চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস থেকে রফতানি প্রবৃদ্ধিতে যে নেতিবাচক ধারা চালু হয়েছিল, সপ্তম মাসেও তা কাটিয়ে ওঠা যায়নি। জানুয়ারি শেষেও ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত ছিল রফতানিতে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল হালনাগাদ রফতানি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। ইপিবির হিসাবে, জুলাই থেকে জানুয়ারি—সাত মাসে বিশ্ববাজারে ২ হাজার ২৯১ কোটি ৯৪ লাখ ৭০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ২ হাজার ৪১৭ কোটি ৯৫ লাখ ৯০ হাজার ডলারের পণ্য। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ১২৬ কোটি ১ লাখ ২০ হাজার ডলার বা ৫ দশমিক ২১ শতাংশ কমেছে রফতানি।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাঁচ অর্থবছর ধরে প্রথমার্ধে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারায় ছিল রফতানি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস শেষে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এরপর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেছে দেশের রফতানি খাত। কিন্তু চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস থেকে নেতিবাচক ধারা শুরু হয় রফতানিতে, যা সাত মাস শেষেও অব্যাহত রয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ইতিবাচক, ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। কিন্তু আগস্টে শুরু হয় নেতিবাচক ধারা। ওই দুই মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ। এরপর অর্থবছরের তিন মাস শেষে ঋণাত্মক ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ, চার মাস শেষে ঋণাত্মক ৬ দশমিক ৮২, পাঁচ মাস শেষে ঋণাত্মক ৭ দশমিক ৫৯, ছয় মাস শেষে ঋণাত্মক ৫ দশমিক ৮৪ ও সাত মাস অর্থাৎ জানুয়ারি শেষেও ঋণাত্মক ৫ দশমিক ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত ছিল রফতানিতে।
রফতানি খাতের শীর্ষ তিন পণ্য হলো পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত এবং পাট ও পাটজাত পণ্য। অর্থবছরের সাত মাসের পরিসংখ্যান বলছে, পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি বাড়লেও কমেছে পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি। তবে দেশের মোট রফতানির ৮৪ শতাংশ অবদান রাখা পণ্য পোশাক রফতানি কমার প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক রফতানিতে।
ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের সাত মাস শেষে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি বেড়েছে ২০ দশমিক ৮২ শতাংশ। চামড়াজাত পণ্য রফতানি কমেছে ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে প্রধান রফতানি পণ্য পোশাক রফতানি হয়েছিল ১ হাজার ৯০৬ কোটি ৩২ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয় ২ হাজার ২১ কোটি ৭৪ লাখ ৮০ হাজার ডলারের পোশাক। এ হিসাবে পোশাক রফতানি কমেছে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ।
ধারাবাহিক রফতানি কমাকে পোশাক শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছেন খাতসংশ্লিষ্ট রফতানিকারকরা। তারা বলছেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পোশাক খাতে নিম্নতম মজুরি বাড়ানো হয়, যার প্রভাবে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে রফতানিতে। রফতানি প্রবৃদ্ধির বাঁক ঘোরাতে হলে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। নীতিগত সহায়তা ছাড়া প্রতিযোগিতা সক্ষমতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বণিক বার্তাকে বলেন, সমস্যা এখনো অব্যাহত। ডিসেম্বর-জানুয়ারি ব্যস্ততম মাস হওয়ার কথা থাকলেও এখনো আমরা রফতানি বাড়াতে পারিনি। এর প্রাথমিক কারণগুলো এখনো বিদ্যমান। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির পর পণ্যের মূল্য বাড়েনি। অতিরিক্ত সক্ষমতার সমস্যাও বিদ্যমান রয়েছে। পাশাপাশি ছিল শক্তিশালী মুদ্রা। রফতানিবিরোধী পক্ষপাত ও পোশাক খাত অব্যাহতভাবে যথেষ্ট সহায়তা পাচ্ছে—এমন কিছু ধারণার ফলে আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই থেকে যাব বলে আশঙ্কা করছি। হয়তো পরিস্থিতি আরো খারাপও হতে পারে।
মাসভিত্তিক রফতানি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রফতানি প্রবৃদ্ধির নেতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল। এ সময়ে সাত মাসে যথাক্রমে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক ১১ দশমিক ৪৯, ৭ দশমিক ৩, ১৭ দশমিক ১৯ ও ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। ডিসেম্বরে রফতানি প্রবৃদ্ধি কিছুটা ইতিবাচক ধারায় ফিরে হয় ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। তবে সর্বশেষ জানুয়ারিতে আবারো নেতিবাচক ধারায় ফিরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
রফতানির নেতিবাচক ধারার কারণ হিসেবে ডলারের বিপরীতে টাকার অতিমূল্যায়নকে দায়ী করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রতিযোগী দেশগুলো ডলারের বিপরীতে নিজেদের মুদ্রা অবমূল্যায়ন করেছে। ফলে তাদের মূল্য সক্ষমতা বেড়েছে। এ কারণে অনেক ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে না এসে প্রতিযোগী দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে। ক্রয়াদেশ ঘাটতিতে বাংলাদেশের রফতানি কমে গেছে।
রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বণিক বার্তাকে বলেন, পরিস্থিতি দ্রুতই ভালো হবে বলে আশা করছি। তবে চ্যালেঞ্জ আছে অনেক। মূল্য সক্ষমতা প্রতিযোগী দেশের চেয়ে কমে এসেছে, এটাই আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
