পরিবেশের নিয়ম মানছেন না মেগা প্রকল্পের ঠিকাদাররা

শামীম রাহমান

রাজধানীর বনানীতে গত বছরের নভেম্বরে বায়ুমান সূচক (একিউআই) ছিল ৪২৫ এসপিএম। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজে ধুলা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সেখানে বাতাসের অবস্থা চলে গিয়েছিল খুবই খারাপ অবস্থায়। এজন্য প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে লাখ টাকা জরিমানা করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত। দেয়া হয় নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা প্রকল্প এলাকায় প্রতিদিন অন্তত দুবার পানি ছিটানোর নির্দেশনা। তবে নির্দেশনা যে মানা হয়নি তা উঠে এসেছে ডিসেম্বরের বায়ুমান পরীক্ষায়। গত ২৬ ডিসেম্বর একই এলাকার বায়ুমান সূচক ৪৭৩ এসপিএম পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর ঠিকাদাররা পরিবেশের নিয়মকানুন কিছুই মানছেন না। তাদের বারবার তাগাদা দেয়ার পরও দূষণরোধক ব্যবস্থা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন না তারা। উল্টো জরিমানা করায় পরিবেশ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নালিশ করেছেন তারা।

উত্তরা থেকে মিরপুর-আগারগাঁও হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত চলছে ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। গত নভেম্বরে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর আগারগাঁওয়ে বায়ুমান সূচক পরীক্ষা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই সময় মিরপুরে বায়ুমান সূচক ছিল ৭৬৪ এসপিএম আগারগাঁওয়ে ৮২০ এসপিএম। বায়ূদূষণের জন্য সে সময় মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানার পর প্রকল্প এলাকায় আরো খারাপ হয়েছে বাতাসের মান। ডিসেম্বরে মিরপুরে বায়ুমান ছিল ১১৩৭ এসপিএম, আগারগাঁওয়ে ১১১১ এসপিএম।

বায়ুমান সূচক ১০০ এসপিএমের বেশি হলেই সেটিকে অস্বাস্থ্যকর ধরা হয়। সেখানে ঢাকার দুই মেগা প্রকল্প এলাকায় দূষণের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে ১১০০ এসপিএমের উপরে। অবস্থায় বাতাসের মান তুলে ধরে পরিবেশ অধিদপ্তরকে একটি চিঠি দিয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। চিঠিতে ঢাকার বাতাসের মানকে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

গত বছরের নভেম্বরে বায়ুদূষণের জন্য মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে লাখ টাকা জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। জরিমানার পর তারা দূষণ রোধে সচেষ্ট হয়নি, তা ডিসেম্বরের বায়ুমান সূচক পরীক্ষাতেই স্পষ্ট। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, জরিমানা করায় মেট্রোরেলের কর্মকর্তারা সচেতন হওয়ার বদলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে নালিশ করেছেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ বলছে, ঢাকা মহানগর এলাকায় বাস্তবায়নাধীন মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের নির্মাণকাজের ফলে সৃষ্ট আবর্জনা বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। একইভাবে শহরের ভেতরে রাস্তা-ড্রেন খোঁড়াখুঁড়ি বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের সময়ও সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষতিকর আবর্জনা, যেগুলো সহজেই বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়েছে, উন্নয়ন/ রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চলার সময় বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার পরিবহনের ক্ষেত্রে বাতাসে ধূলিকণার বিস্তার প্রতিরোধে যথাযথ/কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। খোঁড়াখুঁড়ির পর কাদামাটি এবং সিমেন্ট, বালু, ক্ষুদ্র ইটের টুকরোর মতো বাতাসে মিশ্রণযোগ্য নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হচ্ছে। ফলে একদিকে কাদামাটি বিভিন্ন যানবাহনের মাধ্যমে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে, অন্যদিকে উন্মুক্ত নির্মাণসামগ্রী বাতাসে মিশে দূষণ করছে।

গত ১৩ জানুয়ারি উচ্চ আদালতের এক রিট পিটিশনে পরিবেশ দূষণ রোধে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থাকে নয়টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি নির্দেশনায় সংশ্লিষ্ট সংস্থা হিসেবে মেট্রোরেল এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে রাখা হয়েছে। নির্দেশনাগুলো হলো নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, নিয়মিত পানি ছিটানো নিয়মকানুন মেনে নির্মাণকাজ এগিয়ে নেয়া। তবে গতকাল সরেজমিন মেট্রোরেল প্রকল্প এলাকা ঘুরে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় ফেলে রাখতে দেখা গেছে। পানি ছিটানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা এমনভাবে ছিটানো হয়েছে যে জায়গায় জায়গায় কাদা হয়ে গেছে।

কাদার বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশরাব বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের নির্দেশনা ছিল পর্যাপ্ত পানি ছিটিয়ে ধুলা নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ পানি ছিটিয়ে আরো দূষণ বাড়িয়েই দিচ্ছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, পানি ছিটানোর ফলে বিভিন্ন জায়গায় কাদা সৃষ্টি হচ্ছে। সেই কাদার ওপর দিয়ে যখন গাড়ি চলছে, তখন তা পুরো সড়কে ছড়িয়ে পড়ে। পরে সেগুলো শুকিয়ে ধুলা হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এজন্য আমরা পানি স্প্রে করার পরামর্শ দিয়ে থাকি।

মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের কাজ বাস্তবায়ন করছেন দেশী-বিদেশী স্বনামধন্য ঠিকাদাররা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশী ঠিকাদাররা বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশী ঠিকাদারদের মতোই আচরণ করছেন। যারা অন্যান্য দেশে পরিবেশগত দিকগুলো ভালোমতো অনুসরণ করে ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন, তারাই বাংলাদেশে এসে চলছেন উল্টোভাবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক . সামছুল হক।

তবে ঢাকায় বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পের কর্মকর্তাদের দাবি, সব ধরনের নিয়মকানুন মেনেই তারা নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকা মেট্রোরেলের (এমআরটি লাইন-) উপপ্রকল্প পরিচালক (গণসংযোগ) খান মো. মীজানুল ইসলাম জানিয়েছেন, মেট্রোরেলের কাজ পরিবেশ আইনকানুন মেনেই বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় বাতাসের মান সহনীয় পর্যায়েই রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। একই ধরনের মন্তব্য করেছেন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক এএইচএম শাখাওয়াত আকতার।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন