ষে ছিল।

বিএফএফইএর তথ্যমতে, একসময় দেশে প্রায় ১৪০টি হিমায়িত মৎস্য রফতানি কারখানা ছিল। অর্ধশতাধিক এরই মধ্যে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ১০৬টি কারখানা সংগঠনটির তালিকাভুক্ত থাকলেও পণ্য রফতানি করছে মূলত ৩০টির মতো প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে চট্টগ্রামের সাগরিকা বিসিক শিল্প জোন ও কালুরঘাট বিসিক শিল্প জোনে ৪৪টি কারখানা ছিল। এর মধ্যে মাত্র পাঁচ-ছয়টি কোনোভাবে টিকে রয়েছে।

দেশের মৎস্য রফতানি খাতের অন্যতম পাইওনিয়ার হিসেবে খ্যাত মিনহার সি ফুডস নামে একটি প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার আগ থেকেই এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানটি। মিনহার সি ফুডস যাত্রা করেছিল চট্টগ্রামে। পরবর্তী সময়ে কক্সবাজারেও একটি কারখানা গড়ে তোলে প্রতিষ্ঠানটি। দেশের রফতানি আয়ে দীর্ঘদিন অবদান রাখা এ প্রতিষ্ঠানও এখন বন্ধের পথে। একই সঙ্গে ঝুঁকিতে পড়েছে একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রায় শতকোটি টাকার ঋণও।

জানা গেছে, মিনহার সি ফুডস দীর্ঘদিন ধরে এবি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার নিয়মিত গ্রাহক ছিল। ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়ায় এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ সুবিধা কমিয়ে দেয় এবি ব্যাংক। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির সব পাওনা পরিশোধ করে ওয়ান ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ সুবিধা নিতে থাকে মিনহার সি ফুডস। এরপর বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখা থেকে নানা ঋণ সুবিধা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় শতকোটি টাকায়।

ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপক জানান, মিনহার সি ফুডস মৎস্য রফতানি খাতের নামকরা একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৭ সালে ওয়ান ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ব্যবসা শুরুর পর ২০১৮ সাল পর্যন্ত ভালোই চলছিল প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে রফতানি কমে যাওয়ায় ব্যাংকঋণ পরিশোধে গড়িমসি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির দুটি কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে মিনহার সি ফুডসের কাছে পাওনা শতকোটি টাকাই এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

তিনি আরো বলেন, রফতানি বন্ধ করে দেয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করতে কারখানা দুটি বিক্রির চেষ্টা করছে। কিন্তু উপযুক্ত দর পাওয়া যাচ্ছে না। যে দর পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে ব্যাংকের পাওনার অর্ধেক টাকাও পরিশোধ করা যাবে না।

হিমায়িত মৎস্য রফতানিসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে মেসার্স কোস্টাল সি ফুডস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনা ৭৩ কোটি টাকা। কক্সবাজারের কুলিয়ারচর সি ফুডসের কাছে একই ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৬৫ কোটি টাকা। সার অ্যান্ড কোংয়ের কাছে ব্যাংকটির পাওনা ৪৭ কোটি টাকা। চাঁদপুরের সি ফুডস করপোরেশনের কাছেও বড় অংকের পাওনা আটকে গেছে সোনালী ব্যাংকের।

মেসার্স মেঘনা সি ফুডস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে কৃষি ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৫৯ কোটি টাকা। মেসার্স চিটাগং সি ফুডসের কাছেও ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখার একটি ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।

এছাড়া মেসার্স ইফফাত ইন্টারন্যাশনালের কাছে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৫০ কোটি টাকা, রেইনবো সি ফুডসের কাছে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১২ কোটি, মেসার্স মোস্তফা শ্রিম্প প্রডাক্টসের কাছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২ কোটি, মেসার্স ফিশ মার্ক এক্সপোর্টের কাছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক নাসিরাবাদ শাখার ২ কোটি ও জিলানী সি ফুডসের কাছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক সদরঘাট শাখার ৪ কোটি টাকার ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

সোনালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মেসার্স কোস্টাল সি ফুডস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকটির লালদীঘি শাখা থেকে ঋণ সুবিধা নিয়ে এসেছে দীর্ঘদিন। ২০১৪ সাল পর্যন্তও প্রতিষ্ঠানটির ঋণমান ভালো ছিল। কিন্তু ২০১৫ থেকে মৎস্য রফতানিতে মন্দার কারণে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংকঋণ পরিশোধেও ভাটা পড়ে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির রফতানি বন্ধ হয়ে গেলে আটকা পড়ে ব্যাংকটির প্রায় ৭৩ কোটি টাকা। বহু চেষ্টার পরও পাওনা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে চেক ও অর্থঋণ মামলা করেছে সোনালী ব্যাংক।

জানা গেছে, এ ঋণের বিপরীতে চট্টগ্রাম নগরীর সাগরিকা বিসিক শিল্প জোনের ৪৮ শতক জমিসহ কারখানা বন্ধক রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু কারখানাসহ বন্ধককৃত জমির বর্তমান মূল্য ব্যাংকের পাওনার তুলনায় খুবই সামান্য। তাছাড়া বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রিতে অনেক ঝামেলা থাকায় ভালো দরদাতাও পাওয়া যায় না। ফলে প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে এ পাওনা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংক চট্টগ্রামের জেনারেল ম্যানেজার মো. জাহাঙ্গির আলম বণিক বার্তাকে বলেন, মামলার পাশাপাশি সমঝোতার মাধ্যমেও ঋণের টাকা উদ্ধারে চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রতিষ্ঠান মালিকের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি বিশেষ সুবিধায় ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ঋণটি নিয়মিত করার চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

ইচ্ছাকৃতভাবে নয়, উৎপাদন ও রফতানি কমার কারণে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন কোস্টাল সি ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম মোস্তফা। মৎস্য রফতানি খাতের প্রবীণ এ উদ্যোক্তা বণিক বার্তাকে বলেন, গত ১৫ বছরে মৎস্য রফতানি খাতের উন্নয়নে সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। পাশের দেশ ভারত একসময় আমাদের প্রতিযোগী ছিল। তারা গত ১০ বছরে প্রতি বছর হাজার হাজার টন ভেন্নামি চিংড়ি উৎপাদন ও রফতানি করছে। আর আমরা এখনো এটি শুরুই করতে পারিনি।

একই কথা জানালেন রিভারএন ফিশ অ্যান্ড ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান চৌধুরীও। তিনি বলেন, হিমায়িত মৎস্য রফতানি আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। যে পরিমাণ প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসায় এসেছে, সে পরিমাণে উৎপাদন বাড়েনি। বরং বছর বছর কমেছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও রাশিয়া ছিল বাংলাদেশের মৎস্য ও মৎস্যপণ্যের প্রধান আমদানিকারক দেশ। গত কয়েক বছরে ভিয়েতনামের ভেন্নামি চিংড়ি সে বাজার দখল করে নিয়েছে। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হিমায়িত মৎস্য রফতানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বহু প্রতিষ্ঠান ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে না পেরে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের এজিএম (আগ্রাবাদ করপোরেট শাখা) এএইচএম কামরুজ্জামান বলেন, মৎস্য রফতানি খাতে কৃষি ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে অর্থায়ন করে আসছে। অন্য খাতের তুলনায় এ খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধের হার ভালো। তবে কয়েক বছর ধরে হিমায়িত মৎস্য রফতানি খাতে ধসের কারণে ছোট-বড় বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়েছে। তবে খেলাপি হওয়া ঋণের মধ্যেও আমাদের আদায়ের পরিমাণ ভালো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন